সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে এক প্রবাসী বাংলাদেশির স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র তারকাদের আমন্ত্রণ নিয়ে কয়েক দিন ধরে আলোচনা চলছে। আরাভ জুয়েলার্স নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম আরাভ খান। তবে এটা তাঁর আসল নাম নয়। তিনি বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার ছেলে রবিউল ইসলাম। চার বছর আগে ঢাকায় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান সে সময় ৩০ বছর বয়সী রবিউল ইসলাম। সেখানে বিয়ে করেন। পরে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। সেই পাসপোর্ট দিয়েই পাড়ি জমান দুবাইয়ে। এখন তিনি দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী।
গতকাল বুধবার রাতে দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকে আরাভ জুয়েলার্সের। উদ্বোধন করেছেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ে গেছেন ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের আরও বেশ কয়েকজন তারকা। কয়েক দিন আগে এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের খ্যাতিমান তারকাদের সম্ভাব্য উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন রবিউল। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ৬৫ তলায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। যার নম্বর ৬৫১০। আরও ৪-৫টি ফ্ল্যাটের মালিকও তিনি। পাশাপাশি রয়েছে একটি সুইমিংপুল ও বাগানসহ বড় ডুপ্লেক্স বাড়িও। যেখানে মাঝেমধ্যে মায়াবী হরিণ জবাই দিয়ে বাংলাদেশিদের দাওয়াত খাওয়াচ্ছেন। বাগানে চাষ করছেন বাংলাদেশি সবজি। রয়েছে একাধিক দামি গাড়ি। আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন উপলক্ষে ৬০ কেজি সোনা দিয়ে বানানো হয়েছে বাজপাখির আদলে লোগো, যা তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় আড়াই মাস। এটা তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।
তাঁর ওই ফেসবুক পোস্ট দেখে অনেকেই চিনে ফেলেন, তিনি বাংলাদেশে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার আসামি রবিউল ইসলাম। ফেরারি একজন আসামি দুবাইয়ে গিয়ে কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, পুলিশের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার টাকায় দুবাইয়ে সোনার ব্যবসা শুরু করেন রবিউল ইসলাম।
দুবাইয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পাওয়া একজন বাংলাদেশি। কারণ এর আগে কেউ দুবাইয়ে গিয়ে এত বিলাসী জীবন যাপন করেননি।
সাম্প্রতিক সময়ে দুবাই বিশ্বে স্বর্ণের ব্যবসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। দুবাইপ্রবাসী অনেক বাংলাদেশি সেখানে স্বর্ণের দোকানে কাজ করেন, আবার স্বর্ণের দোকানের মালিকানায়ও রয়েছেন কেউ কেউ। তবে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশিরা দেশটিতে অর্থ পাচার করে ফ্ল্যাট, বাড়ি, তারকা হোটেল ইত্যাদি কিনছেন। কেউ কেউ স্বর্ণ ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করছেন। যদিও সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কাউকে দুবাইয়ের এসব ব্যবসায় বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়নি বলে জানা গেছে।
যেভাবে পুলিশ পরিদর্শককে হত্যা
পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ২০১৮ সালের ৭ জুলাই রহমত উল্লাহ নামের এক ব্যক্তির আমন্ত্রণে ঢাকার বনানীর একটি বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁকে ‘ব্ল্যাকমেল’ করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা হয়। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, মামুনকে ফাঁদে ফেলে বনানীর ওই বাসায় ডেকে নেওয়া হয়। তাঁকে ফ্ল্যাটে নিয়ে বেঁধে, স্কচটেপ দিয়ে মুখ আটকে নির্দয়ভাবে পেটানো হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে মামুন মারা যান। পরে গাজীপুর থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।
ওই হত্যাকাণ্ডে রহমত উল্লাহ, রবিউল ইসলাম, সুরাইয়া আক্তার কেয়া, স্বপন সরকার, দিদার পাঠান, মিজান শেখ, আতিক হাসান, সারওয়ার হোসেন, মেহেরুন্নিসা ওরফে স্বর্ণা ও ফারিয়া বিনতে মাইসাকে আসামি করে বনানী থানায় হত্যা মামলা করে পরিদর্শক মামুনের পরিবার।
তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ এ মামলায় রহমত উল্লাহ এবং রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। সেখানে রবিউল ইসলামকে পলাতক উল্লেখ করা হয়। পরে আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
আদালতেও প্রতারণা করেন রবিউল
পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর রবিউল ইসলাম নামের একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাঁকে জেলে পাঠান। প্রায় ৯ মাস কারাবাসের পর ওই তরুণ বলেন, তিনি রবিউল ইসলাম নন, তাঁর আসল নাম আবু ইউসুফ। রবিউল ইসলামের কথামতো তাঁর নাম-পরিচয় ব্যবহার করে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন তিনি।
এরপর আদালত বিষয়টি অনুসন্ধান করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। ডিবির অনুসন্ধানে জানা যায়, খুনের মামলার আসামি রবিউলের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার আশুতিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মতিউর রহমান। আর রবিউলের পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণকারী আবু ইউসুফের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার আইনপুর গ্রাম। তাঁর বাবা নুরুজ্জামান, মা হালিমা বেগম।
রবিউলের গ্রামের বাড়ি কোটালীপাড়ার হিরণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাজহারুল আলমের কাছে তাঁর সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনারা যাকে রবিউল বলছেন, সে আমাদের কাছে রবিউল নামে বেশি পরিচিত নয়। আমরা তাকে আরব, হৃদয় বা সোহাগ নামেই চিনি। গ্রামে সর্বশেষ পাঁচ বছর আগে একদিন সন্ধ্যায় এসেছিল, পরে ওই রাতেই চলে যায়।’
তবে দুই থেকে আড়াই মাস আগে সৌদি আরবে রবিউলের সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে জানান চেয়ারম্যান মাজহারুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমি হজ করতে গিয়েছিলাম। সেখানে রবিউলও এসেছিল। আমাকে বলল, কাকা, আপনি সৌদি আসছেন, এখান থেকে দুবাই চলেন। আমি দুই দিনের জন্য সৌদি আসছি। আমার সঙ্গে দুবাই চলেন, আপনার যাওয়া-আসার বিমান টিকিট এবং যাওয়ার সময় কিছু স্বর্ণালংকার দিয়ে দেব।’ তবে রবিউলের সেই আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া হয়নি বলে জানান মাজহারুল আলম।
রবিউলকে ফেরাতে ইন্টারপোলের দ্বারস্থ পুলিশ
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, রবিউল ইসলামের একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট রয়েছে। সেখানে নাম ব্যবহার করা হয়েছে হৃদি খান। ওই পাসপোর্টের নম্বর ০৩৮৫১৮৮। হত্যা মামলার পর তিনি ভারতে গিয়ে আরাভ খান নাম দিয়ে আরেকটি পাসপোর্ট তৈরি করেন। ২০২০ সালের ২৮ জুলাই তিনি পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুর উদয় সংঘ ক্লাব এলাকার বাসিন্দা হিসেবে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। জালিয়াতি করে বানানো ওই পাসপোর্টে তাঁর বাবার নাম লেখেন জাকির খান, মায়ের নাম দেন রেহানা বিবি খান এবং স্ত্রীর নাম সাজিমা নাসরিন। তাঁর ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বর ইউ ৪৯৮৫৩৮৯। সূত্র জানায়, রবিউল ভারতীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করে আপন আরাভ নাম নিয়ে দুবাই যাতায়াত শুরু করেন। ওই পাসপোর্ট দিয়ে ইউরোপেও ভ্রমণ করেন।
ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (খিলগাঁও জোন) শহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জুয়েলার্সের মালিক আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতে সোপর্দ করার চেষ্টা চলছে।
রবিউলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান জানিয়েছেন।
ডিবি পুলিশ সূত্র জানায়, নিজেকে বাঁচাতে প্রতারণার মাধ্যমে আবু ইউসুফ নামের আরেক যুবককে রবিউল সাজিয়ে আদালতে আত্নসমর্পণ করানো হয়। রবিউলের নাম–ঠিকানা ব্যবহার করে আবু ইউসুফ ২০২০ সালে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত তাঁকে জেলে পাঠান। প্রায় ৯ মাস জেলে থাকার পর সেই তরুণ একপর্যায়ে সত্য প্রকাশ করে দেন।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:মার্চ ১৬, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,