মার্চ মাসের শুরুতে, ১৮৩৭ সাল। পুশকিন মারা গেছেন।
… সবচেয়ে খারাপ খবরটা কখনোই রাশিয়া থেকে আসতে পারে না। আমার জীবনের অনাবিল সময়গুলো, সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তগুলো তাঁর সাথে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাঁর উপদেশ ছাড়া আমি কিছুই হাতে নিই নাই, একটা লাইন পর্যন্ত লিখি নাই তাঁর মুখ কল্পনা করা ছাড়া। তিনি কী বলবেন, কী মন্তব্য করবেন, কী দেখে হাসবেন, আর কী দেখেই বা প্রশংসা করবেন – এইসব চিন্তা সবসময় আমার মনের ভেতর গিজগিজ করতো, আমার ক্ষমতাকে নাচিয়ে তুলতো। কেঁপে কেঁপে ওঠা এক রহস্যময় আত্মতৃপ্তিতে আমার মনটা ভরে উঠতো, মনে হতো এইরকম তৃপ্তির জায়গা এই দুনিয়া নয়… ঈশ্বর, আমার এখনকার কাজগুলো তাঁর থেকেই অনুপ্রাণিত, তাঁর লেখালেখি থেকেই উদ্দীপ্ত…আর শক্তি নাই আমার এগুলো চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার। বহুবার কলম হাতে তুলে নিয়েছি, খসে পড়েছে বার বার… [মার্চ ১৬, ১৮৩৭, প্লেতনেভের কাছে লেখা চিঠি]
…আমার জীবন আর আমার পরম সুখের মুহূর্তগুলো পুশকিনের সাথে মরে গেছে। আমার জীবনের সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল আনন্দময় মুহূর্তগুলো ছিলো লেখার মুহূর্ত, সৃষ্টির মুহূর্ত। যখন সৃষ্টি করতাম, পুশকিনকে দেখতাম আমার সামনে, দাঁড়িয়ে। যত আঘাত আসছে, পরোয়া করি নাই; ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের দাঙ্গাবাজ মাস্তানদের উড়িয়ে দিয়েছি, একমাত্র প্রিয় ছিলো পুশকিনের চিরন্তন সেই অখণ্ডনীয় অকাট্য শব্দগুলো। কিছুই শুরু করি নাই নিজে নিজে, একটা শব্দও লিখি নাই তাঁর উপদেশ ছাড়া। আমার ভিতরে যতটুকু ভালোর অস্তিত্ব আছে তার জন্য আমি পুশকিনের কাছে ঋণী। এমনকি আমার এই সময়ের সৃষ্টিগুলোও তাঁর সৃষ্টি। তিনি আমাকে লেখার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন; আমিও তার অবয়ব চোখের সামনে না দেখে কিছুই লিখতাম না। আমি এই চিন্তা করে আকুল হতাম যে তিনি কতটুকু তৃপ্তি পাবেন, আর এটাই ছিলো আমার সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার। আমার জন্য এখন কোন পুরস্কার অপেক্ষা করে আছে! আমি এখন কী করবো? আমার এই জীবনটার এখন কী হবে? [মার্চ ৩০, ১৮৩৭, পোগোদিনের কাছে লেখা চিঠি]
Evenings of Dikanka’ প্রসঙ্গে, পোগোদিনের কাছে লেখা চিঠি :
…ছেড়ে দাও ওইসব, শয়তান নিয়া যাক্! আমি ওইগুলা ছাপাবো না (দ্বিতীয় এডিশনের জন্য); যদিও এইসব থেকে পাওয়া টাকাপয়সা যে খুব একটা অনর্থক আমার জন্য তা না, কিন্তু আমি এখনও এইসব কারণে লিখতে পারি না, অথবা পারি না নতুন নতুন রূপকথা বানাইতে। লেখালেখির মানোন্নোয়নের জন্য নিত্য নতুন ফন্দি ফিকির আঁটা আমার ধাতে নাই, এইসব ব্যাপারে আমার ট্যালেন্ট জিরো। আমি আসলে ভুইলাই গেছিলাম যে আমি এইসব লেখাগুলো লিখছিলাম একদিন, তুমি আমারে আবার মনে করাইয়া দিলা… দোয়া করি যেন এইসব লেখারে সবাই গাইলাইয়া অচেতনেরও বেহুঁশ অবস্থায় পাঠাইয়া দেয় যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার ভিতর হইতে ভারী ওজনবিশিষ্ট, গুরুত্বপূর্ণ, সৃজনশীল কিছু না বাইর হয়। কিন্তু এর জন্য তো আমি আমার নিষ্ক্রিয়তার মধ্যেই থাকবো, আমার জড়তার মধ্যে বাঁচতেই থাকবো – আমি তুচ্ছ নগণ্য জিনিস চাই না, আর আমি মহান কিছু চিন্তাও করতে পারতেছি না … [ফেব্রুয়ারি ১, ১৮৩৩]
চাচার কাছে লেখা চিঠি :
…অনেক অনেক দিন ধরে, অবুঝ ছোটবেলার সেই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো থেকে আমি সতেজ এক উদ্দীপনায় ধীরে ধীরে নিজেকে জ্বালিয়েছি; জ্বলেছি নিজের এই জীবনটাকে রাষ্ট্রের কোন একটা কাজে লাগাতে। আমার আকুল আকাঙ্ক্ষা ছিলো আমি যদি সামান্যতম কাজেও আসতে পারি এই দেশের তবে আমি সার্থক… নিজের ভিতরে গুনগুন করে চিন্তা করেছি আমার জন্য কোন শ্রেণীর কাজ, কিংবা কোন সরকারি চাকুরিটা উপযুক্ত। এক জায়গায় এসে মন স্থির হয়েছিলো – ভেবেছিলাম আইন নিয়ে আমার কাজ হলে ভালো। আমি দেখলাম এখানেই আমার অনেক কিছু করার আছে, এখানেই আমি দেশের জন্য কিছু সুফল নিয়ে আসতে পারি, এখানেই আমি মানবতার একটা কাজে অন্তত আসতে পারি… আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম অন্তত কিছু ভালো কাজ না করে জীবনের একটা মুহূর্তও নষ্ট করবো না… আমার এই অভিজাত পরিকল্পনা কি কখনও বাস্তবায়িত হবে? নাকি অস্পষ্ট ব্যাপারগুলো বিষণ্ণ মেঘের আড়ালে নিজেকে পুঁতে ফেলবে? এখনকার এই সময়গুলোতে আমি আমার আদিকালিক সেই চিন্তাভাবনাগুলোকে নিজের ভেতরে লুকিয়ে ফেলেছি। সবাইকে সন্দেহ করে নিজের গোপণ কথাগুলো কাউকে বলি নি, গোপণপ্রিয়তায় ডুবে গেছি, মনের গভীরতা প্রকাশ হয় এমন কিছু কখনও করি নি। কারণ আমি কাকে বিশ্বাস করবো? কীসের জন্য আমি আমার মনের কথা সবাইকে বলবো? যেন সবাই আমার পাগলামি দেখে হাসাহাসি করে তার জন্য? নাকি তাদের এইটা ভাবানোর জন্য যে এই ব্যাটা একটা অতিশয় কল্পনাবিলাসী ভাবুক, একজন ফাঁপা অন্তঃসারশূন্য মানুষ?… [অক্টোবর ৩, ১৮২৭]
মায়ের কাছে লেখা চিঠি :
…তুমি যতটা ভাবো তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্টের আর ঝামেলার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে; বাড়িতে থাকার সময় আমি ইচ্ছে করেই অনেক বেশি পেইন নিয়েছি নিজেকে অস্থির অবাধ্য ইত্যাদি প্রমাণ করতে, যেন তুমি এই দেখে ভাবো যে আমার বুঝজ্ঞান বেশি নাই…। কিন্তু আমার মনে হয় না আর কেউ আমার মতন এত অকৃতজ্ঞতা, অবিচার, ফালতু গাধামিমার্কা চাহিদা আর অবজ্ঞা সহ্য করেছে। আমি একটা শব্দ না করে, মনের ভেতরে কোন বিড়বিড়ানি ক্ষোভ ছাড়া সবকিছু মেনে নিয়েছি; কেউ আমার কাছ থেকে কখনও কোন নালিশ বা অসন্তোষ শোনে নাই; যারা আমার দুঃখকষ্টের জন্য দায়ী আমি উলটা তাদের গুণকীর্তন করেছি, তারিফ করেছি। আমি আসলে সবার কাছে একটা বিভ্রান্তিকর মানুষ, একটা ধাঁধাঁর মতন; কেউ আমাকে পুরাপুরি বুঝতে পারে নাই কখনও। বাড়িতে আমি ছিলাম একটা একগুঁয়ে কঠোর ক্লান্তিকর মানুষ যে নিজেকে অন্য সবার থেকে অনেক চালাক ভাবতো, আর ভাবতো, সমগ্র মনুষ্যজাতি থেকে তাকে একটু আলাদা করে তৈরী করা হয়েছে। তুমি কি বিশ্বাস করবে যে ভেতরে ভেতরে আমি নিজেকে নিয়ে হাসাহাসি করতাম তোমাদের সাথেই? এখানে লোকজন আমাকে নম্র বিনয়ের অবতার এক আদর্শ ধৈর্য্যশীল মানুষ ভাবে। এক জায়গায় আমি সবচেয়ে চুপচাপ, সবচেয়ে বিনয়ী; অন্যখানে আমি চাপাচাপা রাগী, ক্ষমাহীন, চিন্তামগ্ন, বিষণ্ণ, আনপলিশ্ড্ লোক; কখনও কখনও আমি খুব চালাক, কখনও কখনও একদম বোকা। যখন আমার আসল জীবন শুরু হবে তখন তুমি আমার সত্যিকারের চরিত্র সম্পর্কে ধারণা পাবে। [মার্চ ১, ১৮২৮]
সূত্র: সংগৃহিত
তারিখ: অক্টোবর ২১, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,