নোবেলপ্রাপ্তি একজন মানুষের উৎকর্ষের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি বলা যায়। অবশ্য উৎকর্ষের একেবারে উঁচু সিঁড়িতে উঠেও অনেকে নোবেল না-ও পেতে পারেন। কাল ( মার্চ ০৮, ২০২১ ) আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীদের নোবেলপ্রাপ্তির গল্প বলা নারীদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোর একটি পন্থা হতে পারে।
যদিও আমরা পুরুষেরা অনেকেই শুধু নারী দিবসেই এই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানো সীমাবদ্ধ রাখি। এরপর ভুলে যাই। ভুলে যাই যে সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা বিধান ছাড়া একটি আধুনিক সমাজ ও উন্নত রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব। নারী-পুরুষের সমতা বিধান তথা নারীর ক্ষমতায়ন উন্নয়নের একটি প্রধান সূচক। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের কারণেই সম্ভব হয়েছে উন্নয়নের অন্যান্য সূচকে উল্লম্ফন ঘটানো।
তবে নারীর ক্ষমতায়ন এখনো সীমিত। ক্ষমতায়ন সেই দিনই পূর্ণতা পাবে, যেদিন নারী পরিবারে ও রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমান ক্ষমতা অর্জন করবেন এবং নিজের ইচ্ছেমতো জীবন পরিচালনার সুযোগ পাবেন।
নারীর নোবেলপ্রাপ্তির গল্পে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ভেঙে পড়বে এবং এ জন্যই এই গল্পের অবতারণা। ১৯০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নারীরা ৫৮ বার নোবেল পান। মারি কুরি দুবার নোবেল পান। এই হিসাবে ৫৭ জন নারী নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল প্রাইজের সূচনা হয় ১৯০১ সালে আর মারি কুরি নোবেল পেয়ে যান ঠিক দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯০৩ সালেই। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পাওয়ার পর তিনি আবার নোবেল পান ১৯১১ সালে রসায়নে। দুই বিষয়েই গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। মারি কুরি ছাড়া আর মাত্র তিনজন নোবেল পান দুবার করে। এঁদের মধ্যে লিনুস পলিং ১৯৫৪ সালে রসায়নে ও ১৯৬২ সালে শান্তিতে।
জন বার্ডিন নোবেল পান পদার্থবিদ্যারই দুটি ক্ষেত্রে। ফ্রেডেরিক সাঙ্গার নোবেল পান দুবারই রসায়নে। মারি কুরিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি গবেষণাভিত্তিক নোবেল পান দুটি ভিন্ন বিষয়ে এবং এত আগে।
নোবেল কমিটি ‘পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছেন যে নারীরা’ ও ‘ইন্সপাইরেশনাল উইমেন’ তথা ‘প্রেরণদায়ী নারীরা’ শিরোনামে দুটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। প্রথমটিতে কানাডার ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড, পোল্যান্ডের মারি কুরি, প্রাগের গার্টি কোরি, আমেরিকান ঔপনাস্যিক টনি মরিসন, ইরানের মানবাধিকারকর্মী শিরিন এবাদি ও ফ্রান্সের অর্থনীতিবিদ এশথার ডুফলোর নাম উল্লেখ করে। ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড ২০১৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে স্মরণ করেন, তাঁর বাবা-মা ও শিক্ষকেরা সারাক্ষণ তাঁর কানের কাছে বলতেন ‘মেয়ে, তোমার পক্ষে যেকোনো কিছু করা সম্ভব’। তিনি বলেছেন, ‘তার ফলে আমি কিছু পারব না—এ রকম ধারণাই আমার কখনো হয়নি।’ লেজার পাল্স-এর গবেষণা করে ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটান।
মারি কুরির অবদানের কথা আগেই বলা হয়েছে, কিন্তু যা বলা হয়নি, তা হলো তাঁকে দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। টিউশনি করে, গভর্নেসের কাজ করে খরচ চালাতে হয়েছে। গ্রামে গিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, মেয়ে হওয়ার কারণে তিনি নিয়মিত ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারেননি। পড়তে হয়েছে ‘ফ্লোটিং ইউনিভার্সিটিতে’ গোপনে। তিনি অবশ্য পিতার কাছ থেকে গভীর প্রেরণা ও সহযোগিতা পান। গার্টি কোরি ১৬ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটিতে মেডিকেল সায়েন্স পড়ার উদ্দেশ্যে এক বছরের মধ্যেই ল্যাটিন, সায়েন্স ও ম্যাথমেটিকসে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেন বাড়িতে পড়াশোনা করেই। ১৯১৪ সালে তিনি যখন প্রাগের একটা মেডিকেলে স্কুলে ভর্তি হন, ওই সময়ের জন্য এটা ছিল একটা বিরল ঘটনা।
শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম নেওয়া টনি মরিসন নিজের জীবনের ও সমাজের ভয়াবহ অবস্থা চিত্রিত করেন এবং আমেরিকান সমাজকে মারাত্মক এক ঝাঁকুনি মারেন। কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে তিনিই প্রথম সাহিত্যে নোবেল লাভ করেন ১৯৯৩ সালে। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে নারীদের অবস্থা খুবই সঙিন হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় মানবাধিকারকর্মী শিরিন এবাদির পক্ষে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী ও শিশু অধিকার এবং শরণার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাওয়া খুবই দুরূহ ছিল। এর স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় ২০১৭ সালে। তিনিই প্রথম মুসলিম নারী, যিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হন। শিরিন এবাদি অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন আমাদের সবার জন্য। এশথার ডুফলো সবচেয়ে কম বয়সে অর্থনীতিতে নোবেল পান। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়ে তিনি পৃথিবীকে চমকে দেন। এশথার ডুফলোর বিশেষত্ব হলো, তিনি কেবল গবেষণা করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি, গবেষণার ফলাফল দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে ও হতদরিদ্রদের সক্ষমতা সৃষ্টিতে সরাসরি অবদান রাখেন।
‘ইন্সপাইরেশনাল উইমেন’ ক্রোড়পত্রেও ছয়জন নারীর যুগান্তকারী অবদানের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছে মারিয়া গোপার্ট মেয়ের পদার্থবিদ্যায় ১৯৬৩ সালে, জেনিফার এ ডোউডনা রসায়নে ২০২০ সালে, ক্যারোল ডব্লিউ গ্রেইডার ২০০৯ সালে মেডিসিনে, এলফ্রিডে ইয়েলিনেক ২০০৪ সালে সাহিত্যে, মেইরেড কোরিগান শান্তিতে ১৯৭৭ সালে এবং প্রথম নারী হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পান এলিনোর অসট্রম ২০০৯ সালে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে পদার্থবিদ্যায়, রসায়নে, মেডিসিনে ও অর্থনীতিতে তাঁদের মৌলিক অবদান মানবজাতিকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে।
সাহিত্যেও এলফ্রিডে ইয়েলিনেক আমাদের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর গল্প ও নাটকে তিনি যেন স্বর আর প্রতিস্বরের সংগীতের মূর্ছনা তোলেন, সমাজের মুক্তিকামী মানুষ কীভাবে কায়েমি শক্তির কাছে হেরে যায়, তা বর্ণনা করেন, আটপৌরে জীবনের পরাবাস্তবতার ছবি আঁকেন। আর মেইরেড কোরিগান আমাদের শিখিয়েছেন শান্তি প্রতিষ্ঠায় কীভাবে অদম্য হতে হয়।
নারীর কর্মক্ষমতা ও মেধা পুরুষের চেয়ে কম—এমন ভাবনা নারীর ক্ষমতায়নে একটি বড় বাধা। ওপরের ওই উৎকর্ষের গল্প এমন ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে। তারপরও আমরা নারীকে দেখি বন্দী হতে—পিতার কাছে, ভাইয়ের কাছে, স্বামীর কাছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হবে যদি তিনি নিজের কাছেই বন্দী হন। নিজের কাছে বন্দী হওয়ার অর্থ হলো, নারী যদি নিজেই নিজের চেয়ে পুরুষকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। নিজের কাছে বন্দী হলে কেউ তাঁকে মুক্ত করতে পারবে না।
সুখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে নারীবাদী চেতনা ও আন্দোলন অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকার দেশগুলোতে নারীবাদী চেতনার তেমন প্রসার ঘটেনি। তার কারণ বোধ হয় আমাদের একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন, একজন বেগম রোকেয়া ছিলেন, একজন হুমায়ুন আজাদ ছিলেন।
নারীবাদী সাহিত্য আমাদের এখনো অপ্রতুল। কবিতায় তা আরও কম। ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’—নজরুলের মতো এভাবে উচ্চকণ্ঠ হতে আর কোনো কবিকে আমরা দেখি না। বিস্ময় লাগে যখন দেখি মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যে কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতী রাধাকে বলছেন:
‘স্মর-গরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং
দেহি পদপল্লব মুদারং শ্রীরাধে’।
অর্থাৎ ‘কাম-উত্থিত বিষের প্রভাব খণ্ডন করে আমার মস্তক মুণ্ডন করে তোমার পায়ের ধূলি আমাকে দাও।’ নারীই পুরুষকে প্রণাম করবে, তাঁর পদধূলি নেবে—এর বিপরীতে কবি জয়দেব কৃষ্ণকে দিয়ে শ্রীরাধার পদধূলি যাচনা করাচ্ছেন। মধ্যযুগের কবি জয়দেব যা পেরেছিলেন, আমরা আজও তা পারছি না।
লেখক : ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মার্চ ০৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,