লেখক: আবদুল্লাহ জাহিদ
নিউইয়র্ক টাইমসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। প্রথম সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কবি জয়েস কিলমার। তিনি সে সময় নিউইয়র্ক টাইমসের স্টাফ রিপোর্টার ছিলেন। নিয়মিত বুক রিভিউ লিখতেন। তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা হলো ‘ট্রি’ (Tree)। তাঁর জন্ম ১৮৮৬ সালে, নিউজার্সিতে। ১৯১৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর নেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালের ১০ অক্টোবর।
সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে প্রশ্ন ছিল—কবির সঠিক কাজটি কি তাঁর অনুগামীদের নির্দেশনা দেওয়া বা ব্যাখ্যা করা? উত্তরটি গীতাঞ্জলি এবং চিত্রার রচয়িতা লেখকের কাব্যিক ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
জবাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘কবির যথাযথ কাজ তাঁর অনুগামীদের নির্দেশনা বা ব্যাখ্যা দেওয়া নয় বরং সংগীতের পরিপূর্ণতায় তাঁর জীবনে যে সত্য এসেছে তা প্রকাশ করা।’
জয়েস কিলমার লেখেন, রবীন্দ্রনাথ কয়েক সপ্তাহ আগে সিয়াটল এসে পৌঁছেছেন এবং এখন তিনি পূর্বের পথে। বিভিন্ন প্রধান শহরে তিনি বক্তৃতা করবেন এবং তাঁর সম্মানে আয়োজিত অভ্যর্থনায় অংশ নেবেন। নভেম্বর মাসে তিনি নিউইয়র্কে ফিরবেন। তিনি লম্বা রাজপুষোচিত, তাঁর মুখে কিছুটা হুইটম্যানের আদল পাওয়া যায়। তাঁর চুল লম্বা, দাঁড়ি সাদা হয়ে আসছে যা তাঁর গাঢ় চামড়ার সঙ্গে লক্ষণীয় ভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সাধারণত তিনি দেশীয় পোশাক পরিধান করেন। এমনকি ইউরোপীয় পোশাকেও তিনি একটি সূক্ষ্ম তবে প্রাচ্যিও ভাব বজায় রাখেন। তবুও তিনি এই অর্থে একচেটিয়া প্রাচ্য কবি নন, উদাহরণস্বরূপ মিসেস সরোজিনী নাইডু শুধু প্রাচ্য কেন্দ্রিক। তিনি অনেকটা সময় ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন এবং ইউরোপীয় সাহিত্যের রূপান্তরের সঙ্গে পরিচিত। সমালোচকেরা তাঁর কবিতায় স্পষ্ট ওয়াল্ট হুইটম্যান এবং ফরাসি ও ইংরেজি লেখকদের প্রভাবের প্রমাণ খুঁজে পান। স্যার রবীন্দ্রনাথ ১৯১২ সালে এই দেশ ভ্রমণ করেন, তখন শুধু কিছু ছাত্র যারা পূর্বের ভাষা জানতেন তাঁরাই তাঁর কবিতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ১৯১৩ সালের গ্রীষ্মে মি. উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, মি. উইলিয়াম রথেনস্টেন এবং আরও কিছু ইংরেজ লেখক ও শিল্পী তাঁর সম্মানে লন্ডনে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। একই বছর নভেম্বরে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান এবং তাঁর একাধিক বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ ‘বেস্ট সেলার’ তালিকায় স্থান পেয়েছে। তিনি বাংলায় লেখেন এবং ইংরেজিতে অমিত্রাক্ষর ছন্দে তা অনুবাদ করেন।
ঠাকুর ভারতের একটি বিখ্যাত পরিবার। কবির পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন মহান ধর্মীয় গুরু। তাঁকে ডাকা হতো মহর্ষি। কবির পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন একজন দানবীর ও সমাজ সংগঠক এবং একজন জমিদার। অন্যান্য ঠাকুরদের মধ্যে প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, আইন এবং শিক্ষাবিষয়ক লেখক, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিখ্যাত চিত্রকর, মহারাজা রমানাথ ঠাকুর একজন বিশিষ্ট লেখক ও রাজনৈতিক নেতা।
রবীন্দ্রনাথ যখন বালক, তখন তাঁর পিতা তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে হিমালয়ে নিয়ে তাঁকে প্রকৃতি প্রভাবে শিক্ষা দেন। তিনি নিজে তাঁর কবি সন্তানকে ইংরেজি, সংস্কৃত, বাংলা, বোটানি এবং জ্যোতির্বিদ্যার শিক্ষা দেন। ১১ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে গঙ্গার ধারে চন্দ্রানগরে থাকতে হয়, যেখানে তিনি ছয় বছর থাকেন এবং ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের ওপর শিক্ষা লাভ করেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি ইংরেজি শিখতে এবং ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে জানতে ইউরোপে যান।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন বহুমুখী কর্ম শক্তিসম্পন্ন স্থিরমতি লেখক। যিনি একাধারে কবিতা ও গীত রচনা করেছেন, নাটক এবং ছোট গল্প লিখেছেন, চারটি সাময়িকী যথা সাধনা, বঙ্গদর্শন, ভারতী এবং তত্ত্ববোধনি সম্পাদনা করেছেন। ভারতী সাময়িকীটি এখন সম্পাদনা করেন তাঁর ভগিনী শ্রীমতী স্বর্ণা কুমারী দেবী। তাঁর ভক্তরা মনে করেন, তিনি গভীর দার্শনিক। তিনি বোলপুরে বালকদের একটি বিদ্যালয় পরিচালনা করেন যেখানে ভিন্ন পদ্ধতিতে পড়ানো হয়। সেখানে বেশির ভাগ ক্লাস আম্রকুঞ্জে হয়। বিদ্যালয়টির নাম হলো ‘শান্তিনিকেতন’ যার অর্থ হলো ‘শান্তির আবাস।’
ড. কুমারাস্বামীর মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈষ্ণব কবিদের ঘরানার অন্তর্ভুক্ত যা বহু শতাব্দী ধরে অস্তিত্ব প্রাপ্ত ছিল। অন্য ভারতীয় কবিদের চেয়ে তাঁর সুবিধা রয়েছে যে, তাঁর কবিতা ইউরোপীয় স্বাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। ভারতে কবিতার প্রশংসা ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি। এটি একটি ছোট সংস্কৃতির চেনাজানা গোষ্ঠীর দ্বারা বা এর জন্য লিখিত নয়; এটি প্রতিটি ছোট্ট গ্রামে প্রতিদিন উচ্চ স্বরে পড়া হয়। বিছানায় যাওয়ার আগে গ্রামবাসীরা মাটিতে বসে তাদের জাতি প্রার্থনাগুলো গানের সুর করে গায়। তাই আমি কবি ও সমাজের সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি বিষয়ে স্যার রবীন্দ্রনাথের মতামত পেতে আগ্রহী ছিলাম।
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর মতে কোনো কবির জীবনধারণের জন্য কী তাঁর লেখার ওপর নির্ভর করা উচিত নাকি বাঁচার জন্য অন্য কোনো উপায়ের সাহায্য নেওয়া উচিত। তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন—কবি এবং শিল্পীদের তাঁদের কাজকে সত্য করে তুলতে পর্যাপ্ত অবসর প্রয়োজন, তাঁদের ভাবনাগুলো তাঁদের কাছ থেকে নিখুঁত মনোযোগ দাবি করে। সুতরাং জীবিকার প্রয়োজনে তাঁদের নিজস্ব সৃষ্টি থেকে যেকোনো বিচ্যুতি বিপর্যয়কর। অন্যদিকে কবিদের যদি সর্বসাধারণের অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করতে হয় যারা সর্বদা শিল্পের নতুন সৃষ্টির সেরা বিচারক নন এটিও মন্দ-তবে তা দুটির মধ্যে কম মন্দ।
এরপর জিজ্ঞেস করলাম, প্রাচ্যে পাশ্চাত্যের চেয়ে কবিতার বেশি সমাদর রয়েছে। তার কারণ কী? রবীন্দ্রনাথ উত্তরে বলেন, ‘প্রাচ্যে কবিতার প্রশংসা অধিকতর, এর সাধারণ কারণ পূর্ব দেশগুলোতে কবিতা হলো সঠিক মাধ্যম, যার মাধ্যমে মানুষের গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয় এবং প্রচারিত হয়।
আমি বললাম, তবে এটি সত্য যে, কথাটি কিছু পশ্চিমা লেখকের কবিতার ক্ষেত্রেও খাটে। তাঁদের কবিতাতেও পূর্বের চিন্তার প্রকাশ ঘটে। সে সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়? কবি বললেন—‘পশ্চিমের সব মহান কবিরা তাঁদের মেজাজ ও চিন্তার কিছু দিক নিয়ে পূর্বের সঙ্গে তাঁদের অনুরাগ দেখান। যেমন মহান পূর্ব কবিরা পশ্চিমাদের সঙ্গে তাঁদের অনুরাগ ব্যক্ত করেন। বৃহৎ কিছু করতে হলে সর্বজনীন হতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা গভীর ভাবে আমেরিকার উপলব্ধি দিয়ে লেখা। যা পূর্বের ধারণা এবং অনুভূতি দ্বারা আবদ্ধ। শেলীর ‘Hymn to Intellectual Beauty’ এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতির কবিতাগুলো কী পূর্বের চেতনালব্ধ নয়?’
আমি বললাম, স্যার রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যের আত্মা এবং পাশ্চাত্যের আত্মার মধ্যে কী কোনো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে? যদি থাকে তবে এই পার্থক্যটি কীভাবে সাহিত্যে প্রদর্শিত হয়?
রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন—‘আমি বিশ্বাস করতে পারি না, প্রাচ্যের আত্মা এবং পাশ্চাত্যের আত্মা আলাদা। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে, যেমন এর ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে একই ব্যক্তিদের মধ্যে তা ঘটতে পারে। আমরা পূর্বে আমাদের জীবনের সব ভার ঈশ্বরের ওপর দিয়ে থাকি। যিনি সব বিস্তারের কেন্দ্র, যদিও পশ্চিমা দেশগুলোতে ঈশ্বর পরিপূরক সত্য হিসেবে আসেন বা আদৌ আসেন না।’
স্যার রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ইউরোপীয় এবং আমেরিকার কবিতা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত। তাই তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছি, আধুনিক পশ্চিমা কবি প্রধানত প্রাচ্যের কাছ থেকে কী শিখতে পারেন। এর উত্তরে তিনি পাশ্চাত্য কবিতাকেই সেই গুণগুলোর জন্য কৃতিত্ব দিয়েছিলেন যা প্রাচ্যের কবিরা শিখছেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘প্রাচ্যের আধুনিক কবিরা পশ্চিমের কবিদের কাছ থেকে আবেগময় প্রাণবন্ত সাহিত্যের মূল্য শিখছেন যার মধ্যে রয়েছি বিজয়ের আনন্দ, গতি এবং শক্তি। পশ্চিমের কবি প্রাচ্যের কাছ থেকে শিখতে পারেন ভক্তিপূর্ণ আনন্দের পরিপূর্ণ দর্শন, যার মধ্য আছে শান্তির গভীরতা।’
এই প্রশ্নের প্রথম অংশটির উত্তরে স্যার রবীন্দ্রনাথ কবির বিশ্বজনীনতার ইঙ্গিত দেন, যা প্রমাণ দেয় পাশ্চাত্যের চিন্তাকে ধারণ করতে তিনি প্রস্তুত। তিনি কিছু সময়ের জন্য লন্ডনের বাসিন্দা ছিলেন, যেখানে কবি ও শিল্পীদের মধ্যে তাঁর অনেক বন্ধু রয়েছে এবং তিনি সেখানে আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনের সংস্পর্শে ছিলেন। যারা মূলত মুক্ত ছন্দে কবিতা লেখার আন্দোলন করছিলেন, যাদের ফরাসি ভাষায় বলা হয় vers libre and imagisme।
তাঁকে (রবীন্দ্রনাথ) জিজ্ঞেস করলাম, এই মুক্ত ছন্দে কবিতা লেখা ইংরেজি কবিতাকে ভারতীয় কবিতার কাছে নিয়ে যাচ্ছে নাকি দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। উত্তরে তিনি বললেন—‘আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান যুগে বিভিন্ন সাহিত্যে একে অপরের জন্য দরজা খুলে দেওয়ায় মুক্ত ছন্দে কবিতা আন্দোলন জরুরি হয়ে পড়েছে। কঠিন ছন্দে কবিতা লেখা খুবই একচেটিয়া একটি বিষয়; গদ্য ছন্দের কবিতা অনেক বেশি উদার এবং অতিথিপরায়ণ।’
সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই জীবিত কবিদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত। বাংলায় সবাই তাঁকে ‘রবি বাবু’ বলে ডাকেন এবং তাঁর গান ভীষণ জনপ্রিয়। উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের ভাষায়, ‘আমার জানা মতে, এখন পর্যন্ত কোনো ইংরেজ কবি রবীন্দ্রনাথের মতো উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি।’
মি. ইয়েটস এবং অনুরূপ উৎসাহীরা ভারতীয় কবিকে এক মহান রহস্যময় এবং আধ্যাত্মিক চিন্তার নেতা হিসেবে বিশ্বাস করেন। তবে তাঁর কাজের নিরপেক্ষ পাঠ থেকে এবং তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়, তিনি শুধু একজন দার্শনিক অথবা ধর্মীয় নেতা নন, পশ্চিমা চিন্তার তীব্র ধারকসহ পড়ালেখা জানা অসাধারণ উজ্জীবিত একজন মানুষ। (চলবে)
সূত্র : প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,