বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি নৈতিক, সামাজিক এবং বস্তুগত ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে কাঙ্ক্ষিত ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার দিকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?
আমার দৃঢ়বিশ্বাস, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং তার প্রয়োগ যে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে, তার মাধ্যমে এই ভারসাম্য কিছুতেই সম্ভব হবে না। বরং এর মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলো আরও প্রকট হয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল এবং অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে।
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালেই পরিষ্কার হয়ে উঠবে যে এটা আসলে নৈর্ব্যক্তিক একটা শোষণযন্ত্র। এর কাজ হলো নিচ থেকে রস শুষে অনবরত ওপরের দিকে পাঠাতে থাকা। বহু স্তরে বিন্যস্ত এই যন্ত্র ধাপে ধাপে নিচের স্তরের রস তার ওপরের স্তরে পাঠায়। এর সর্বনিম্ন স্তরটি সবচেয়ে বিশাল। সেখানে অসংখ্য কর্মী নিরলসভাবে বিন্দু বিন্দু করে রস তৈরি করে। তার ওপরের স্তরটিতে তুলনামূলকভাবে অনেক কম মানুষ, কিন্তু যন্ত্রে তাদের অবস্থানের কারণে শক্তিতে তারা অনেক বলবান। তাই তারা নিচের সংগ্রহ করা রস অনায়াসে নিজের কাছে টেনে নেয়। ওপরে যারা আছে, তারা খারাপ মানুষ হওয়ার কারণে এটা হচ্ছে, তা নয়। যন্ত্রের কারণেই মূলত এটা হচ্ছে। যন্ত্রটাই এভাবে বানানো হয়েছে। স্তরে স্তরে সাজানো মানুষগুলো নিচের স্তরের রস ওপরে টেনে নিয়ে নিচ্ছে তাদের শক্তির কারণে। এতে কেউ দোষের কিছু দেখে না, বরং ধরে নেয় যে এটাই জগতের নিয়ম। অথচ বিষয়টি জগতের নিয়ম নয়। কিছু পণ্ডিত বসে এ রকম একটা শাস্ত্র তৈরি করে সবাইকে বিশ্বাস করিয়ে দিয়েছে যে ‘এটাই জগতের নিয়ম; এ নিয়ম মেনে চললে সবার জন্য মঙ্গল।’
প্রতিটি স্তরে মানুষের সংখ্যা তার আসন্ন নিচের স্তরের মানুষের সংখ্যা থেকে অনেক কম। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের আয়ত্তে রসের পরিমাণ হতে থাকবে নিচের স্তরের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্তরে থাকবে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ মাত্র। কিন্তু তাদের আয়ত্তে এত রস সংগৃহীত থাকবে যে নিচের দিকের অর্ধেক স্তরে জমানো সব রস একত্র করলেও এই পরিমাণ রসের সমান হবে না। এর জন্য কাউকে আমরা দোষী বলতে পারছি না, কারণ শাস্ত্রে বলে দেওয়া আছে এমনটিই হওয়ার কথা। এতেই সবার মঙ্গল। বলা বাহুল্য, কোনো নৈতিক বা সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ যন্ত্র তৈরি হয়নি। এ যন্ত্র মূলত তৈরি হয়েছে অর্থনীতির চাকাকে সব সময় সচল রাখার জন্য। সব সময় চোখ রাখা হয়েছে কখনো যেন অর্থনীতির চাকা কোনো চোরাবালিতে আটকে না যায়। শাস্ত্রে নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের নানা অবতারণা থাকলেও বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই। বাস্তবে তার নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে পরিণত হয়েছে। সমাজ নিয়ে যারা চিন্তা করে, তারা মাঝেমধ্যে এটা স্মরণ করিয়ে দিলে এটা নিয়ে কিছু উদ্যোগ আয়োজনের কথা বলাবলি হয়, কিন্তু দ্রুত সবাই এসব কথা ভুলে যায়। যেহেতু যন্ত্রের গাঁথুনিতে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি, কাজেই এসব কখনো যন্ত্রের কার্যক্রমের সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
যেমন ধরুন শেয়ারবাজারের কথা। বর্তমান জগতের ব্যবসার সাফল্যের মাত্রা নির্ধারণে শেয়ারবাজারের মূল্যায়নই চূড়ান্ত। কারা ব্যবসা ভালো করছে, কারা ব্যবসাকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গিয়ে পৌঁছাতে পারছে—সব বিষয়ে রায় দিচ্ছে শেয়ারবাজার। এই মূল্যায়নে কোথাও কোনো নৈতিক বিচারের মাপকাঠি কিংবা সামাজিক বিচারের মাপকাঠি ব্যবহার হয় না। কাজেই ব্যবসার প্রধান নির্বাহীর দৃষ্টিতে এসব বিষয় পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক এবং বাড়তি ঝামেলা। উপায়ান্তর না দেখে সরকার এগিয়ে আসে নিচের মানুষকে কিছু স্বস্তি দেওয়ার জন্য। সরকার ওপরের স্তর থেকে রস সংগ্রহ করে নিচের স্তরে বিলি করে তাদেরকে করুণ অবস্থা থেকে রেহাই দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যন্ত্রের কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলতে থাকে।
এ যন্ত্রকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছি বলে যন্ত্রটা সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা আমাদের করেছে, সেটা হলো, আমরা সবাই আমাদের অজান্তে অর্থলোভী কলের পুতুলে পরিণত হয়ে গেছি। জীবনে অর্থ জমিয়ে নিচের স্তর থেকে ওপরের স্তরে যাওয়ার সাধনা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার আছে বলে আর মনে থাকে না। আমরা এটা জেনেই চমৎকৃত যে, যে যত ওপরের স্তরে যেতে পারবে, যন্ত্রের গঠনের কারণে সে তত অল্প আয়াসে, অনেক বেশি গুণ রস সংগ্রহ করার ক্ষমতা অর্জন করবে। এমনকি সে বসে থাকলেও যন্ত্র তাকে ক্রমাগত রস জুগিয়ে দিতে থাকবে।
সামাজিক ব্যবসা
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যেটি মৌলিক গলদ বলে আমি মনে করি, সেটি হলো এমন একটি কাল্পনিক মানুষকে কেন্দ্র করে সব শাস্ত্রটিকে সাজানো হয়েছে, যার সঙ্গে রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে বড় রকমের পার্থক্য রয়ে গেছে। শাস্ত্রবিদেরা হয়তো নির্দোষ সরলীকরণ মনে করে এ কাজটি করেছেন। কিন্তু সেটা শাস্ত্রকে এবং এই শাস্ত্র অনুসরণকারী পুরো বিশ্বকে, মহাবিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শাস্ত্রবিদেরা ধরে নিয়েছেন, অর্থনৈতিক জগতে যে মানুষ বিচরণ করে, সে হলো শতভাগ স্বার্থপর জীব। স্বার্থপরতা ছাড়া সে আর কিছুই বোঝে না। আমি মনে করি যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি আমরা করেছি, তার মূলে রয়েছে মানুষের এই খণ্ডিত রূপকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র রচনা।
অর্থনৈতিক শাস্ত্রে স্বার্থপর মানুষের জায়গায় আমি এমন একটি মানুষকে প্রতিস্থাপন করতে চাইছি, যিনি একই সঙ্গে স্বার্থপর ও স্বার্থহীন। কারণ, প্রকৃত মানুষ এই দুয়ের সংমিশ্রণ। কে কত স্বার্থপরভাবে এবং কত স্বার্থহীনভাবে কাজ করবে, তা নির্ভর করবে ওই ব্যক্তির বেড়ে ওঠার ওপর, তার সমাজসচেতনার ওপর, তার শিক্ষার ওপর, তার নৈতিক বিচার-বিবেচনার ওপর। একই মানুষ স্থায়ীভাবে, কিংবা সাময়িকভাবে, কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে প্রচণ্ড স্বার্থপর হতে পারে, অথবা দিলদরিয়া স্বার্থহীন হতে পারে, অথবা একই সঙ্গে দুয়ের সংমিশ্রণ হতে পারে। এ ধরনের মানুষকে কেন্দ্র করে শাস্ত্র রচনা করতে হলে আমাদের দুই ধরনের ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যখন মানুষ তার স্বার্থপরতাকে প্রকাশ করতে চায় এবং প্রয়োগ করতে চায়, তখন সে সর্বোচ্চ মুনাফাকারী হিসেবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। যখন স্বার্থহীন হতে চায়, তখন সে এমন ব্যবসা করবে, যাতে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জন করার কোনো ইচ্ছাই তার মধ্যে কাজ করবে না; তার একমাত্র লক্ষ্য হবে ব্যবসায়িক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সমাজের সমস্যার সমাধান করা। আমি এ ব্যবসার নাম দিয়েছি ‘সামাজিক ব্যবসা’। এ ধরনের ব্যবসা থেকে মালিক তার বিনিয়োগ করা মূলধন ফেরত নেওয়া ছাড়া আর কোনো অর্থ মুনাফা হিসেবে নিতে পারবে না। এ ধরনের এই নতুন মানুষকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক শাস্ত্র রচনা করলে সে শাস্ত্রে দুই ধরনের ব্যবসার ব্যবস্থা রাখতেই হবে। একটা হবে ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা, আরেকটি হবে সামাজিক ব্যবসা। তার ফলে সব পরিস্থিতিতে সব মানুষের কাছে দুটি বিকল্প থাকবে। এই বিকল্প না থাকার কারণেই আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভুল পথে ধাবিত হচ্ছি এবং প্রচণ্ড সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি।
প্রচলিত অর্থনৈতিক শাস্ত্রে ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসার বাইরে ব্যবসার কোনো ক্ষেত্র নেই। অর্থাৎ স্বার্থপর হওয়া ছাড়া ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই। স্বার্থহীনভাবে কিছু করতে চাইলে দানখয়রাতের জগতে প্রবেশ করতে হয়। দাতব্য কর্মকাণ্ডে সমাজের অবহেলিত মানুষের অনেক উপকার হয়। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড বরাবর পরমুখাপেক্ষী থেকে যায়। আত্মনির্ভর হওয়ার কোনো সুযোগ এদের থাকে না। কারণ, সব সময় নতুন নতুন অর্থ সংগ্রহ করে দাতব্য কর্মকাণ্ডকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। একবার কাজে লাগালে দানের টাকা খরচ হয়ে যায়। দানের টাকা ফেরত আসে না। সামাজিক ব্যবসা যেহেতু ব্যবসা, সে কারণে টাকাটা ফিরে আসে। একই টাকাকে বারবার ব্যবহার করে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যায়। সামাজিক ব্যবসাকে নিজস্ব ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা যায়। সমাজের যত সমস্যা আছে, সবকিছুর সমাধান সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করা যায়।
ব্যক্তিগত মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য জনশক্তি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা অাছে। এগুলোকে বলা হয় বিজনেস স্কুল। এ শিক্ষায়তন থেকে শিক্ষা নিয়ে তরুণ ব্যবসাযোদ্ধারা বের হয়ে আসে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন বাজার জয় করার জন্য আর কোম্পানির মালিকদের জন্য বেশি মুনাফা অর্জনের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। সামাজিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিজনেস স্কুলে পৃথক বিশেষায়িত শিক্ষার প্রয়োজন হবে। এ শিক্ষা নিয়ে তরুণেরা সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধানের লড়াইয়ে নামবে। দুই ব্যবসার দুই রকমের দক্ষতার প্রয়োজন। এক ক্ষেত্রে লাগবে মালিকদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য সব কলাকৌশল আয়ত্ত করা, অন্য ক্ষেত্রে লাগবে ব্যবসায়িক পদ্ধতিতে সামাজিক সমস্যা দ্রুত সমাধানের দক্ষতা অর্জন করা।
আয়বৈষম্য
আয়বৈষম্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া পুঁজিবাদী কাঠামোতে অবিচ্ছেদ্যভাবে গ্রথিত আছে। তার ওপর যে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন গড়ে উঠেছে, তা এই আয়বৈষম্য বৃদ্ধি আরও জোরদার করে দিয়েছে। পুঁজি, ঋণ, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, শিক্ষা—সবকিছুর প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ভাগ্যবানদের পক্ষে। ভাগ্যহীনদের জন্য সব দরজা বন্ধ। তাদের পক্ষে এসব দরজা খোলা প্রায় অসম্ভব। কাজেই মানুষে মানুষে আয়বৈষম্য বেড়েই চলবে। যে যন্ত্র ক্রমাগতভাবে নিচ থেকে রস সংগ্রহ করে ওপরে চালান দেওয়ার কাজে নিয়োজিত, সে যন্ত্র কখনো ওপর-নিচের আয়ের ব্যবধান
ঘুচাতে পারবে না। আয়বৈষম্য আমাদের এখন কোথায় নিয়ে এসেছে, সেটা দেখলেই পরিস্থিতি বোঝা যাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে
ধনী ৮৫ জন মানুষের কাছে যে সম্পদ আছে, তার পরিমাণ আয়ের দিক থেকে নিচে আছে পৃথিবীর এমন অর্ধেক মানুষ, অর্থাৎ ৩৫০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের যোগফলের চেয়ে বেশি। অন্যভাবে তাকালেও একই দৃশ্য দেখা যাবে। আয়ের দিক থেকে ওপরে আছে পৃথিবীতে এমন অর্ধেক মানুষের কাছে আছে পৃথিবীর মোট সম্পদের ৯৯ শতাংশ। অর্থাৎ নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের কাছে আছে পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র ১ শতাংশ। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কি এ অবস্থার উন্নতি হবে? না, হবে না। কারণ, অর্থনৈতিক যন্ত্রটিকে কাজ দেওয়া হয়েছে ওপরওয়ালাকে আরও রস জোগান দেওয়া। নিচের রস ওপরের দিকে যেতেই থাকবে। আয়বৈষম্য বাড়তেই থাকবে। নিচতলার মানুষের মাথাপিছু যে প্রবৃদ্ধি হবে, ওপরতলার মানুষের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি যে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে, এটা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। সামাজিক ব্যবসা নিচ থেকে ওপরে রস চালান দেওয়ার গতিটা কমাবে। পুঁজি, ঋণ, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনকে সামাজিক ব্যবসা একেবারে নিচের তলার লোকের কাছে সহজলভ্য করে দিতে পারে। এর ফলে তাদের সম্পদ ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে। ওপরের তলার অফুরন্ত সম্পদের অংশ সামাজিক ব্যবসায় নিয়োজিত হলে তাদের আরও সম্পদশালী হওয়ার প্রবণতা কমবে। সামাজিক ব্যবসার পরিমাণ যদি ব্যক্তিগত মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবসার চেয়ে বেশি হতে আরম্ভ করে, তাহলে যত না নিচের রস ওপরে যাবে, তার চেয়ে বেশি ওপরের রস নিচে আসতে শুরু করবে।
সামাজিক ব্যবসা তাত্ত্বিক কাঠামোতে একটা উল্টো যন্ত্র স্থাপন করছে। ওপরের রস নিচে আনার যন্ত্র। ব্যবসায়িক ভিত্তিতেই একই মার্কেটে দুই যন্ত্র কাজ করবে। কোন যন্ত্রটির জোর বেশি হবে, সেটা নির্ভর করবে আমরা কী চাই, তার ওপর। সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে, যন্ত্রের হাতে নয়। আমরা আমাদের পছন্দের যন্ত্রটা নিয়ে কাজ করব। বর্তমানে যন্ত্র একটাই। কাজেই এখানে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত কাজে লাগে না। যন্ত্রই সিদ্ধান্ত স্থির করে দিয়েছে। আমাদেরকে বলা হচ্ছে যে এটাই একমাত্র এবং সর্বোত্তম যন্ত্র। আমরা সে কথা বিশ্বাস করে কলের পুতুলের মতো এ যন্ত্র ব্যবহার করে তথাকথিত ‘সাফল্যের’ পেছনে যথাসাধ্য দৌড়াচ্ছি। আমাদের একটু থেমে নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে, আমরা কি নিজের ইচ্ছাসম্পন্ন সৃজনশীল মানুষ হব, নাকি কলের পুতুল হব? মানুষের প্রতি মানুষের ঔদাসীন্য জয়ী হবে, নাকি মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা জয়ী হবে? যন্ত্র জয়ী হবে, নাকি মানুষ জয়ী হবে?
বর্তমান যন্ত্র মানুষের প্রতি মানুষের ঔদাসীন্য এবং অবজ্ঞাকে সামাজিক স্বীকৃতি ও সমর্থন দিয়ে তাকে প্রশ্নাতীত করে রেখেছে। স্বার্থপরতাকে একমাত্র গুণ ধরে নিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকে অর্থনৈতিক সাফল্যের মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ বা স্বার্থপরতার একচ্ছত্রবাদ থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যহীনতা, পরিবেশদূষণ—কিছু থেকেই বের হওয়া যাবে না। অর্থনীতিকে আবিষ্কার করতে হবে যে পৃথিবীতে ‘আমি’ ছাড়া আরও মানুষ আছে, আরও প্রাণী আছে। সবার সমবেত ভবিষ্যৎই ‘আমার’ ভবিষ্যৎ। ‘আমাদের’ ভবিষ্যৎই ‘আমার’ ভবিষ্যৎ। (চলবে)
লেখক: ড. মুহাম্মদ ইউনূস: শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: নভেম্বর ১৮, ২০১৪
রেটিং করুনঃ ,