সেতু উড়িয়ে দিয়ে রাশিয়ার সেনাদের স্থলপথে অগ্রযাত্রা ঠেকানোর চেষ্টা করছেন ইউক্রেনের সেনারা। যুদ্ধের শুরুর দিকে দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও রুখে দিয়েছে রুশ যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র। আবার দেশে-বিদেশে সমর্থন পাচ্ছেন ইউক্রেনের সেনারা। ফলে শক্তিশালী রুশ বাহিনী অভিযান শুরুর নবম দিন গতকাল শুক্রবারও ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। যদিও পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো বলছে, ইতিমধ্যে কিয়েভের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে রাশিয়ার বিশাল সেনাবহর।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনে রুশ বাহিনী প্রত্যাশার তুলনায় যে কঠোর বাধার মুখে পড়েছে, তাতে চলমান যুদ্ধে মস্কোর চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন বিলম্বিত হতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। ইউক্রেনের যোদ্ধারা রাশিয়ার সর্বাত্মক আক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহার করছেন কাঁধে বহনযোগ্য ছোট আকারের ট্যাংকবিধ্বংসী লঞ্চার। ধারণা করা হয়েছিল, যুদ্ধ শুরুর অল্প কয়েক দিনের মধ্যে কিয়েভ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ইউক্রেনের সেনারা ছোট ছোট অস্ত্র ব্যবহার করে এখন পর্যন্ত সেটি ঠেকিয়ে রেখেছেন।
তবে গত বুধবার ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর খেরসন পুরোপুরি দখলে নিয়েছে রুশ বাহিনী। এই বাহিনী কিয়েভ ও অন্যান্য শহরে বোমা হামলা জোরদার করেছে। এর বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে ইউক্রেন সরকার আরও অস্ত্র দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউক্রেনের সেনাদের আপাতসফলতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ারম্যান অব দ্য জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল মার্ক এ মিলে বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেন খুব দক্ষ ও ছোট ছোট প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করেছে। বাহিনীর সদস্যরা নিজ ভূখণ্ড সম্পর্কে ভালোমতো জানেন। তাঁরা ছোট অস্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারছেন। ফলে বিভিন্ন স্থানে রুশ বাহিনীকে রুখে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, ইউক্রেনের সেনারা রুশ সামরিক অগ্রযাত্রা সাময়িক ঠেকাতে পারলেও, দীর্ঘ মেয়াদে এ অর্জন ধরে রাখতে পারবেন না। এর মধ্যে ইউক্রেনের অধিবাসীরা এমন একটি জাতিতে পরিণত হচ্ছেন, যাঁদের হাতে হাতে অস্ত্র রয়েছে। এ বিষয়ে ইউরোপে সাবেক শীর্ষ মার্কিন সেনা কমান্ডার ও সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি অ্যানালাইসিসের বিশ্লেষক ফ্রেডেরিক বি. হজেস বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আপনি যা ভেবেছেন, সব সময় তা না-ও ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে যে পক্ষ দ্রুত শিখতে পারবে, আত্মস্থ করতে পারবে, সে জিতবে। ইউক্রেন দ্রুত শিখছে।’
চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনের হাজারো প্রশিক্ষিত বেসামরিক ব্যক্তি যুক্ত হয়েছেন। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল ও পূর্ব ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলের রুশপন্থী যোদ্ধাদের ক্রেমলিন সমর্থন দেওয়ার পর থেকেই বেসামরিক ব্যক্তিদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে ইউক্রেন। লক্ষ্য ছিল, রাশিয়ার আক্রমণের মুখে তাঁদের আত্মরক্ষা ও দেশরক্ষায় আগাম প্রস্তুত করে তোলা। এ ছাড়া ইউরোপের যেসব দেশের সেনাবাহিনীর আকার বেশ বড়, তার একটি ইউক্রেন। দেশটির সেনাবাহিনীতে রয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার নিয়মিত সেনা, লাখখানেক রিজার্ভ সেনা ও প্রায় ১ লাখ অভিজ্ঞ প্রতিরক্ষা ফোর্স।
২০১৪ সালের পর থেকে গত ৮ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল অপারেশনস ফোর্স ইউক্রেনের ২৭ হাজারের বেশি সেনাকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব সেনা নিচের স্তরের সেনাসদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁরাই এখন ইউক্রেনের সেনা ইউনিটগুলো পরিচালনা করছেন। এমনকি ২০১৪ সালের পর ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সমর বিশ্লেষকদের কারও কারও মতে, এসব প্রশিক্ষণ চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনকে রুশ সেনাদের ঠেকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে।
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গ গত বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে সাংবাদিকদের বলেন, ইউক্রেনের সেনারা নিজেদের ভূমি রক্ষা করতে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্রেমলিন ও বিভিন্ন দেশের সমর বিশেষজ্ঞদের ধারণার চেয়ে বেশি সময় রুশ সেনাদের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছেন তাঁরা।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ হামলার পর ইউক্রেনের ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক নাগরিকেরা নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। শুক্রবার দেশটির রাজধানী কিয়েভে
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ হামলার পর ইউক্রেনের ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক নাগরিকেরা নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। শুক্রবার দেশটির রাজধানী কিয়েভে
কিয়েভসহ শহরগুলোর সুরক্ষা ও শহরের উপকণ্ঠে চলমান লড়াইয়ে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বেশ দক্ষতা দেখিয়েছে, এমনটাই মনে করছেন সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনআইর রাশিয়া স্টাডিজ বিভাগের পরিচালক মাইকেল কফম্যান। আর সমর কৌশলবিদ ফ্রেডেরিক ডব্লিউ কাগান বলেন, রুশ সেনারা সীমান্ত পেরানোর আগেই ইউক্রেনের সেনারা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান নিতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে তাঁরা দ্রুত অবস্থান বদল ও পাল্টা আক্রমণের সুবিধা পেয়েছেন।
অন্যদিকে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান জেনসের বিশ্লেষক থমাস বুলোকের মতে, রুশ সেনারা ইউক্রেনের শুধু প্রধান সড়কগুলোতে চলাচল করছেন। তাঁরা আঞ্চলিক সড়কগুলোতে বা কাদামাটিতে নামার ঝুঁকি নিচ্ছেন না। তাই তাঁদের বহর ও রসদ সরবরাহের পথ ইউক্রেনের সেনাদের হামলার সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। মূলত এ কারণে এখন পর্যন্ত রুশ সেনাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন থেকে বিরত রাখতে পেরেছে ইউক্রেন।
এ পরিস্থিতিতে মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করছেন, যুদ্ধে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হামলা জোরদার করতে পারেন। তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, চলমান যুদ্ধে রুশ পক্ষে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জেরে রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হওয়া ও ইউক্রেনে একটি স্থায়ী বিদ্রোহ জিইয়ে থাকার আশঙ্কা পুতিনের সমর কৌশলে পরিবর্তন আনতে পারে।
****অনুবাদ (সংক্ষেপিত) করেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ মার্চ ০১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,