সমাজের অন্য সব ক্ষেত্রের মতো ব্যবসা-বাণিজ্যেও নারীরা ব্রাত্য। সে জন্য অর্থনীতিবিদেরা সব সময়ই বলে আসছেন, নারীর ঋণপ্রাপ্তির পথ সহজ করতে হবে। তবে ভারতের শীর্ষ নারী ধনী ফাল্গুনী নায়ার মনে করেন, নারীদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, বিনিয়োগ আসবে–যাবে, সে জন্য মূল শক্তি হলো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা।
নারীদের প্রতি ফাল্গুনীর পরামর্শ হলো, নিজের স্বপ্ন দেখা বা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করার জন্য অপরাধবোধে ভোগার প্রয়োজন নেই। ঠিক সেই জায়গা থেকেই তিনি কোম্পানির নাম রেখেছেন নাইকা। নিজের মতো করে বাঁচার অনুপ্রেরণা অর্থে। ভারতীয় সমাজে নারীরা দীর্ঘদিন পরিবারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। নীরবে-নিভৃতে চোখের পানি ফেলেছে। তারা ভেবেছে, নিজেদের মতো জীবন যাপন করতে গেলে পরিবারের অনেক ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাতে সবকিছু বেনো জলে ভেসে যাওয়ার উপক্রম হতে পারে। তিনি মনে করেন, নারীদের এ ভীতি ও লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে।
সম্প্রতি ফরচুন ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘২০২১ সালে আমার যা অর্জন, তার সূত্রপাত ২০১২ সালে, যখন তিনি চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় আসেন। আমি পরিবারের পুঁজি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভারতের অধিকাংশ নারী পরিবারের পুঁজি ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে চান না। অথচ পুরুষেরা হামেশাই স্ত্রী ও মায়ের গয়না বিক্রি করে বা জমানো টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।’
তবে সবাইকে যে পরিবারের পুঁজি ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে হবে, তা মনে করেন না ফাল্গুনী। তাঁর মত, এ পুঁজি বিনিয়োগ করতে হলে অবশ্যই ঝুঁকি সহ্য করার মতো আর্থিক ভিত থাকতে হবে। ৪৯ বছর বয়সে ব্যবসা শুরু করা ফাল্গুনী অবশ্য সেদিক থেকে অনেক শক্তিশালী ভিত নিয়েই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তিনি নিজে যেমন প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবী ছিলেন, তেমনি তাঁর স্বামীও ছিল বেসরকারি ইক্যুইটি প্রতিষ্ঠান কেকেআর ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী।
ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকারের দায়িত্বপূর্ণ পদ ছেড়ে ফাল্গুনী নায়ার ২০১২ সালে যখন ফ্যাশন ও সৌন্দর্যপণ্যের অনলাইন বিপণি তৈরি করেছিলেন, তখন ভারতে ই-কমার্স সদ্য জনপ্রিয় হচ্ছে। সেগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ৯ বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে পা রাখে ফাল্গুনী নায়ারের সংস্থা এফএসএন ই-কমার্স ভেঞ্চার। বস্তুত, তাঁর দুই শাখা সংস্থা নাইকা ও নাইকা ফ্যাশনই বহুল পরিচিত।
এ মুহূর্তে সফল বলা হলেও শুরুর দিকে ভারতের বাজারে নাইকার অগ্রগতি প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিল অনেকের। প্রসাধনসামগ্রী কিনতে ভারতের মধ্যবিত্ত নারীরা ছুটতেন পাড়ার দোকানে। লিপস্টিক বা স্ক্র্যাব কেনার আগে তা পরখ না করে দেখার প্রশ্নই নেই। তবে কনে সাজানোর প্রসাধনী হোক বা সাধারণের ব্যবহারের আইলাইনার—সবকিছুর ব্যবহারই ভিডিওর মাধ্যমে দেখানোর বন্দোবস্ত আছে নাইকায়। ফলে অনেকেই অনলাইনে প্রসাধনী কেনার দিকে ঝুঁকেছেন। ভারতীয় নারীদের ত্বকের রঙের সঙ্গে রং মিলিয়ে বাজারে ছাড়া হয়েছে অসংখ্য শেডের লিপস্টিক, নেইলপলিশ কিংবা কনে সাজানোর প্রসাধনী।
২০২১ সালের তাঁর ব্যবসায়িক অর্জনের মূল কারণ হলো, শেয়ারবাজারে অসাধারণ এক অভিষেক। প্রথম দিনেই তাঁর কোম্পানির শেয়ার সম্পদের মূল্য ১ লাখ কোটি রুপির গণ্ডি পেরিয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, নাইকাই ভারতের প্রথম নারী পরিচালিত ইউনিকর্ন স্টার্টআপ (শেয়ারমূল্য ১০০ কোটি ডলার বা বেশি), যেটি বাজারে নথিভুক্ত হলো। আর শেয়ারদরের হাত ধরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে উঠে আসা মহিলা কোটিপতিদের তালিকায় ফাল্গুনীর স্থান হলো একেবারে প্রথম সারিতে। যেখানে রয়েছেন বায়োকনের কিরণ মজুমদার শ, বাইজুসের দিব্যা গোকুলনাথ।
বাজারে প্রথম শেয়ার ছাড়ার সময়ে (আইপিও) ফাল্গুনীর সংস্থার শেয়ারের দাম ঠিক হয়েছিল ১ হাজার ১২৫ রুপি। তা কিনতে আবেদন জমা পড়েছিল আইপিওর আকারের ৮২ গুণ। বাজারে নথিভুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সেই দর পার করে ২০০১ টাকা। দিনের শেষে দাম দাঁড়ায় ২ হাজার ২০৬.৭০ টাকা। অর্থাৎ, শুরুর দামের চেয়ে ৯৬ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি। শেয়ার সম্পদ হয় ১ লাখ ৪ হাজার ৪৩৮ দশমিক ৮৮ কোটি রুপি। পারিবারিক ট্রাস্টের মাধ্যমে কোম্পানির প্রায় অর্ধেক অংশীদারি ফাল্গুনীরই হাতে। ফলে শেয়ারমূল্যের হাত ধরে ফাল্গুনীর নিজের সম্পদ শুক্রবার রাতে ৫৪০ কোটি মার্কিন ডলার, ফোর্বস–এর হিসাব অনুযায়ী। তাঁর দুই ছেলেমেয়েও কোম্পানির অন্যতম প্রমোটার।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ২১, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,