লেখক: জিয়াউদ্দিন চৌধুরী। কান্ট্রি ম্যানেজার, শাওমি বাংলাদেশ
কোনো প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে কাজ করতে গেলে অবশ্যই সাধারণের তুলনায় আপনার বাড়তি কিছু গুণ থাকতে হবে। একজন শীর্ষ নির্বাহীর মোটাদাগে ছয়টি গুণ থাকতে হয়। প্রথমত, অভিজ্ঞতা থেকে শিখুন। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া একটি বড় গুণ। কাজ করতে গেলে ভালো ও খারাপ—দুই ধরনের অভিজ্ঞতা থাকবেই। তার সঙ্গে যুক্ত হবে চ্যালেঞ্জ। এই তিন জিনিস একসঙ্গে মোকাবিলা করতে পারার সক্ষমতাই আপনাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেবে।
দ্বিতীয়ত, কৌশলগত ভাবনা। কৌশলগত ভাবনা আমাদের তরুণেরা কর্মক্ষেত্রে এসে শিখতে চান। আমার মনে হয়, কর্মক্ষেত্রে আসার আগেই নিজেকে গড়ে তোলা যায়। আপনি কতটুকু মেধা ও মননশীলতার সঙ্গে কাজটি করলেন, সেটা অনেক বড় বিষয়। একই উপস্থাপনা বা প্রেজেন্টেশন আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পারে। কাজের মধ্যেই কৌশলগত ভাবনার প্রতিফলন ফুটে ওঠে।
তৃতীয়ত, অনুপ্রেরণামূলক হতে হবে। আপনার কর্মীরা যখন প্রধান নির্বাহী হিসেবে আপনার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন বলে বোধ করবেন, তখন আপনি দেখবেন যে তাঁরা নিজেদের লক্ষ্য পূরণে আরও কঠোর পরিশ্রমী ও কাজের প্রতি যত্নবান হওয়ার পাশাপাশি সৃজনশীল চিন্তাভাবনা করছেন। এ জন্য অনুপ্রেরণামূলক নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রতিনিয়ত নিজেকে যুক্ত রাখতে হবে।
চতুর্থত, সহানুভূতিশীল হতে হবে। একজন সহানুভূতিশীল প্রধান নির্বাহী তাঁর কর্মক্ষেত্রের জনবলকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। সহানুভূতির সঙ্গে আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সুখ-দুঃখ ও বিভিন্ন কৌতূহল সম্পর্কে প্রতিনিয়ত জানতে পারেন। এতে আপনি তাঁদের আরও সহজে বুঝতে পারবেন। ফলে তাঁরা যেকোনো সাফল্য অর্জন বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন।
পঞ্চমত, কৌতূহলী মনোভাব। নতুন যেকোনো বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। নিজের জানার পরিধি প্রতিনিয়ত বাড়াতে হবে। আগামী দিনে বিশ্বে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, সে সম্পর্কেও ভালো ধারণা রাখতে হবে। শিক্ষার কোনো বয়স নেই। এমন মনোভাব পোষণ করা যাবে না যে আমি প্রধান নির্বাহী, আমিই সবকিছু জানি। নিত্যনতুন মানুষসহ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নানা চ্যালেঞ্জ থেকেও আপনাকে অনেক কিছু শিখতে হবে।
ষষ্ঠত, দক্ষ ব্যবস্থাপনা। ভালো ব্যবস্থাপক ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান কখনোই সামনের দিকে এগোতে পারে না। একজন ভালো প্রধান নির্বাহী তখনই হওয়া সম্ভব, যখন তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি ও দূরদর্শী চিন্তার ক্ষমতা থাকবে। পাশাপাশি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে, যা একজন প্রধান নির্বাহীকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেবে।
মনে রাখতে হবে, কর্মীরা হলেন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণ ও আত্মা। তাঁরা চাইলে একটি প্রতিষ্ঠানকে শীর্ষে নিয়ে যেতে পারেন। অবশ্য অনেকেই চাকরিকে অন্যের প্রতিষ্ঠানে নিয়মতান্ত্রিক কাজ করা বলে মনে করেন। সকালে অফিসে ঢুকবেন, বিকেলে বাসায় চলে যাবেন—এ রকম ভাবলে কিন্তু নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি মনে করি, কাজকে চাকরি না ভেবে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করতে হবে। দেখবেন, তখন সবকিছু আপন লাগছে। অনেক কষ্টও তখন স্বাভাবিক মনে হবে। কারণ, তখন কাজের স্পৃহা বেড়ে যায়। কর্মীদের প্রতি আমার পরামর্শ, নিজের কাজকে কখনো ছোট মনে করা যাবে না। সফলতার কোনো শর্টকাট বা সহজ পথ নেই। অবশ্যই উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে এবং সেটা বাস্তবায়নের জন্য কাজও করতে হবে।
দেশে যে কয়েকটি খাত সবচেয়ে সম্ভাবনাময়, তার মধ্যে একটি মোবাইল ফোন বা মুঠোফোন খাত। দেশের জনসংখ্যা, প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার এবং করোনা মহামারির কারণে মানুষের হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। শাওমি কাজ করে ‘ফ্যান ফার্স্ট’ মূলমন্ত্রে। শাওমি ফ্যানদের একটি বড় বৈশ্বিক কমিউনিটি রয়েছে। তাঁরাই শাওমি ব্র্যান্ড এবং কোম্পানির পণ্য উন্নয়নে অবদান রাখেন। আমাদের ফ্যানরা শাওমির পণ্য ব্যবহার করছেন এবং সেটির গুণমান মুখে মুখে প্রচার করছেন। এ ছাড়া শাওমির অন্যতম প্রতিশ্রুতি হলো, স্থানীয় নেতৃত্ব নিশ্চিত করা। সেই বিবেচনায় এখন পর্যন্ত শাওমি বাংলাদেশের জনবল স্থানীয়। আমরা এখন বাংলাদেশের গ্রাহকদের ভালোবাসার ব্র্যান্ড। শাওমি বাংলাদেশ একমাত্র ফরচুন ৫০০ ব্র্যান্ড, যেখানে সবাই বাংলাদেশি।
বাংলাদেশের তরুণেরা বেশ সম্ভাবনাময়। তাঁদের উদ্দেশে একটাই পরামর্শ, পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। এ দেশের বেশির ভাগ তরুণ ভাবেন, একেবারে পড়াশোনা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবেন। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যত তাড়াতাড়ি অন্যদের চেয়ে নিজেকে আলাদা করতে পারবেন, আপনি তত এগিয়ে থাকবেন। এখন প্রতিযোগিতার বাজার। এ জন্য আমার পরামর্শ হলো, স্নাতক পর্যায়ে পড়ার সময় থেকেই খণ্ডকালীন বা প্রকল্পভিত্তিক কাজ শুরু করুন। পরে পেশাজীবনে এটি আলাদা সুবিধা দেবে। আমি নিজেও ছাত্রজীবনে খণ্ডকালীন কাজ করেছি। এ ছাড়া পড়াশোনা ও পেশাদারি জীবনের যোগসূত্র সব সময় একজন মানুষের কাজকে সহজ করে দেয়। তাই যে বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, সেই বিষয়ে চাকরির বাজারে বাড়তি সুবিধা দেবে।
আমার বাবা বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকরি করতেন। বাবার চাকরির সুবাদে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কুমিল্লা জেলার লাকসামে পড়াশোনা করেছি। এসএসসি পাস করেছি ঢাকার মতিঝিল মডেল উচ্চবিদ্যালয় থেকে। পরে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে পেশাজীবন শুরু করেছি। সারা দিনের শত ব্যস্ততার পরও পরিবারের মানুষের প্রতিও কিছু দায়বদ্ধতা আছে। বিশেষ করে আমাদের শিশুরা করোনার এই সময়ে ঘরবন্দী জীবনে নিজেদের এখনো মানিয়ে নিতে পারছে না। এ জন্য আমি শত ব্যস্ততার পরও আমার সন্তানদের জন্য কিছু সময় আলাদা করে রাখি এবং তাদের সঙ্গে সেই সময়টা উপভোগ করার চেষ্টা করি।
**** (অনুলিখন জাহাঙ্গীর শাহ)
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,