বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিভিন্নভাবে বড় অঙ্কের অর্থ যুক্তরাজ্য, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হয়ে গেছে। দেশের ১১ ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা টাকা তুলতে পারছেন না। ফলে এসব ব্যাংক তারল্য–সংকটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন টাকা ছাপিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে কিনা এমন প্রশ্ন ওঠে। তবে টাকা ছাপানোর ব্যাপারে বরাবরই একই বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে গভর্নর বলেন, ‘আমরা টাকা ছাপাবো না। তার মানে হচ্ছে, আমরা যদি টাকা ছাপিয়ে সব ব্যাংকের সব টাকা শোধ করতে যাই তাহলে আমাদের লক্ষ কোটি টাকা ছাপাতে হবে বা আরও বেশি। সেটা কাম্য নয়। যাদের লিক্যুডিটি শর্টেজ আছে, ব্যাংকিং খাতের লিক্যুডিটি দিয়েই ইনোভেটিভ ওয়েতে তাদের লিক্যুইডিটি সাপ্লাই করবো।’
এর আগেও গত ৫ সেপ্টেম্বর ব্যাংকার্স সভায় গভর্নর বলেন, ‘ব্যাংক খাত থেকে বিভিন্নভাবে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে গেছে। মূলত সাত-আটটি ব্যাংক থেকে এই অর্থ বের হয়েছে। এসব ব্যাংক তারল্য–সংকটে পড়েছে। আমরা আগের মতো টাকা ছাপিয়ে এসব ব্যাংকে দেব না। এটি করতে হলে দুই লাখ কোটি টাকা ছাপাতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম—সবকিছু ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যাবে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা তারল্য–সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে সীমিত আকারে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এসব ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংক থেকে টাকা আমানত হিসেবে পাবে, এতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়তা (গ্যারান্টি) দেবে।’
এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার তথ্য গোপন করে ৬২ দিনে সরকারকে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেন। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, নতুন ঋণ না নিয়ে ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা আগের দায় সমন্বয় করেছে সরকার। সাবেক গভর্নরের স্বেচ্ছাচারিতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা মুখ খুলতে না পারলেও সরকার পরিবর্তনের পর তথ্য গোপন করে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়ার কথা এখন প্রকাশ পাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো টাকার স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৭ কোটি। চলতি বছর জুনে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ২১ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। চলতি বছর জানুয়ারি-জুন সময়ে ৪৩ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা ছাপানো হয়, যার প্রায় পুরোটাই সরকারকে দেওয়া হয়।
গত বছরের মাঝামাঝি ‘ইসলামি’ ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে পুরো খাতেই তারল্য সংকট দেখা দেয়। এস আলম, সালমান এফ রহমান প্রমুখ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর বিপুল পরিমাণে বেআইনি ঋণগ্রহণের কারণে অন্তত ১০টি ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। পরিস্থিতি সামলাতে সরকারের বিশেষ নির্দেশে ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সহায়তায় বেআইনিভাবে অর্থায়ন করা হয় ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে। এর প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে পড়েছে।
আগামী ছয়-সাত মাসে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হলে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আগের মতো টাকা ছাপিয়ে সরকার বা কোনো ব্যাংককে অর্থ দেওয়া হবে না। তবে আর্থিক খাতে ভারসাম্য আনতে দুভাবে সহযোগিতা করা হবে। প্রথমত, কৃষি ও শিল্প খাতের জন্য সব কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে এবং দ্বিতীয়ত, মনিটারি পলিসিকে টাইট ফিস্টে রাখা হবে।
নিয়মিত মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করার কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে, এটা অস্বীকার করে লাভ নেই। যথাযথ নীতি প্রণয়নের জন্য প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত দরকার।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রথমত, অনেক সময় সরকারের অর্থ সংকুলানের জন্য টাকা ছাপানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কোনো কোনো ব্যাংকে তারল্য সংকট হয়েছে, তাদেরও টাকা ছাপিয়ে অর্থায়ন করা হয়েছে। এর ফলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা থাকে না। এর প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের বেশি টাকা দরকার হচ্ছে। এর ফলে নগদ টাকা হাতে রেখে মানুষ সাংসারিক ব্যয় মেটাচ্ছে। সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, তার ব্যয় যাতে আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। যাতে টাকা ছাপিয়ে অর্থায়ন করতে না হয়।’
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক।
তারিখ: সেপ্টম্বর ০৯, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,