কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ‘হিরো’ বানানো ঠিক নয়
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক বীণা ভেঙ্কাকাটারামান দ্য বোস্টন গ্লোব পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান। গত মে মাসে তিনি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছেন।
২০২০-২১ সালের সব শিক্ষার্থীদের বলছি, তোমরা পেরেছ, অভিনন্দন। বিশ্বাস না হলে নিজেদের চিমটি কাটো। পাশের জনকে কেটো না আবার!
গত এক বছরের মধ্যে এটাই আমার প্রথম কোনো জনসমাগমে আসা। এই এক বছরে একসঙ্গে চারজনের বেশি মানুষের সঙ্গে আমার কোথাও বসা হয়নি। তাই এখানে আসতে পেরে আজ সত্যিই দারুণ লাগছে।
তোমরা আলাদা
মন থেকে বলছি, মহামারির এই কঠিন সময়েও আমি কখনো তোমাদের যোগ্যতা আর ক্ষমতার ওপর থেকে আস্থা হারাইনি। তোমাদের ব্যক্তিগতভাবে হয়তো চিনি না, কিন্তু তোমাদের তারুণ্যের ওপর বরাবরই আমার আস্থা ছিল। যে সময় তোমরা পার করে আজ এ পর্যন্ত এসেছ, এরপর তোমাদের যোগ্যতা নিয়ে কারও মনে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।
নিকট অতীতের অন্য যেকোনো প্রজন্মের চেয়ে তোমরা অনেক বেশি প্রতিবন্ধকতা আর বিপর্যয়ের মোকাবিলা করেছ। প্রতিবন্ধকতা আর বিপর্যয় বলতে আমি বোঝাচ্ছি এই বৈশ্বিক মহামারি আর তোমাদের জীবনের ওপর এর প্রভাবের কথা। তোমাদের সংগ্রাম আর চেষ্টা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে, আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
জীবনের বিগত কয়েকটা বছরের দিকে তাকাও, তাহলেই বুঝবে তোমার মেধা, তোমাদের জ্ঞান, তোমার পরিশ্রম আজ তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আগামী দিনগুলোতেও এরাই হবে তোমার একান্ত সঙ্গী। তবে আমার ব্যক্তি আর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শুধু মেধা আর জ্ঞানই সফল হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে দরকার সাহসের চর্চা করা।
আমার যখন শুরু
প্রায় এক যুগ আগের কথা। আমি তখন দ্য বোস্টন গ্লোব পত্রিকার বার্তাকক্ষের সবচেয়ে অনভিজ্ঞ আর নবিশ সাংবাদিক। আমার চারপাশে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের দেখে আমার ভেতর বিস্ময় আর রোমাঞ্চ কাজ করত। আমি নিজের চেয়ে বেশি তাঁদের কাজের ওপর ভরসা রাখতাম, নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস ছিল অনেক কম।
কিন্তু বার্তাকক্ষের ওই পরিবেশ আমাকে এমন অনুপ্রেরণা দিল, যার জোরে আমি ওই সময়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য সিনেটর প্রয়াত টেড কেনেডিকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখলাম। তিনি তাঁর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে একটা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন। সেটা ছিল আমার প্রতিবেদনের বিষয়। ওই প্রতিবেদন দেখে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাদের পত্রিকার প্রত্যেক বিভাগের সম্পাদককে ফোন করে নালিশ করেছিলেন। যাঁদের তিনি নালিশ করেছিলেন, তাঁদের সবাই আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন, আমি যা লিখেছি তা প্রমাণ করার মতো শক্ত কাগজপত্র আছে কি না। আমি প্রত্যেককে একই জবাব দিয়েছিলাম—‘হ্যাঁ, আছে।’ বলেছিলাম, ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি, প্রতিটি তথ্য যাচাই করেছি, সিনেটরের অফিসে সরাসরি কথা বলেছি, আমার প্রতিবেদনের প্রতিটি তথ্য সত্যি।’ তাঁদের কাছে আসা নালিশগুলো ছিল আমাকে নিছক ভয় দেখানোর পাঁয়তারা।
আর সবার মতো সিনেটর আমাদের পত্রিকার সর্বোচ্চ পদবিতে থাকা সম্পাদক এলেনকেও অভিযোগ জানিয়েছিলেন। এলেনও আমাকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, সিনেটর কেনেডি ভীষণ খেপে আছেন। তিনি জানতে চাইলেন, আমি কি আমার প্রতিবেদনে ভুল কিছু লিখেছি কি না? ততক্ষণে প্রায় ১০ জনের কাছে একই প্রশ্নের জবাব দিয়ে ফেলেছি। তাই নিজেকে আর সংবরণ করতে না পেরে বলে ফেললাম, ‘আপনি কি বুঝতে পারছেন না, এখানে ভুল আমি করিনি, করেছেন সিনেটর নিজে?’
এটা শোনামাত্র এলেন কিছু না বলেই লাইন কেটে দিলেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। তার চেয়েও অবাক হয়ে গেলাম এই ভেবে যে এত উচ্চপর্যায়ের একজন সাংবাদিকের সঙ্গে আমি এমনভাবে কথা বলতে পারলাম! মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম, আজ থেকে তিনি নিশ্চয়ই আমাকে ভীষণ ঘৃণা করবেন। আমার সাংবাদিকতা জীবন বুঝি আর বেশি দিনের হবে না। এরপর থেকে বার্তাকক্ষে আমি এলেনের কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। তবে নিজের কাজটা আমি মন দিয়ে চালিয়ে গেলাম, লেগে থাকলাম প্রভাবশালীদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগের অনুসন্ধানে।
সাহসের খোঁজ
ক্যারিয়ারের ওই একটা ছোট্ট অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। সে সময় আমি উপলব্ধি করেছিলাম নিজের বিশ্বাস আর দক্ষতার ওপর আস্থা রাখা, নিজের জন্য আওয়াজ তোলার গুরুত্ব কত। আমি সাহস খুঁজে পেয়েছিলাম সবার সামনে সত্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের মুখোশ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। আমাকে সাহসী হতে হয়েছে নিজের সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারকে বাঁচানোর জন্য, সেই সঙ্গে সত্য প্রকাশের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য, ভবিষ্যতের জন্য।
ঘটনার ১০ বছর পর সেই সিনিয়র সম্পাদক এলেন—যাঁর সঙ্গে আমি উদ্ধত আচরণ করেছিলাম, যিনি আমার মুখের ওপর ফোন রেখে দিয়েছিলেন—সেই তিনিই আমাকে দ্য বোস্টন গ্লোব পত্রিকার অন্যতম বড় দায়িত্বে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য অফিসে সুপারিশ করেন। তাঁর সহযোগিতাতেই পরবর্তী সময়ে আমি পত্রিকাটির সম্পাদকীয় পাতার সম্পাদকের দায়িত্ব পাই। এমনকি তিনিই আমাকে হোয়াইট হাউসবিষয়ক বড় বড় প্রতিবেদন করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অথচ আমি ভেবেছিলাম, তিনি আমাকে অপছন্দ করেন।
কিছুদিন আগে আমি এলেনকে ওই ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, আমার সাহসিকতা তাঁর ভালো লেগেছিল। আমাকে যখন প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল, তখন আমি যেভাবে সত্যের সঙ্গে ছিলাম, তাতে নাকি এলেন মুগ্ধ হয়েছিলেন। আসলে ওই দিনের পর থেকে তিনি আমাকে সম্মান করতে শুরু করেছিলেন।
সবাই ত্রুটিপূর্ণ
সাহসের চর্চা করতে গিয়ে আমি আরেকটা বিষয় জেনেছিলাম, তা হলো জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ‘হিরো’ বানানো ঠিক নয়। মনে রেখো প্রতিটি মানুষই ত্রুটিপূর্ণ। আজ তুমি যেই শিল্পী, খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা বা সাংবাদিককে তোমার জীবনের ‘হিরো’ ভাবছ, কাল হয়তো দেখা যাবে সে-ই কোনো অন্যায় বা অপশক্তিতে জড়িয়ে পড়েছে। তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস সঞ্চার করা কিন্তু সহজ হবে না। তাই অনুপ্রেরণার জন্য দূরে নয়, নিজের আশপাশের মানুষের দিকে তাকাও। তোমাকে যাঁরা আজ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন, যাঁরা তোমার ওপর আস্থা রেখেছেন, যাঁদের জীবনের সংগ্রাম দেখে বড় হয়েছ—আদর্শ হিসেবে তাঁদের এগিয়ে রাখো। রুপালি পর্দা নয়, হিরো খুঁজে নাও তোমার দৃষ্টিসীমার ভেতর থেকে।
আর সবশেষে বলব, শুধু সমাজ বদলের বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাহস না, বড় স্বপ্ন দেখার সাহস করো। এমন স্বপ্ন দেখো, যা পূরণের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতেও সংশয় হবে না। হ্যাঁ, অনেকেই হয়তো তোমাকে সম্ভব-অসম্ভবের পাঠ দিতে আসবেন। কিন্তু তুমি তাঁদের প্রশ্ন করো, ‘লোকে যা অসম্ভব বলে তা আদৌ কি সম্ভব করা যায় না?’ যখন তাঁরা বলবেন, ‘না।’ তুমি বলো, ‘কেন নয়’, আর দেখিয়ে দাও স্বপ্ন দেখার সাহস তোমার আছে, প্রশ্ন করার সাহস তোমার আছে। আর তাই সব বদলে দেওয়ার সাহসও তোমার আছে।
ইংরেজি থেকে অনুদিত
লেখক: আদর রহমান
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুলাই ১১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,