ছোট্ট জনের বৈষয়িক জ্ঞান যে বেশ ভালো, টের পেতেন মা এলিজা। তারপরও টার্কি পালন করে, বন্ধুদের কাছে চকলেট বিক্রি করে আর প্রতিবেশীদের কাজ করে দিয়ে ওইটুকুন ছেলে যখন ৫০ ডলার জমিয়ে ফেলল, বেশ অবাক হন তিনি। যে সময়ের কথা বলছি, ৫০ ডলার একেবারে হেলাফেলা অর্থ নয়। ১৭০ বছরেরও বেশি আগের কথা। ওই ৫০ ডলারের মূল্য এখনকার সময়ে দেড় হাজারের ডলারের সমান। বাংলাদেশি টাকায় যা ১ লাখ ২৭ হাজার টাকার মতো। একসময় এলাকার এক দরিদ্র কৃষককে ওই অর্থ ধার দিতে ছেলেকে অনুরোধ করেন এলিজা। জনের বয়স তখন মাত্র ১২। মায়ের কথা শুনে ওই কৃষককে অর্থ ধার দেয় জন। তবে সঙ্গে শর্ত জুড়ে দেয় ছোট্ট ছেলেটি। ওই অর্থ খাটিয়ে যে মুনাফা আসবে, তার ৭ শতাংশ তাকে দিতে হবে। ওই কৃষক এক বছর পর তাকে মুনাফাসহ ডলার ফিরিয়ে দেন।
গল্পের এই জনের পুরো নাম জন ডাভিসন রকফেলার। তিনি হলেন মার্কিন ইতিহাসের প্রথম শতকোটিপতি, অর্থাৎ বিলিয়নিয়ার। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল আজকের দিনের হিসাবেই প্রায় ৪০ হাজার কোটি ডলার। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে রকফেলার বিশ্বাস করতেন, ‘অর্থের জন্য কাজ করার চেয়ে অর্থকে কাজ করানোই ভালো।’
১৯১৬ সালে ১০ কোটি জনসংখ্যার যুক্তরাষ্ট্রে পুরোপুরি নিজের চেষ্টায় প্রথম শতকোটিপতি হন জন রকফেলার। বিশ্বের সব সম্পদশালীরই ধনী হওয়ার পথ পাড়ি দেওয়ার গল্পটা আলাদা আলাদা। আসলে সফলদের জীবনের ছোট ছোট গল্পই এক একটা পরামর্শ।
১. নিজের মনকে অনুসরণ করুন
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ উবার কীভাবে এসেছিল, জানেন? ২০০৮ সালে প্যারিসের রাস্তায় কোনো পরিবহন পাচ্ছিলেন না এক তরুণ। বহুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আর সেই ঘটনায় কানাডার তরুণ উদ্যোক্তা গ্যারেট ক্যাম্পকে এই রাইড শেয়ারিং অ্যাপ তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে। বর্তমানে ফোর্বস–এর শতকোটিপতির তালিকায় নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। অনলাইনে তথ্য সংরক্ষণ করার অনন্য সেবা ড্রপবক্স—এর নাম তো অনেকেরই জানা। এটি তৈরির গল্পও মজার। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) দুই স্নাতক শিক্ষার্থী ড্রিউ হিউস্টন ও আরাশ ফেরদৌসী ২০০৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি তৈরির অন্যতম কারণ ছিল তাঁরা প্রায়ই তাঁদের তথ্য সংরক্ষণ করার ইউএসবি পোর্ট নিতে ভুলে যেতেন। ১৯৯০ সালে যখন প্রথম ‘হ্যারি পটার’ গল্পের ধারণা পান জে কে রাউলিং, তখন তার বয়স ২৫। চার ঘণ্টা দেরি হওয়া একটি ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত রাউলিং সেদিন স্টেশনে বসেই প্রথম ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের লেখা শুরু করেন।
২. বড় স্বপ্ন দেখতে হবে
১৯ বছর বয়সেই বিল গেটস বুঝতে পেরেছিলেন, ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবসা, শিক্ষা, যোগাযোগ ও বিনোদনে বিপ্লব আনতে পারে—যদি এর পরিচালনা বা অপারেশন সহজ করা যায়। এমনভাবে করতে হবে যেন প্রত্যেকে তা ব্যবহার করতে পারেন। আর এটিই তাঁর মাইক্রোসফট তৈরির পেছনে অন্যতম প্রেরণা হয়ে কাজ করে। বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসও। কম ব্যয়ে ভার্চ্যুয়ালি খুচরা পণ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিষেবা দেওয়ার স্বপ্ন।
বিল গেটস
৩. সাফল্যের প্রতি সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ
ব্যবসায়ী ও উদ্ভাবক হিসেবে সফল ক্যারিয়ার গড়েন মার্কিন ব্যক্তিত্ব মার্ক কুবান। তিনি একাধারে ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ‘ম্যাগলোনিয়া পিকচার্স’, পেশাদার বাস্কেটবল টিম ‘ড্যালাস মেভারিক্স’ ও যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় চেইন সিনেমা হল ‘ল্যান্ডমার্ক থিয়েটারস’-এর মালিক; এইচডিটিভি কেব্ল নেটওয়ার্ক ‘এএক্সএস’ টিভির চেয়ারম্যান। হাউ টু উইন অ্যাট দ্য স্পোর্ট অব বিজনেস গ্রন্থের এই রচয়িতা একসময় চাকরি করতেন। ১৯৮০-এর দশকে কলেজ পাস করে একটি কম্পিউটার স্টোরে বিক্রয়কর্মীর চাকরি নিয়েছিলেন। কিন্তু স্টোর মালিকের বিরাগভাজনের শিকার হয়ে চাকরিটা হারাতে হয়েছিল। তখনই ঠিক করেন, আর চাকরি নয়। নতুন ধরনের ব্যবসা শুরুর চিন্তাভাবনা শুরু করেন।
চাকরি হারিয়েই ‘মাইক্রো সলিউশনস’ নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ২৪০ কোটি ডলার উপার্জন করে ফেলেন। ৬২ বছর বয়সী মার্ক কুবানকে এখন বিবেচনা করা হয় বিশ্বের একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে।
৪. ব্যর্থ না হওয়ার ভয়
মার্কিন ধনকুবের স্যাম ওয়ালটনের গল্পটা বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সুপারস্টোর ওয়ালমার্ট এই প্রতিষ্ঠাতা সদিচ্ছাকে পুঁজি করে এগিয়েছিলেন। ওয়ালটন যখন ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন কিন্তু পুঁজি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। স্যাম ওয়ালটন তার শ্বশুরের থেকে ২৫ হাজার ডলার ঋণ নেন। তারপর নানা ধাপ পেরিয়ে ৪২ বছর বয়সে আরকানসাস অঙ্গরাজ্যে ওয়ালমার্ট প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৯৬২ সালে চালু হওয়ার পর ১৯৭৬ সালের মধ্যেই এই প্রতিষ্ঠানের মূল্য দাঁড়ায় ১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারেরও বেশি। তাঁর সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিল অল্প দাম, বেশি বিক্রি। মজার বিষয় হচ্ছে আরকানসাসে ওয়ালটনের সেই প্রথম স্টোরই ভেঙে যায়। তবে এতে পিছিয়ে আসেননি হার না মানা ওয়ালটন।
মজার গল্প আছে স্টিভ জবসকে নিয়েও। ২ ট্রিলিয়ন ডলারের কোম্পানি অ্যাপলের এই প্রতিষ্ঠাতাও বহুবার পেয়েছিলেন ব্যর্থতার স্বাদ। লিসা কম্পিউটারের ব্যর্থতায় কোম্পানি থেকে সরে যেতেও হয়েছিল স্টিভকে। অ্যাপল কম্পিউটার নিয়েও রয়েছে নানা ব্যর্থতার ইতিহাস। ডায়সন ভ্যাকিউম ক্লিনারের জনক স্যার জেমস ডায়সনের ধৈর্যের গল্প প্রায় স্কটিশ যোদ্ধা বরার্ট ব্রুসকে হারিয়ে দেয়। ১৫ বছর ধরে ৫ হাজার ১২৭টি পণ্য তৈরির পর সফল হয়েছিলেন তিনি।
৫.ছোট্ট ছোট্ট বিষয়েও মনোযোগ
ফায়ারস্টোন টায়ার অ্যান্ড রাবার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা হার্ভে এস ফায়ারস্টোন মনে করেন, ‘সাকসেস ইজ দ্য সাম অফ ডিটেইলস।’ স্টিভ জবস তাঁর উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ছোট্ট ছোট্ট জিনিসের ক্ষেত্রেও ছাড় দিতেন না। একবার এক ছুটির সকালে গুগলের নির্বাহীকে তিনি জানান, আইফোনে গুগলের যে লোগো আসে, তা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। এটি পাল্টাতে চান তিনি। নিজের পণ্যের এমন সব ছোট ছোট বিষয়েও গভীর নজর রাখতেন জবস।
৬. বিশ্বস্ত পরামর্শক, বন্ধু ও অংশীদার পাশে রাখা
প্রথমে জন রকফেলারের যে গল্পটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাঁর পুরো জীবনী দেখলে বোঝা যায়, তাঁর সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁর মা। প্রতিটি সাফল্যের পেছনে বিশ্বস্ত পরামর্শকের অবদান থাকে। অনেকটা ব্যাটম্যানের সঙ্গে যেমন রবিন। তেমনি বিল গেটসের ছিলেন পল অ্যালেন। স্টিভ জবসের ছিলেন বন্ধু ওজনিয়াক। দুজন মিলে প্রথম একটি বাড়ির গ্যারেজে বসে তৈরি করেন অ্যাপল কম্পিউটার।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: নভেম্বর ০৯, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,