ইউক্রেনে হামলার ঘটনায় ইতিমধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক শাস্তি আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। রাশিয়ায় কয়েক শ আন্তর্জাতিক কোম্পানি তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেছে। এসব পদক্ষেপের প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। মৌলিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর দাম বাড়ছে। অনেকে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন।
নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার দৈনন্দিন জীবনযাপনের পদ্ধতি কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। কয়েকজন রুশ নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য প্রতিবেদনে রুশ নাগরিকদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতি
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর প্রথম সপ্তাহে রাশিয়ায় ভোগ্যপণ্যের দাম ২ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। গোপনে জিনিসপত্র মজুত করার অভিযোগ ওঠার পর কিছু কিছু দোকানে প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্য বিক্রির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ওষুধ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। তবে এরপরও বড় শিপিং কোম্পানিগুলো সেবা বন্ধ রাখায় ওষুধ সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর রুশ মুদ্রা রুবলের বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। এতে অনেক খুচরা বিক্রেতা দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
মস্কোর কেন্দ্রস্থলে বসবাস করেন দারিয়া (ছদ্মনাম)। বিবিসিকে তিনি বলেন, এমন কোনো পরিস্থিতি হয়নি যে স্থানীয় দোকানগুলোর তাক খালি হয়ে যাবে।
দারিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘খাদ্যপণ্য শেষ হয়ে যাবে—বিষয়টা এমন নয়, তবে এগুলোর দাম অনেক বেড়ে যাবে। এগুলো কতটা ব্যয়বহুল হবে, তা আমি কল্পনাও করতে পারছি না। এমনকি তা নিয়ে ভাবতেও ভয় পাচ্ছি।’
ইইউভুক্ত দেশের নাগরিক জ্যান থাকেন মস্কোতে। সেখানে কাজ করেন তিনি। জ্যান বলেন, ‘২০ ফেব্রুয়ারি আমি সাড়ে পাঁচ হাজার রুবল (৫৭ ডলার) দামের মুদিদ্রব্য কিনেছিলাম, আর এখন একই পরিমাণ দ্রব্যের দাম আট হাজার রুবলে দাঁড়িয়েছে।’ গত দুই সপ্তাহে দুধের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
এক বছর আগের তুলনায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে চিনি ও খাদ্যশস্যের দাম ইতিমধ্যে ২০ শতাংশ বেশি বেড়েছে। রুশ রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাস বলেছে, কিছুসংখ্যক খুচরা বিক্রেতা কিছু প্রধান খাদ্যদ্রব্যের দাম ৫ শতাংশের বেশি না বাড়ানোর ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন।
কেউ কেউ আবার ময়দা, চিনি ও তেলের মতো মৌলিক খাদ্যদ্রব্যগুলোর দাম ক্রেতাদের সাধ্যের মধ্যে রাখার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
দারিয়া মজুতও করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চার কেজি কফি, চার লিটার সূর্যমুখী তেল, চার লিটার অলিভ অয়েল ও চার বোতল হুইস্কি কিনেছি।’ নিজের উচ্চ রক্তচাপ সামলাতে তিন মাসের জন্য ওষুধও ফরমাশ করে রেখেছেন দারিয়া। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই কিছু ওষুধ হাতে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
শেষ মুহূর্তে বিদেশি পণ্য কিনতে হুড়োহুড়ির মধ্যে কিছু পণ্যের দাম অনেক বাড়তে দেখা গেছে। স্মার্টফোন ও টেলিভিশনের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অ্যাপল, আইকিয়া, নাইকি এখন আর রাশিয়ায় তাদের পণ্য বিক্রি করে না।
দারিয়া তাঁর পরিবারের জন্য নতুন ল্যাপটপ কেনার কথা ভাবছেন। দাম দ্রুত বাড়তে থাকায় তাড়াহুড়ো করে তাঁকে ল্যাপটপ কিনতে হয়েছে। দারিয়া বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির শুরুতে এর দাম প্রায় ৭০ হাজার রুবল (৭৩০ ডলার) ছিল, তবে মাসের শেষে এর দাম ১ লাখ রুবলে পৌঁছে যায়, এ দাম দিয়েই আমরা কিনেছি। এরপর সেটার দাম ১ লাখ ৪০ হাজার রুবলে গিয়ে ঠেকেছিল। পরে মস্কোর সব ল্যাপটপ বিক্রি হয়ে যায়।’
দারিয়া জানান, অনেকে আইফোনের চার্জার কিনতে পারলেও তাঁরা পারেননি। ২ মার্চ অ্যাপল ঘোষণা দিয়েছে, তারা রাশিয়ায় সরাসরি পণ্য বিক্রি স্থগিত রাখবে। দারিয়া বলেন, ‘এখন অনেকে মজা করে বলেন, আমাদের হাতে বোধ হয় এটাই শেষ আইফোন।’
নতুন গাড়ির দামও বেড়েছে। দারিয়া বলেন, ‘গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের কাজে প্রয়োজন হবে ভেবে আমরা ফিল্টার ও তেল কিনে রেখেছিলাম। আমরা পুরোনো দামেই সেগুলো কিনতে পেরেছি। কিন্তু পরে চোখের সামনে সেগুলোর দাম দ্বিগুণ হতে দেখলাম।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পাভেল স্ত্রী, দুই সন্তানসহ মস্কোর একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। নিজেদের ফ্ল্যাটের জন্য কিছু জিনিস কেনার কথা ভাবছিলেন তিনি। তবে যেদিন যুদ্ধ শুরু হয়, সেদিন থেকে কিছু কিছু পণ্যের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। তিনি একটি ফ্রিজ, কুকার, ওয়াশিং মেশিন ও কেটলি কিনতে সক্ষম হন। মস্কোতে আইকিয়ার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক এক দিন আগে একটি খাট ও আলমারি ফরমাশ করেছিলেন। পাভেল মনে করেন, আইকিয়ার দাম অপরিবর্তিত ছিল। কষ্টের মধ্যেও মজা করে পাভেল বলে ওঠেন, ‘সোজাসাপটা করে বলতে গেলে তাঁরা দাম বাড়ানোর সময়ই পাননি।’
রাশিয়ার দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের সারাতোভে থাকেন ভ্লাদিমির। তিনি বলেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এখনো তিনি বুঝতে পারেননি। ভ্লাদিমির বলেন, রুবলের দাম কমে যাওয়ার কারণে ভাতনিকিদের (ক্রেমলিন সমর্থক) ওপর প্রভাব পড়বে না। কারণ, তাঁরা দামি বিদেশি পণ্য কেনেন না।
হারাচ্ছে গ্রাহক, বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান
সুইফট আন্তর্জাতিক লেনদেনের ব্যবস্থা থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ভিসা, মাস্টারকার্ড, আমেরিকান এক্সপ্রেস, অ্যাপল ও গুগল পে রাশিয়ায় তাদের সেবা সীমিত করেছে। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ৮ শতাংশ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সংকোচন হতে পারে।
শরীরচর্চা নিয়ে কাজ করেন নাতাশা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যবসার ওপর বর্তমান পরিস্থিতির বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। গ্রাহকসংখ্যা কমে গেছে। লোকজন আমাদের কাছে ক্লাবের সদস্য হওয়া বাবদ যে অর্থ জমা দিয়েছিলেন, তা ফেরত চাইছেন। জায়গা ভাড়া করা, সরঞ্জাম ও পরিচ্ছন্নতাজনিত খরচ বাড়ছে।’
নাতাশার আশঙ্কা, তাঁর প্রতিষ্ঠানের মতো এমন অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। যেগুলো টিকে থাকবে, তাদেরও আমদানি করা সরঞ্জামের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রাশিয়ায় উৎপাদিত সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে।
বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার কয়েকটি স্কুল পরিচালনা করেন একাতেরিনা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি ইতিমধ্যে সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। একাতেরিনা বলেন, ‘অন্য দেশগুলোতেও আমাদের শিক্ষকেরা আছেন। অর্থ লেনদেনের সব নেটওয়ার্ক জব্দ থাকায় আমরা তাঁদের বেতন দিতে পারছি না। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও লাটভিয়াতেও আমাদের শিক্ষার্থীরা আছে। তারাও আমাদের অ্যাকাউন্টে ফি জমা দিতে পারছে না।’
দারিয়া বলেন, রাশিয়ায় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো কার্যক্রম বন্ধ করায় চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন অনেকে। তিনি বলেন, ‘সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত যে প্রকল্পগুলোতে আমি কাজ করি, সেখানে এখন পর্যন্ত কাউকে ছাঁটাই করা হয়নি। তবে চাকরি হারানো নিয়ে আমি খুবই শঙ্কিত।’
সংবাদমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি
রাশিয়ায় পাস হওয়া নতুন আইনের আওতায় ইউক্রেন হামলা নিয়ে ‘ভুয়া খবর’ প্রকাশ হলে সর্বোচ্চ ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। স্বাধীন ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপরও ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে রাশিয়ায় যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় ১৩ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনকে দায়ী মনে করেন দারিয়া। আবার অনেকে এ জন্য ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী না করলেও চুপচাপ আছেন। তাঁদের আশঙ্কা, সমালোচনা করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
রাশিয়ায় সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নন। তবে সেখানে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বিপর্যয় থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, অভিযান শুরুর পর থেকে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
দারিয়া বলেন, আদতে মস্কোতে কী চলছে, তা বোঝার উপায় নেই। শহরের ক্যাফে ও রেস্তোরাঁগুলো পরিপূর্ণ, ট্রেন চলাচল অব্যাহত, সড়কগুলোতেও যানজটের চিত্র আগের মতোই আছে। দারিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, বিক্ষোভ, তল্লাশি, সৃজনশীল মানুষদের চলে যাওয়া না দেখলে পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ করার উপায় নেই।
দারিয়া মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৯০–এর দশকের স্মৃতিকে ফিরিয়ে এনেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর রাশিয়ার অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। দারিয়া বলেন, ‘ওই সময়ে যাঁদের বয়স ত্রিশের কোঠায় ছিল, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তখন আমাদের খাবারের জন্য রেশন কার্ড দেওয়া হতো। চিনি, মাখন, ভদকা কেনার জন্য আমাদের কুপন ও টোকেন ছিল। আমার মনে আছে, সসেজ কেনার জন্য বিশাল লাইন লেগে যেত। শহরের বাইরের দোকানদারদের কাছে জিনিস বিক্রি নিয়ে প্রায়ই সেখানে উচ্চবাচ্য হতো। এগুলো লজ্জার ছিল। আমি আশা করি, সে পরিস্থিতি আবার ফিরে আসবে না।’
দারিয়ার আশঙ্কা, হঠাৎ দারিদ্র্য বেড়ে গেলে এবং মানুষ চাকরি হারালে চুরি-ডাকাতি বেড়ে যেতে পারে।
আর জ্যান বলেন, রাশিয়ায় জীবনযাপনে খুব বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসতে দেখেননি তিনি। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ারও কোনো পরিকল্পনা নেই তাঁর। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার ও আমার কাজ এখানে। নতুন জায়গায় আবার নতুন করে জীবন শুরু করাটা খুব কঠিন।’
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ১৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,