২০২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটিশ রাজসিংহাসনে আরোহণের ৭০তম বার্ষিকী পালন করে ফেললেন। ব্রিটেনের সাংবিধানিক ইতিহাসে ৭০ বছরের শাসন অভূতপূর্ব। কারণ, রাজসিংহাসনে ৭০ বছরের বেশি থাকার ইতিহাস রয়েছে মাত্র তিনজনের। দীর্ঘ এ সময়ে অনেক উত্থান-পতন ও ঘটনার সাক্ষী এলিজাবেথ।
রানি এলিজাবেথের বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েক বছর পরই তিনি মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫২ সালে ২৫ বছর বয়সী প্রিন্সেস এলিজাবেথ রাজসিংহাসনে বসেন। রানি এলিজাবেথ যখন সিংহাসনে বসেন, তখনো যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন, ইংল্যান্ডের শহরগুলোতে বোমা ও সামরিক চৌকিগুলো রয়েই গেছে।
কোরিয়া যুদ্ধ শেষ হওয়ার তখনো দেড় বছর বাকি। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তখন উইনস্টন চার্চিল। এরপর দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটেনের ১৪ জন প্রধানমন্ত্রীর বদল হতে দেখেছেন। দীর্ঘ ৭০ বছরের সময়ে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে কমনওয়েলথে পরিণত হওয়া ও বিশ্বজুড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের পতনের ঘটনার জাজ্বল্যমান এক সাক্ষী। ২০১৫ সালে সেপ্টেম্বরে রানি এলিজাবেথ রেকর্ড ভাঙার আগে যাঁরা সবচেয়ে বেশি সময় ইংল্যান্ডের রাজা–রানি ছিলেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
রানি ভিক্টোরিয়া: ৬৩ বছর ২১৬দিন (১৮৩৭-১৯০১)
যদিও এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা রানি ভিক্টোরিয়াকে কৃষ্ণাঙ্গ আর সামাজিক দমন-পীড়নে দীর্ঘ শোকের সঙ্গে যুক্ত করেন, তবে এটি প্রায়ই ভুলে যান যে তিনি একাধিক হত্যাচেষ্টা থেকে প্রাণে বেঁচেছেন। একবার একজনের দ্বারা আহত হন তিনি। এর পর থেকে মাথার চারদিকে কাঠি বেঁধে ঘুরতে দেখা যেত ভিক্টোরিয়াকে।
বিশিষ্ট একজন লেখকও ছিলেন ভিক্টোরিয়া। দিনে গড়ে দুই হাজার শব্দ লিখতেন তিনি। তার সেসব লেখা যদি পাওয়া যেত, তাহলে হয়তো হাজারো পৃষ্ঠার বই বের করা যেত। কিন্তু লেখাগুলো তাঁর ছোট ছেলে প্রিন্সেস বিট্রিস পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। রাজপরিবারের লেখকেরা তাঁকে ‘খুব খোলামেলা’ বলে বর্ণনা করেন।
রাজা তৃতীয় জর্জ: ৫৯ বছর ৯৬ দিন (১৭৬০-১৮২০)
রাজা তৃতীয় জর্জ পাগলামির জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তিনি খুব সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। তিনিই প্রথম রাজা, যিনি তাঁর গবেষণাকাজে বিজ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং একটি রাজকীয় বই সংগ্রহশালা গড়েছিলেন। পরে যেখান থেকে ৬৫ হাজার বই ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দেওয়া হয়েছিল
রাজা তৃতীয় জর্জের শাসনামলের মাঝামাঝি নেপোলিয়োনিক ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সংঘাত শুরু হয়। তবে ১৮১১ সালের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার কারণে শাসনকাজ পরিচালনার অযোগ্য হয়ে পড়েন তিনি। এতে তাঁর ছেলে প্রিন্স রিজেন্ট (পরে রাজা চতুর্থ জর্জ) ডি-ফ্যাক্টো (প্রকৃত) শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন।
রাজা তৃতীয় হেনরি: ৫৬ বছর ২৯ দিন (১২১৬-১২৭২)
কম বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করলে দীর্ঘ সময় রাজশাসন খুব সহজ হয়। রাজা তৃতীয় হেনরি রাজমুকুট পরেছিলেন মাত্র ৯ বছর বয়সে। তাঁর রাজত্বের সময়ের দিকে তাকালে এখনো অবিশ্বাস্য ও চিত্তাকর্ষক মনে হয়। তিনি ছিলেন মধ্যযুগের রাজা। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৩ বছর।
১২২৭ সাল পর্যন্ত রাজক্ষমতার সবটুকু তিনি পাননি। তবে এতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এড়ান। প্রথম ব্যারন যুদ্ধ নামে পরিচিত গৃহযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখনো হেনরি শিশু। কিন্তু যুদ্ধ চলে শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়জুড়ে। ১২৬৩ সালে দ্বিতীয় ব্যারন যুদ্ধে তিনি বন্দী হন। ছেলে ও উত্তরসূরি প্রথম এডওয়ার্ড তাঁকে মুক্ত করেন।
যাঁরা ৭০ বছরের বেশি রাজশাসন করেছেন
৭০ বছরের বেশি সময় কারা রাজশাসন করেছেন, এটা জানতে যেতে হবে ব্রিটেন সীমান্তের বাইরে।
বিতীয় জোহান, প্রিন্স অব লিচটেনস্টেইন: ৭০ বছর ৯১ দিন (১৮৫৮ থেকে ১৯২৯)
দ্বিতীয় জোহান ‘জোহান দ্য গুড’ নামে পরিচিত। তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ একজন শিল্প বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। নিজের সংগ্রহে রাখার জন্য তিনি অনেক শিল্পকর্ম কিনেছিলেন। তবে এর মধ্যে অনেকগুলো জাদুঘরে দান করেন। এ ছাড়া তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গ পুনরুদ্ধার এবং বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক উদ্যোগের সমর্থক ছিলেন। জাতি গঠনে জোহান লিচটেনস্টেইনের প্রথম সংবিধানের গোড়াপত্তন করেছেন। সাধারণ নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রদানের সুযোগও করে দিয়েছিলেন তিনি।
থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল: ৭০ বছর ১২৬ দিন (১৯৪৬-২০১৬)
থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল আদুলাদেজ জন্মভূমি থাইল্যান্ডে ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো তিনি ছিলেন দক্ষ স্যাক্সোফোনিস্ট। ছোটবেলা থেকেই জ্যাজ সংগীতে বেশ দখল ছিল। ১৯৬০ সালে নিউইয়র্কে বেনি গুডম্যানের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে স্যাক্সোফোন বাজিয়েছিলেন এ রাজা।
এ ছাড়া রাজা ভূমিবল আদুলাদেজের নৌভ্রমণের শখ ছিল এবং তিনি তাঁর বাবার মতো একজন নৌকা নির্মাতা ও নকশাকারকও হয়েছিলেন। থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে জন্ম নেন। তাঁর ভাই রাজা আনন্দ মাহিদল মারা যাওয়ার পর ১৯৪৬ সালের ৯ জুন তিনি সিংহাসনে বসেন।
রাজা চতুর্দশ লুই: ৭২ বছর ১১০ দিন (১৬৩৮-১৭১৫)
শিশু বয়সী রাজাদের একজন চতুর্দশ লুই। তিনি এমন সময়ে জন্ম নেন, যখন মানুষের গড় আয়ু ছিল কম। তিনি ‘সূর্য রাজা’ নামেও পরিচিত ছিলেন। সার্বভৌম কোনো দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রাজা ছিলেন তিনি। তিনি একাডেমি ফ্রাঙ্কাইসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাঁর শাসনামলে ফরাসি সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল।
উনিশ শতকে ষাটের দশকে ফ্রেঞ্চ রয়্যাল একাডেমি অব ড্যান্স ও একাডেমি ডে অপেরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। শাসনামলে বহু শিল্পীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
রাজা চতুর্দশ লুই এত বছর ধরে শাসন করেছেন যে যাঁদের তাঁর উত্তরসূরি হওয়ার কথা ছিল, তাঁদের বেশির ভাগ মারা যান। ১৭১৫ সালে লুইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর নাতির ছেলে ডিউক অব আনজৌয়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। রাজা চতুর্দশ লুইয়ের পর সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমে তিনি হন রাজা পঞ্চদশ লুই।
সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন যিনি
সোয়াজিল্যান্ডে রাজা দ্বিতীয় সোভূজা (এখন এসওয়াতিনি) ৮২ বছর ২৫৪ দিন (১৮৯৯-১৯৮২) রাজসিংহাসনে ছিলেন। এখন পর্যন্ত দীর্ঘ সময় রাজত্ব করার যে ইতিহাস পাওয়া যায়, এর মধ্যে সবার শীর্ষে তিনি। কিন্তু তিনি এমন একটি রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন, যেটি তাঁর শাসনামলের বেশির ভাগ সময় আন্তর্জাতিকভাবে সার্বভৌম ছিল না। এ কারণে অবশ্য সঠিক তালিকায় তিনি স্থান পান না। সোয়াজিল্যান্ড ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের অধিকারে থাকা একটি অঞ্চল ছিল।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ০৭, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,