তখন ১৫৭৫ সাল ভারতবর্ষে মুঘল শাসন, তৎকালীন ভারতবর্ষের সম্রাট জালাল উদ্দিন মো: আকবর খুব চিন্তিত আর সম্রাট আকবর আর দশ জনের মতো নয় কারণ সম্রাট নিরক্ষর হলেও তার জ্ঞানপিপাসার ব্যাপারে সবাই অবগত।
ঈশ্বর, পরকাল, আত্মা, জন্মান্তর, পাপ-পুণ্যের পরিণাম সহ নানা বিষয়াদি নিয়ে বাদশাহ প্রতিনিয়ত ভাবছেন। ফতেহপুর সিক্রির অদূরে একটি পাথরের উপর প্রতিদিন ভোরে সম্রাটকে ধ্যানরত দেখে সকলেই বিস্মিত হচ্ছিল।এদিকে সম্রাটের মনের অজস্র প্রশ্নের জবাবও নবরত্ন সভার সকলের নিকট থাকছে না।
আকবরের নবরত্ন সভার সভ্য আবুল ফজল তার আকবরনামা-য় লিখছেন, “বিশাল ভারত ভূমির ধর্ম বৈচিত্র্য এবং পাশাপাশি ধর্মীয় কোন্দল-কোলাহল মহামতি আকবরকে সর্বদাই আরও ভাবিয়ে তোলে। ”
সম্রাট ইবাদতখানা তৈরি করিয়েছেন যেখানে সব সম্প্রদায়ের মানুষ নিমন্ত্রিত হন এবং খোলামেলা আলোচনায় অংশগ্রহন করেন। গোঁড়া উলেমা থেকে শুরু করে পুরোহিত,জৈন,পার্সী, বৌদ্ধ, শিখ, জেসুইট পাদ্রী কে নেই সেখানে!!
ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সম্ভাষণ রীতিও ছিল ভিন্নরকম। কেউ সালাম,কেউ নমস্কার,কেউ বা আদাব সর্বদা এই ধবনিতে মুখরিত থাকতো ইবাদতখানা।
সকল ধর্মের ধর্মযাজকগণ সম্রাটের মনে আন্দোলন সৃষ্টিকারী প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতেন। কখনো বা তারাও বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেন।এভাবেই সম্রাট সব ধর্মের তত্ত্বের ব্যাপারে অবগত হচ্ছিলেন।
সম্রাট তারপর একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন, একটি নতুন জীবন বিধান প্রণয়নের, যেখানে সব ধর্মের আচার-বিচার স্থান পাবে। এর ফলে পুরো ভারতবর্ষের সকল অধিবাসীদের এক পতাকা তলে আনা যাবে।
আবুল ফজল তার আকবরনামা-য় লিখছেন,
“সম্রাট প্রচলিত ধর্মগুলোর সাধারণ বিষয়গুলো এক করে একটি নতুন জীবন বিধান প্রণয়ন করতে উদ্যত হন।”
প্রফেসর রায়চৌধুরী বলেন-
“Akbar had a big tolerance for other faiths. He would, not only, display tolerance himself but also encouraged debate on philosophical and religious issues in his Ibadat Khana in order to convert all religions into one common unity. From those debates, Akbar con cluded that no single religion could claim the monopoly of truth. This inspired him to create the Din I Ilahi ”
নতুন ধর্ম নিয়ে অনেক বাছ-বিচারের পর ১৫৮২ সালে চল্লিশ বছর বয়সে ভারতের মহান অধিপতি আকবর আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্ম প্রবর্তন করেন। এই ধর্মের নাম দেওয়া হয় দীন-ই-ইলাহী। যার অর্থ ঈশ্বরের ধর্ম।
আর আকবর নিজেকে ঘোষণা করেন খলীফাতুল্লাহ, অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতিনিধি।
ঐতিহাসিক ইজাদ জামসারি বলেন-
“Ilahi (1582 CE) “the religion of God,” was a new by Akbar. Though, apparently, the purpose of Dinireligious doctrine expounded Ilahi was the initiatives taken by Akbar to merge all the Indian communities under one umbrella what was called the ‘Mughal Union”
দীন-ই-ইলাহীর কালিমা ছিল –
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আকবর খলীফাতুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মহান আকবর সেই আল্লাহরই প্রতিনিধি)।”
এই ধর্মাবলম্বীদের সম্ভাষণ রীতিও ছিল এরকম-
১/কারো সাথে দেখা হলে একজন বলত ‘আল্লাহু আকবর’।
২/ প্রত্যুত্তরে আরেকজনকে বলতে হতো ‘জাল্লেজালালুহু’।
এখানে উল্লেখ্য যে,,মুসলিমরা মনে করে ‘আল্লাহু আকবর’ বলতে আকবর বোঝাচ্ছিল আকবরই ঈশ্বর। আর ‘জাল্লেজালালুহু’-র অর্থ তারই প্রতাপ।
দীন-ই-ইলাহীর আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে, এই ধর্মের কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই, কোনো ধর্মগুরুও নেই। নেই কোনো ধর্মীয় পীঠস্থান। আলোচনার মাধ্যমে সম্রাট যে বিধান দিতেন তা-ই অনুসারীরা গ্রহণ করত। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে এই বিধানগুলো কিছুটা পরিবর্তন-পরিমার্জন করে আনা হত। কালিমাটি ইসলাম ধর্ম থেকে নেওয়া হয়।
দীন-ই- ইলাহীর নিয়মসমূহ-
১/ দীন-ই-ইলাহীতে সূর্যপ্রনাম ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। দিনে চার বার সূর্যবন্দনা করা হতো। প্রত্যুষে, মধ্যাহ্নে, সায়াহ্নে ও মধ্যরাতে।
২/প্রত্যুষের ও মধ্যরাতের অর্চনা ছিল বাধ্যতামূলক। এতে সূর্যের একশ সংস্কৃত নাম জপ করতে হতো অনুসারীদের। নহবত ও নাকাড়া বাজিয়ে প্রার্থনার জন্য ডাকার প্রথা ছিল।
৩/ গো হত্যা পুরো দেশে নিষিদ্ধ করা হয়।
৪/ সপ্তাহ শুরু হবে রবিবার থেকে।
৫/ সভায় সারাক্ষণ অগ্নি-প্রজ্বলিত করে রাখা হবে।
৬/চারটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে অনুসারীদের বিভিন্ন স্তরে স্থান দেওয়া হবে। জান, মাল, সম্মান ও ধর্ম। এই বিষয়গুলো সম্রাটের নামে উৎসর্গ করা হতো।
এই নিয়মগুলো মূলত আকবর সংগ্রহ করেছিলেন বিভিন্ন ধর্ম থেকে। যেমনঃ
১/দীন ই ইলাহির কালিমা টি আকবর তৈরি করেছিলেন মুসলিম কালিমার অনুকরণে।
২/সূর্যপ্রনাম এবং গো হত্যা বন্ধের নিয়ম করেছিলেন হিন্দুদের থেকে।
৩/ সপ্তাহের শুরু রবিবার ঘোষনা করেছিলেন খ্রিস্টানদের অনুকরণে।
৪/প্রথমে গো হত্যা বন্ধ দিয়ে শুরু হলেও পরে পশুহত্যাই বন্ধ করে দেয়া হয় যা জৈন ধর্ম অনুকরনে। এছাড়া বৌদ্ধধর্মে ও জীবহত্যা নিষিদ্ধ।
৫/ দরবারে সর্বদা অগ্নি প্রজ্জলন এসেছে পার্সীদের থেকে।
দীন-ই-ইলাহী গ্রহণ করার নিয়ম-
১/ রবিবারে স্বয়ং সম্রাটের থেকে দীক্ষা নিতে হবে।
২/ স্নান করে মাথার পাগড়ি খুলে সম্রাটের সামনে হাঁটু গেড়ে নতমস্তক হয়ে বসতে হবে।
৩/সম্রাট তাকে নিজ হাতে পাগড়ি পরিয়ে একটি অভিজ্ঞান (কেউ কেউ মনে করে জপমালা) দান করতেন।
৪/ নতুন অনুসারীকে একটি সম্রাটের চেহারা খচিত তাসবীর (ছবি) দেওয়া হতো, যেটি পাগড়িতে ধারণ করার রীতি ছিল।
দীন-ই-ইলাহীর কিছু কিছু নিয়ম ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।
১/মদ্যপান ও জুয়া ছিল বৈধ। জুয়া খেলার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাদশাহর মহলের পাশেই ক্রীড়া ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হয়। একটি নির্দিষ্ট হার সুদে জুয়া খেলার জন্য ঋণ প্রদানের ব্যবস্থাও করা হয়।
২/ দাঁড়ি রাখাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। ছেলেদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ষোলো বছর, আর মেয়েদের চৌদ্দ।
৩/ জিজিয়া কর তুলে নেওয়া হয়।
৪/কথিত আছে, মুসলিম ফিকহবিদগণের জন্য বরাদ্দ জমিও আকবর কেড়ে নেন। এর কিছুকালের মধ্যেই জৈন ধর্মগুরু দস্তুর মেহেরজীকে ২০০ বিঘা জমি দানের ঘোষণা দেন।
৬/ এছাড়াও আকবর দরবারে সিজদাহ করার প্রচলন করেছিলেন।(যদিও এ ব্যাপারে সব ঐতিহাসিকগন মত দেন না)
৭/দীন ই ইলাহির শপথটি ছিল- “আকবর ইয়া হুয়া ইয়া হাদি”।
এই বিষয়গুলো নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি করে এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত ধর্মটিকে আরো ঘোলাটে ও বিতর্কিত করে তোলে।
১৫৭৯ সালের জুনের শেষদিকে আকবর ফতেপুর সিক্রির পেশ ইমামকে সরিয়ে নিজে ইমামতির ভার গ্রহণ করেন।জমাদিউল আউয়াল মাসের প্রথম শুক্রবার তিনি মসজিদের মিম্বরে আরোহন করেন৷এসময় তিনি নিজেকে ইমাম ই আদিল বা আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে দাবি করেন এবং খুতবা পাঠ করার সিদ্ধান্ত নেন।আবুল ফজলের বড়ভাই শেখ আবুল ফয়েজ ফয়েজী নিজে একটি খুতবা রচনা করে আকবরের হাতে তুলে দেন।
খুৎবাটি ছিলঃ
“তার নামে আমি খুৎবা পাঠ করছি যিনি আমাকে সার্বভৌমত্ব দান করেছেন।
যিনি আমাদের বিজ্ঞ হৃদয় ও শক্তিশালী বাহু দান করেছেন।
যিনি আমাদের সত্যের পথে পরিচালনা করেছেন।
যিনি অজ্ঞাত জ্ঞানকে আমাদের জানার বাইরে রেখেছেন।
তার প্রশংসার কোন সীমা নেই।
আমরা তার উউচ্ছ্বসিত প্রশংসা করি – আল্লাহু আকবর।”
খুৎবা শেষে আকবর সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রশংসাজ্ঞাপন করে সুরা ফাতিহা পাঠ করেন এবং নামাজ আদায় করেন। ঐতিহাসিক আবদুল কাদের বাদাউনির মতে তিনি নাকি এসময় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান।তবে এই নিয়ে দ্বিমত আছে।অধিকাংশ ঐতিহাসিকরা বলেছেন যে আকবর আরো কয়েকদিন খুৎবা দেন।তবে এই খুৎবা দেয়া নিয়ে জনগনের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা যায় এবং দরবারের কয়েকজন আমির এই নিয়ে সরাসরি বিরোধিতা শুরু করেন।তারা বলেছিলেন আকবর আসলে পয়গম্বর হতে চাইছেন।বিভ্রান্তিকর আল্লাহু আকবর ধ্বনির বিরুদ্ধেও চরম আপত্তি তোলা হয়।ঐতিহাসিক বাদাউনি, ভিনসেন্ট এ স্মিথ মনে করেন যে আকবরের খুৎবায় ব্যবহার করা এ শব্দ দুটি দ্বারা আকবর হলেন খোদা এটা বোঝানো হয়েছে।এছাড়া সেই সময়ের মুদ্রায় ব্যবহার করা ‘আকবর আল্লাহ’ শব্দ দুটির কারনে সন্দেহ আরো ঘনিভূত হয়।
১৫৭৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী মুঘল দরবার থেকে ডিক্রি অফ ইনফলিবলিটি জারি করা হয়।ডিক্রিতে লেখা ছিলঃ
১/আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মান্য করুন এবং আমাদের ভেতর যাদের পরিপূর্ন জ্ঞান আছে তাদের।
২/নিশ্চয়ই রোজ কিয়ামতের দিন ইমাম ই আদিল হবেন আল্লাহর প্রিয়তম বান্দা।যিনি আমিরদের মান্য করেন তিনি আল্লাহকে মান্য করেন আর যিনি বা যারা আমিরদের অমান্য করেন তারা আল্লাহকে অমান্য করেন।
৩/আমরা সম্মত হয়েছি যে সুলতান ই আদিলের মর্যাদা মুজতাহিদের চেয়ে অধিক।আমরা আরো ঘোষণা করছি ইসলামের বাদশাহ,বিশ্বাসীদের আমির ও পৃথিবীতে আল্লাহর ছায়া জালালুদ্দিন মোহাম্মদ আকবর পাদশাহ গাজী হলেন সবচেয়ে ন্যায়পরায়ন ও খোদাভীরু বাদশাহ।
৪/ভবিষ্যতে মুজতাহিদদের মধ্যে ধর্মীয় কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে মহামান্য সম্রাট জাতির কল্যানে ডিক্রি জারি করতে পারবেন।আমরা সম্মত হচ্ছি যে আমাদের ও আমাদের জাতির জন্য এ ডিক্রি পালন করা বাধ্যতামূলক।
৫/মহামান্য সম্রাটের ডিক্রি সবসময় কোরআনের আইনের সাথে সংগতিপূর্ণ হবে তা নয়,জাতির কল্যানের জন্য যেটা যথার্থ তা করা হবে।মহামান্য সম্রাট কোন নির্দেশ জারি করলে প্রজাদের তা বিরোধিতা করা হবে আখিরাতে নিন্দাযোগ্য ও ইহকালে সম্পত্তি ও ধর্মীয় অধিকার হারানোর মতো অপরাধ।
নতুন সৃষ্ট এই ধর্ম থেকে মুসলিম সমাজকে সরিয়ে রাখতে যিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন তিনি হচ্ছেন
শায়েখ আহমেদ সেরহিন্দ।পাঞ্জাবের সেরহিন্দে জন্ম নেওয়া এই ইসলামী চিন্তাবিদ দীন-ই-ইলাহীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা ও আন্দোলন শুরু করেন।
শায়েখ আহমেদ সিরহিন্দ পবিত্র কোরআন থেকে এই বাক্যগুলো তুলে ধরেনঃ
1.Today I’ve perfected the religion for you and have completed My favor upon you. (Quran.5:3)
2.He who invents something false which has no relation with the religion of Islam is rejected. (Muslim, 3/1343)
3.The best discourse is the discourse of Allah and the best way is the way of Prophet Muhammad (PBUH) and the worst things are the innovations and every innovation in the religion is misleading. (Muslim, 2/592)
4. I advise you to fear Allah and must hear your ruler and obey him though he is a Negro slave. So it is an obligation upon you to follow my Sunnah and my caliphs and hold it strongly and avoid the innovations because every new thing is an innovation in the religion and every innovation is misleading.
তিনি চারটি পর্যায়ে তার এই কার্যক্রম পরিচালনা করেন।তিনি যেসব পদক্ষেপগুলো নেনঃ
১/ প্রথমেই মোজাদ্দেদীয়া তরিকার প্রবর্তন করেন।
তিনি রূহানী কামালিয়াত বা আধ্যাত্মিক পূর্ণতার দ্বারা একটি আলেম গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করেন। যাদের ব্রত ছিল শুদ্ধ ইসলামী বিধান প্রচার করা।
২/ দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি সুধী সমাজের কাছে ইসলামের শুদ্ধ ব্যাখ্যা করেন।
৩/ এরপর ধাপে ধাপে তিনি দেশের আমির-ওমরাহদের তাদের নৈতিকতা ও দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন করেন।
৪/ চতুর্থ ও সর্বশেষ ধাপে তিনি বাদশাহর উপরে তার প্রভাব বিস্তার করেন। এর পাশাপাশি তিনি তার ভক্ত বা মুরিদদের গ্রাম-গ্রামান্তরে পাঠান ধর্মের প্রচারের জন্য।
এভাবে দীন-ই-ইলাহীর প্রভাব থেকে তিনি ভারতবাসীকে মুক্ত করেন এবং আলফে-সানী নামে বেশি পরিচিতি পান। তাকে ভারতে ইসলামের পুনর্জাগরণকারী হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয়।
সম্রাট আকবর নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেন ঠিকই, কিন্তু একে রাষ্ট্রধর্ম করেননি অথবা প্রজাদের উপর জোর-জবরদস্তিও করেননি। তার সভাসদগণের মধ্যে মাত্র ১৮ জন তার এই ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে একমাত্র হিন্দু ছিলেন বীরবল।এছাড়াও আবুল ফজল,কাসিম খান,আজম খান,শেখ মোবারক,আব্দুস সামাদ,মোহাম্মদ শাহাদাদ,সরদার জাহান ও তার দুই পুত্র,শেখজাদা গোসালা,সুলতান খাজা,মীর শরিফ আমল মোটামুটি এই কয়েকজনের নামই জানা যায়। আর সাধারনের মধ্যে সর্বসাকুল্যে হাজার খানেক মানুষ ছিল যারা এই ধর্ম গ্রহণ করে যদিও এটাও স্বীকৃত নয়।
আকবরের অতি কাছের মানসিংহ ও টোডরমল ও এ ধর্ম গ্রহন করেননি।আজিজ কোকা আকবরকে ভৎর্সনা করে চিঠি লেখেন যে তার উপর কোন আসমানী কিতাব ও নাযিল হয়েছে কিনা।এরপর আজিজ কোকা মক্কায় চলে যান।আকবর নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে তাকে চিঠি লেখেন।এরপর আজিজ কোকা ফিরে আসেন।আজিজ কোকার বড় দাড়ির জন্য আকবর তাকে প্রায়ই উপহাস করতেন।দীন ই ইলাহির বিরুদ্ধে শায়খ ও ফকিহরা আন্দোলন গড়ে তোলেন।এটি ইলাহি আন্দোলন নামে পরিচিত।তাদের ক্ষমা চাইতে বলা হলে তারা অস্বীকার করেন এবং আকবর তাদের কে ১৫৮১ সালে কান্দাহারে নির্বাসনে পাঠান।এ আন্দোলন আরো কয়েকবছর অব্যাহত ছিল।১৫৮৫ সালে সদর ই সুদুর বা সুবাদারদের সুবেদার অথবা কেন্দ্রীয় সুবেদার শেখ আব্দুন নবী আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করেন।আকবর তাকে দমন করেন এবং পরে এই পদটি বিলুপ্ত করা হয় এবং প্রাদেশিক সুবেদারদের সরাসরি সম্রাটের আওতাভুক্ত করা হয়।
ঐতিহাসিকরা দীন ই ইলাহি এর কথা এভাবে বলেছেন-
this period is considered as controversial by orthodox Muslim scholars due to Akbar’s innovative approach to religious affairs.
Professor Fazlur Rahman quotes as:
“The first Islamic crisis in India came to a head during the reign o f Akbar, who partly through political motives but largely based on his personal religious views and experiences and helped intellectually and encouraged by the two brothers Abul Fadl and Faydi formulated and inaugurated a new eclectic religion, the Dini I lahi. The new religion perished in the bud, rejected equally by Hindus and Muslim”.
এছাড়া বলা হয়ে থাকে যে,নতুন প্রতিষ্ঠিত ধর্মের কারণে আকবরকে সিংহাসনচ্যুত করার চেষ্টা করা হয় যদিও তিনি সফলভাবে সে বিদ্রোহ দমন করেন এছাড়াও আকবরকে খুন করার ও চেষ্টা করা হয়।
ড. স্মিথ দীন ই ইলাহী নিয়ে আলোচনার শেষাংশে বলেছেন, ” The divine faith was a monument of Akbar’s folly and not of his wisdom.” অর্থ্যাৎ দীন ই ইলাহি আকবরের প্রজ্ঞা নয়, এটি তার ভুলের একটি সৌধ মাত্র।
পরবর্তীতে আকবরের মৃত্যুর পর সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজেও বাবার প্রবর্তিত ধর্মকে প্রসারিত করার উদ্যোগ নিয়ে আলেম-ওলামাদের চক্ষুশূল হতে চাননি।আর এতে দরবারের আমির ওমরাহ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল।এভাবে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলের শেষদিকেই দীন-ই-ইলাহীর পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটে।
শেষ করবো আরো একটি মজার ঘটনা দিয়ে।আকবর ধর্ম ও শিশুদের নিয়ে একটি পরীক্ষা চালান।ইবাদতখানার মুসলিম আলেমরা একসময় ঘোষণা দেন যে সমস্ত শিশুই জন্মগতভাবে মুসলমান এবং সব শিশুরই জন্মগত ভাষা আরবি।আকবর এ দাবির সত্যতা প্রমানের জন্য ১৫৭৯ সালে শিশুদের নিয়ে এ পরীক্ষাটি চালান।পিতামাতাকে ক্ষতিপূরণ দেবার বিনিময়ে তিনি কয়েকটি শিশু সংগ্রহ করেন।এসব শিশুগুলোকে বদ্ধ একটি পরিবেশে রাখা হয় যেখানে শুধু খাবার,পানি ছাড়া কোন প্রকার কথা বা বাইরের পরিবেশে আসা সসম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়।বছরখানেক পরই প্রমান হয়ে যায় যে মানুষ হিন্দু,মুসলমান,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান হয় পারিপার্শ্বিক প্রভাবে।ধর্মের সাথে জন্মের কোন সম্পর্কই নেই আর তাছাড়াও শিশুগুলো হয়েছিল সম্পূর্ন বোবা ও মানসিক প্রতিবন্ধী।
তথ্যসূত্রঃ
১/ আইন-ই-আকবরি, মূল : আবুলফজল, বাংলা অনুবাদ : পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়,দিব্য প্রকাশ,ঢাকা,২০০৮,(পৃষ্ঠাঃ৩০-৩৪)।
২/ ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, লেখক : আব্দুল করিম,জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ,ঢাকা,২০১৪,(পৃষ্ঠাঃ২৫০-২৫৬)।
৩/ মুঘল সম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়,সাহাদত হোসেন খান,আফসার ব্রাদার্স,ঢাকা,২০১৫,(পৃষ্ঠাঃ৩৭২-৩৭৬)।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: মার্চ ১০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,