কেউ বাসা থেকে বা অফিস থেকে বেরিয়েছিলেন। কেউ বাসাতেই স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিলেন। কখনো সাদাপোশাকে, কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক পরিচয় দিয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাঁদের তুলে নিয়ে গেছে। পরে কারও কারও লাশ পাওয়া গেছে, কেউবা ফিরে এসেছেন। অনেকে এখনো নিখোঁজ রয়ে গেছেন।
‘নিখোঁজ’ এসব ব্যক্তির নাম অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস কমিশনের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর গুম হওয়া মানুষের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। এই তালিকায় সাবেক সাংসদ, রাজনীতিক নেতা ও কর্মীদের পাশাপাশি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুস্তক প্রকাশক, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় বক্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তা।
ইসলামী বক্তা আবু ত্ব হা মোহাম্মদ আদনান তাঁর তিন সঙ্গীসহ নিখোঁজ হয়েছিলেন গত ১০ জুন। গত ১৮ জুন তাদের পাওয়া যায় নিজ নিজ বাড়িতে। পুলিশের দাবি আবু ত্ব–হা দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। আর তাঁর সঙ্গে থাকা বাকি তিনজনকে তিনি রাজি করান আত্মগোপনে থাকার সময় বিষয়টি কাউকে না জানানোর। এ সময় ওই তিনজনও নিজ নিজ বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন।
নিখোঁজের পর ফিরে আসলেও নিজ থেকে চার জনের কেউই কী ঘটেছিল এখন পর্যন্ত সে সম্পর্কে কিছুই বলেননি।
একই অবস্থা সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ক্ষেত্রেও। ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর গত বছরের ৩ মে যশোরের বেনাপোলে ভারত সীমান্তের কাছে পাওয়া যায় শফিকুলকে। উদ্ধারের এক বছর পর গত ৩ মে একস ওয়েবিনারে সাংবাদিক শফিকুল বলেন, ‘আমার এখনও এটি বলার সাহস নেই যে আমাকে কি জোর করে গুম করা হয়েছিল, নাকি আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে আমি আক্রমণের শিকার হয়েছিলাম। কিন্তু, কখনোই ভাবিনি যে আমাকে গুম করা হবে।’ ‘কীভাবে আমি ও আমার পরিবার সেই নিষ্ঠুর সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি— তা বলা সম্ভব না।’ তিনি বলেন, কখনো পরিচিতজনদের মাঝে ফিরতে পারবো, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারব এটা ভাবিনি।
অপহরণ, গুম বা নিখোঁজ হন চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সরোয়ার জানান, গত বছর নভেম্বরের ঘটনা এটা। তিনি ওই ওয়েবিনার বলেন, কীভাবে তাকে সারাক্ষণ প্রাণভয়ে থাকতে হতো এবং এক পর্যায়ে তিনি তার চট্টগ্রামের বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হন।’
ওই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছিলেন, ‘এ মুহূর্তে সরোয়ারের জন্য সাংবাদিকতা করার চেয়ে বেঁচে থাকাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুয়ায়ী গত ১৩ বছরে (২০২০ সালের আগষ্ট পর্যন্ত) ৬০৪ জনের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে৷ ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন৷ অন্যরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন তার কোনো তথ্য নাই পরিবারের কাছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও কোনো তথ্য দিতে পারছে না৷
সাম্প্রতিক আবু ত্ব–হার মতো ‘রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ’ বা ‘অপহরণের’ পর গত ১৩ বছরে পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন অনেকেই। এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে কিছু অভিন্ন ছক বা মিল লক্ষ করা যায়। অপহৃত ব্যক্তিদের একটি বড় অংশকে অপহরণের পর ‘উদ্ভ্রান্ত’ অবস্থায় কোনো সড়কে পাওয়া যায়। কিন্তু ফিরে আসার পর অনেকে কোনো কথা মনে করতে পারেন না। বাকিরা ফিরে এসে মুখে কুলুপ আঁটেন। আবার অনেকে বাসায় ফিরে আসেন। তাঁরাও পরে আর কোনো কথা বলেন না।
সাবেক কূটনীতিক মারফ জামান নিখোঁজ হন বছর তিনেক আগে। ফিরে আসার পর তিনিও এ নিয়ে কিছু বলেননি। কারা তুলে নিয়েছেন, কেন নিয়েছেন কিছুই বলেননি তিনি।
রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা কখনো কখনো গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফিরে আসার পর নিখোঁজ ব্যক্তিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলেছেন, চোখ বেঁধে তাঁদের মাইক্রোবাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর বাইরে তাঁরা কেউ আর বিস্তারিত কিছু বলেননি।
নিখোঁজ ও উদ্ধারের একই ছক
১৬ এপ্রিল, ২০১৪ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন। ৩৪ ঘণ্টা পর তাঁকে চোখবাঁধা অবস্থায় কে বা কারা মিরপুরে নামিয়ে দিয়ে যায়। তাঁর পকেটে তিন শ টাকাও গুঁজে দেয় অপহরণকারীরা। তিনি চোখের বাঁধন খুলে প্রথমে রিকশায় করে মিরপুর ১০ নম্বরে, পরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ধানমন্ডিতে যান। ধানমন্ডি কলাবাগান খেলার মাঠের পাশে স্টাফ কোয়ার্টারের কোনায় বসানো পুলিশ চেকপোস্ট তাঁকে আটকায়। পরিচয় জানতে পেরে তাঁকে থানায় নিয়ে যায়।
আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের ঘটনায় ফতুল্লা থানায় মামলা করেন তাঁর স্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তবে ওই মামলার আর কোনো অগ্রগতি নেই।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বনানীতে তাঁদের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে সাদাপোশাকে থাকা পুলিশ তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন তাঁর স্ত্রী মেহের নিগার। পুলিশ সে সময় এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ২১ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর তাঁকে ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
১০ মার্চ ২০১৫ সালে উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ ৬২ দিন পর ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে উদ্ধার হন। ১২ মে তিনি মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল থেকে তাঁর স্ত্রী হাসিনা খানকে ফোন করেন। ভারতীয় পুলিশের বরাতে বলা হয়, মেঘালয়ের গলফ গ্রিন এলাকায় ঘোরাঘুরির সময় পুলিশ তাঁকে আটক করে। সে সময় তাঁকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছিল।
সালাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি নিজে ভারতে আসেননি। যারা তাঁকে অপহরণ করেছিল, তারাই তাঁকে ভারতে রেখে গেছে। তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে চাননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন তানভীর আহমেদ। ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ দিবাগত রাতে তিনি নিখোঁজ হন। পাঁচ দিন পর তাঁকে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় বিমানবন্দর সড়কে হাঁটতে দেখে পুলিশ বাড়ি পৌঁছে দেয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী পুরান ঢাকার আদালতপাড়া থেকে নিখোঁজ হন গত বছরের ৪ আগস্ট। প্রায় সাত মাস অজ্ঞাত স্থানে থাকার পর তিনি বাড়ি ফেরেন।
২০১৬ সালের ১৫ অক্টোবর কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদ রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে, ৩০ নভেম্বর পাবনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী তানভির আহমেদ রংপুর থেকে পাবনা আসার পথে, ১ ডিসেম্বর তানভিরের বন্ধু ও একই মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী জাকির হোসেন পাবনার কলেজ ক্যাম্পাস থেকে এবং বরিশালের চাকরিপ্রার্থী তরুণ মেহেদী হাসান হাওলাদার বনানী থেকে, ৬ ডিসেম্বর ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় রাকিবুল ইসলাম রকি লক্ষ্মীপুর থেকে নিখোঁজ হন। তাঁরা সবাই পরে ফিরে আসেন।
চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদের বাবা নুরুল আলম, পাবনা মেডিকেল কলেজের দুই শিক্ষার্থীর বাবা সুরুজ্জামান ও নুরুল আলম সরকার বলেন, সন্তান ফিরে আসাতেই তাঁরা সন্তুষ্ট। তাঁরা এ নিয়ে আর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করতে চান না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান, পুস্তক প্রকাশক তানভীর ইয়াসিন করিম, সাংবাদিক উৎপল দাস, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান, আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা শামীম আহমেদ, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়ও নিভোঁজ নিয়েছিলেন। মোবাশ্বের হাসান, শামীম আহমেদ ও অনিরুদ্ধ রায় ফিরে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মোবাশ্বার ফিরে আসার পর নিখোঁজের দিনগুলো নিয়ে কিছুই বলেননি। এই শিক্ষক এখন বিদেশে শিক্ষকতা করছেন।
হংকংভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) ও দেশীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আট বছর নয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৯৫ জন নিখোঁজ হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের মধ্য থেকে ৫২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ফিরে এসেছেন ১৯৫ জন। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ১৪৮ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজের সংখ্যা আরও বেশি। এর মধ্যে অনেক ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত বলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা বিভিন্ন সময় অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যে টাকার জন্যও মানুষ গুম ও খুনের ঘটনা আছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা এর বড় উদাহরণ।
সরকারের পক্ষ থেকে মানুষ গুম হওয়ার অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেছেন, গুম বলে কিছু নেই। অনেকে মামলার আসামি, গ্রেপ্তার এড়াতে নিজ থেকে আত্মগোপন করেন। পরিবার তা গুম বলে প্রচার করে।
বড় অংশ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী
গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একটা বড় অংশ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। এর মধ্যে কেবল ঢাকা থেকে গুম হয়েছেন বিএনপির এমন ২৫ জন নেতা-কর্মীর নাম ২০১৭ সালের ১১ জুলাই প্রকাশ করেছে দলটি। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের দাবি, তাদের ২৯ জন নেতা-কর্মী নিখোঁজ আছেন। তালিকা না দিলও বিএনপি বলছে এই সরকারের আমলে ৪০০ নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। তাদের অনেকেই আর ফিরে আসেননি।
এর মধ্যে বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী ও সালাউদ্দিনের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তাঁদের আগে ২০১২ সালের ৩ এপ্রিল রাজধানীর উত্তরা থেকে সাদাপোশাকে একদল লোক সিলেটের ছাত্রদল নেতা ইফতেখার আহমেদ ও জুনেদ আহমেদকে তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে মূলত দেশে গুমের নতুন একটি পর্বের শুরু হয় বলে দাবি করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এই দুজন গুম হওয়ার ঠিক দুই সপ্তাহ পর গুম হন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস আলী। ইফতেখার আহমেদের (দিনার) বোন ও জেলা মহিলা দলের সহসভাপতি তামান্না শামীম ওই সময় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয়, দিনার-জুনেদ ছিল গুম শুরুর মহড়ার অংশ। তারা দেখেছে প্রতিক্রিয়া কী হয়। সবাই ভয়ে চুপসে যাওয়ায় এরপর ইলিয়াস আলীকে গুম করার সাহস পায়।’
২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে, ওই বছরের ২৭ নভেম্বরের পর থেকে ২৪ দিনে গুম হয়েছিলেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ১৯ জন নেতা-কর্মী। তাঁদের মধ্যে ৫ জনকে পরে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। অন্যদের এখনো খোঁজ মেলেনি।
এর মধ্যে লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম ও পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবিরসহ ৩ জনকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে ধরে নেওয়া হয় ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর। তাঁদের মধ্যে সাইফুল ও হুমায়ুনকে আর পাওয়া যায়নি।
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তেজগাঁও থানার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলামসহ ৬ জনকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। একই দিন রাজধানীর শাহীনবাগের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আরও ২ জনকে।
নির্বাচনের আগে-পরে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মী গুমের ঘটনা ঘটলেও গত আট বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কমপক্ষে ৬ জন গুম হন। এ ছাড়া গুম হয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা মোহাম্মদ আলী মহব্বত। পরে মহব্বতের খোঁজ পাওয়া যায়।
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) পরিচয়ে ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ নেতা মাহফুজুর রহমানকে তাঁর স্ত্রী ও মায়ের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন মাস চার দিন পরে তাঁকে ঢাকার নিউমার্কেট থানায় একটি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
২০১৪ সালে কুমিল্লার মুন্সেফ কোয়ার্টারের বাসা থেকে বাবা-মা-স্ত্রীর সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় যুবলীগ নেতা রকিবুল ইসলামকে। তাঁর বাবা আবদুল মতিন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেহরক্ষী ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রকিবুলের মা ছেলের শোকে এখন প্রায় মানসিক ভারসাম্যহীন।
২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোয়াজ্জেম হোসেনকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয় দিয়ে একদল লোক। এখনো তাঁর সন্ধান পায়নি পরিবার।
‘নিখোঁজ’ জনপ্রতিনিধি
২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৬ জন জনপ্রতিনিধি ‘নিখোঁজ’ হন। এই তালিকার শুরুতেই আছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম। তিনি ২০১০ সালের ২৫ জুন নিখোঁজ হন। এরপর যে ৪ জন জনপ্রতিনিধি নিখোঁজ হন, তাঁদের ৩ জন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা হলেন বেনাপোল পৌরসভার প্যানেল মেয়র তরিকুল আলম (২০১৩ নিখোঁজ) এবং সিদ্ধিরগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম (২০১৪)। এ বছরের সেপ্টেম্বরে জামালপুরের সরিষাবাড়ী থেকে নিখোঁজ মেয়র রুকনুজ্জামান রুকন ঢাকার উত্তরা থেকে নিখোঁজ হন। দুদিন পর শ্রীমঙ্গল থেকে উদ্ধার হন তিনি।
আরও যাঁরা গুমের শিকার
চাঞ্চল্যকর খুনের তদন্ত চলাকালীন কমপক্ষে ৪ জন নিখোঁজ ছিলেন। ২০১১ সালে আহসান উল্লাহ মাস্টার খুনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ জামাল আহমেদ নিখোঁজ হন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুনের ঘটনায় স্কলাসটিকা স্কুলের শিক্ষক তানভীর রহমান ২০১২ সালের ১ অক্টোবর নিখোঁজ হন। আট দিন পর জানানো হয় তানভীরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান (তনু) খুন হওয়ার সাত দিন পর বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মিজানুর রহমান নামের এক তরুণকে। ওই তরুণ ছিলেন তনুর ভাই আনোয়ার হোসেনের বন্ধু। দুই সপ্তাহ পর চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম খুনের ঘটনার প্রধান আসামি কামরুল শিকদার (মুসা) নিখোঁজ আছেন। তাঁর স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, মুসাকে গুম করা হয়েছে।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০০৯-১৭ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গুম হয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও জঙ্গিবাদে সংশ্লিতার অভিযোগ আছেন এমন ব্যক্তিরা। তার বাইরে রাজনৈতিক নেতাদের গাড়িচালক, শ্রমিকনেতা থেকে শুরু করে পোশাকশিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যাংক কর্মকর্তা, চিকিৎসক, আইনজীবী, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, এনজিও কর্মকর্তাও রয়েছেন।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুন ১৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,