ইকোনমিস্ট প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, রুশ অর্থনীতি ধসের পূর্বাভাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় এপ্রিল মাসে রাশিয়ার তেল বিক্রি বেড়েছে ৫০ শতাংশ। আর সেই বিক্রি থেকে রাশিয়া মাসে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার কোটি ডলার আয় করছে।
কিছুদিন আগেই খবর আসে, রাশিয়ার তেলবাহী ট্যাংকারগুলো নিজ দেশ থেকে অজানা গন্তব্যের দিকে ছেড়ে যাচ্ছে। মাঝসমুদ্র থেকে ট্যাংকারগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এরা ঠিক হারিয়ে যাচ্ছিল তা নয়, বিষয়টি হলো, ইউরোপীয় দেশগুলো বেনামে রাশিয়ার তেল কিনছিল। কারণটা কারও অজানা নয়, রাশিয়ার তেল ছাড়া তাদের পক্ষে চলা সম্ভব নয়।
ফলে পশ্চিমাদের এত এত অবরোধ সত্ত্বেও যে রুশ অর্থনীতি ধসে যায়নি, তার মূল কারণ এই গোপন তেল–বাণিজ্য। সেই সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায়ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে দেশটি। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও উচ্চ সুদহার কার্যকর করে সমর্থন দেওয়ায় দেশটির মুদ্রা রুবলের পতন ঠেকানো গেছে। শুধু তা–ই নয়, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগের সময়ের মান ফিরে পেয়েছে রুবল। বিদেশি মুদ্রায় বিক্রীত বন্ডের সুদও পরিশোধ করতে পারছে রাশিয়া। দ্য ইকোনমিস্ট প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, রুশ অর্থনীতি ধসের পূর্বাভাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।
যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার ধাক্কায় রুশ মুদ্রা রুবলের ব্যাপক দরপতন হয়। তখন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার পতন ঠেকাতে নীতি সুদহার অনেকটা বৃদ্ধি করে। এতে মুদ্রার দরপতন ঠেকানো সম্ভব হয়। মূল্যস্ফীতিও লাগামছাড়া হয় না। এরপর গত ২৯ এপ্রিল রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ৩ শতাংশ হ্রাস করে।
নিশ্চিতভাবেই আগের তুলনায় সংকুচিত হচ্ছে রাশিয়ার অর্থনীতি। কিছু অর্থনীতিবিদ চলতি বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশের মতো নাটকীয় হারে কমার পূর্বাভাস দিয়েছেন, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় সেটি বাস্তবে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা খুব কমই দেখা যাচ্ছে।
ইউক্রেনের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে রাশিয়া যেমন বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে, তেমনি যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভবানও হয়েছে তারা। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের তুলনায় এপ্রিল মাসে রাশিয়ার তেল বিক্রি বেড়েছে ৫০ শতাংশ। আর সেই বিক্রি থেকে রাশিয়া মাসে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার কোটি ডলার আয় করছে।
এপ্রিল মাসে রাশিয়া দৈনিক গড়ে ৮০ লাখ ১০ হাজার ব্যারেল তেল বিক্রি করেছে। অর্থাৎ যুদ্ধ শুরুর আগে যে পরিস্থিতি ছিল, সেই পর্যায়ে ফিরে গেছে তারা। ভারত ও চীন বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারক, তাদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়ার পোয়াবারো হয়েছে। আর বাজার ধরে রাখতে রাশিয়া আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম দামে তেল বিক্রির প্রস্তাব দিলে ভারত ও চীন তা লুফে নেয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ব্যাপক সমালোচনা করলেও রাশিয়ার তেলে এখনো পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। এখনো ইউরোপ রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তবে ইউরোপের তেল কেনার পরিমাণ অনেকটা কমে গেছে।
অন্যদিকে ফিনল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি ডলারের জীবাশ্ম জ্বালানি জাহাজ ও পাইপলাইনের মাধ্যমে রপ্তানি করেছে মস্কো। ফলে ২০২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে হাইড্রোকার্বন খাত থেকে রুশ সরকারের রাজস্ব বছরওয়ারি হিসাবে ৮০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি
তবে যুদ্ধের প্রভাব যে একেবারে পড়ছে না, তা নয়। এপ্রিল মাসে বার্ষিক হিসাবে রাশিয়ার ভোক্তা মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসের পর যা সর্বোচ্চ। তবে মাসিক হিসাবে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, মার্চ মাসে যা ছিল ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ, এপ্রিল মাসে তা নেমে এসেছে ১ দশমিক ৫৬ শতাংশে। মুদ্রার দরপতনের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি এতটা বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ ছাড়া অনেক পশ্চিমা কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ায় সরবরাহ সীমিত হয়ে পড়েছে। এ সময় দেরিতে কর্মীদের বেতন–ভাতা দিচ্ছে এমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়ছে বলে ধারণা করা হয়। তবে এখন রুবল তার মান ফিরে পাওয়ায় পরিস্থিতির আবারও উত্তরণ হবে বলে আশা করছেন তাঁরা।
এত কিছুর পরও রুশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো অক্ষত আছে। মোট বিদ্যুৎ ব্যবহার কমেছে সামান্যই। মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও রুশ ভোক্তাদের ক্যাফে, পানশালা বা রেস্তোরাঁয় হাত খুলে খরচ করতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যাংক। ফলে ১৫ শতাংশ জিডিপি সংকোচনের যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, বাস্তবে তা না–ও হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মে ১৬, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,