দেশে এখন তথ্যের অন্ধত্ব বিরাজ করছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, একটা সময় দেশে তথ্যের শূন্যতা ছিল। এরপর তথ্যের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। নৈরাজ্যের পর ছিল তথ্য প্রকাশের দ্বিধা। আর এখন চলছে তথ্যের অন্ধত্বের যুগ। উন্নয়নের ক্ষেত্রে তথ্য যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি এখন আর অনুধাবন করেন না নীতিনির্ধারকেরা। তাতে তথ্যের অন্ধত্বের এক ভয়াবহ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে দেশ।
অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও সিপিডির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এ মন্তব্য করেন। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর পুরানা পল্টনের ইআরএফ কার্যালয়ে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রয়োজনে বাজেটসংক্রান্ত তথ্যের গুরুত্ব ও তথ্য অধিকার আইনের বাস্তবায়ন’ শীর্ষক এ সেমিনারে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মূল বক্তা ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বাজেটসংক্রান্ত তথ্যের প্রয়োজনীয়তাবিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান। স্বাগত বক্তব্য দেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম কাদির ও ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘তথ্য যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সহায়ক শক্তি, সে গুরুত্বই এখন নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যেও একধরনের উদাসীনতা বিরাজ করছে। অথচ তথ্যের অন্ধত্ব আমাদের আধুনিক মনোভঙ্গি ও উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে, সেগুলো মোকাবিলা করতে হলে তথ্যের কোনো বিকল্প থাকবে না। এমন এক সময়ে আমরা তথ্যের অন্ধত্বের যুগে ঢুকেছি, যখন আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাচ্ছি। উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছি।’ তাই জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে তথ্যের অন্ধত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বেশ কয়েকটি কারণে দেশে তথ্যের সমস্যা বা সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে তথ্যের উপকারিতা সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কারিগরি সক্ষমতার ঘাটতি, তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা থাকার পরও সেই সক্ষমতা ব্যবহারে আর্থিক সহায়তা না পাওয়া, তথ্য নিয়ন্ত্রণের মনস্তাত্ত্বিক মনোভঙ্গি, তথ্য প্রকাশে প্রশাসনিক বা আইনি জটিলতা এবং তথ্যের চাহিদা কম থাকা।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘করোনাকালে আমরা দেখেছি, তথ্যের ঘাটতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা পৌঁছে দিতে না পারার ঘটনা। করোনাকালে অনেক দেশ অর্থসংকটে ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে অর্থের সংকট ছিল না। বড় সমস্যা ছিল অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতার ঘাটতি। এ ঘাটতির পেছনে বড় কারণ ছিল সঠিক তথ্য না থাকা। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আড়াই হাজার টাকা করে সহায়তার পুরো অর্থ বিতরণ করা সম্ভব হয়নি।’
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘অনেক সময় তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা বা জাতীয় স্বার্থের অজুহাত দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা দেখি, জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো অনেক তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ বা তৈরি করছে বিদেশি সহায়তায়। তখন কি জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় না?’
মূল প্রবন্ধে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বৈশ্বিক উন্মুক্ত বাজেট ইনডেক্স বা সূচকে বাংলাদেশের অবনতি ঘটছে। ২০১৭ সালে এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪১তম। আর ২০১৯ সালে সেটি আরও কমে ৩৬–এ নেমে আসে। সূচকে অবস্থান নিচে নামা মানে অবস্থার অবনতি হওয়া। মানুষের মধ্যে রাজস্ব বা অর্থনীতিসংক্রান্ত তথ্য জানার যে আকাঙ্ক্ষা, তা পূরণ হচ্ছে না। অনেক সময় তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়েও পাওয়া যায় না। আবার তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে।
সেমিনারে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন, তা–ও জানতে চাওয়া হয়। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়েও ভোগান্তির কথা জানান বেশ কয়েকজন সাংবাদিক।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ডিসেম্বর ২১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,