করোনা সংক্রমণ রোধে চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা চালু থাকলেও পবিত্র ঈদুল আজহার পর দুই সপ্তাহ বন্ধ রাখতে হবে। পোশাক রপ্তানি ও ক্রয়াদেশ পাওয়ার এই ভরা মৌসুমে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে বিপদে পড়তে যাচ্ছেন মালিকেরা।
পোশাকশিল্প খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, দুই সপ্তাহ ছুটি পেলে পোশাকশ্রমিকেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে ছুটবেন। তাতে উত্তরবঙ্গসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ভাইরাসটির সংক্রমণ বাড়বে। অন্যদিকে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস প্রায় প্রতিদিনই প্রচুর পরিমাণ শীতের পোশাক রপ্তানি হয়। দুই সপ্তাহ কারখানা বন্ধ থাকলে ক্রয়াদেশ অনুযায়ী লিড টাইম মেনে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে না কারখানাগুলো। তখন বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বাতিল করবে বা মূল্যছাড়ের সুবিধা নেবে। উড়োজাহাজে পাঠাতে হলেও বিপুল লোকসান গুনতে হবে। আবার আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ আসার গতিও কমে যাবে। অনেক ক্রেতা ক্রয়াদেশ অন্য দেশে সরিয়ে নেবে।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা প্রথম আলোকে জানান, ঈদের পর দুই সপ্তাহ শিল্পকারখানা বন্ধ রাখার বিষয়ে সরকারের উচ্চ মহল থেকে আলোচনা করা হয়নি। তবে তাঁরা সিদ্ধান্তটি বিবেচনা করতে সরকারকে অনুরোধ জানানোর চিন্তাভাবনা করছেন। এ জন্য বিজিএমইএতে আজ বুধবার জরুরি সভা হবে।
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে গত এপ্রিলে সরকার বিধিনিষেধ দিলেও রপ্তানিমুখী পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা উৎপাদন চালানোর সুযোগ পায়। সর্বশেষ গত ২৮ জুন শুরু হওয়া সীমিত আকারের ও পরে ১ জুলাই থেকে চলমান কঠোর বিধিনিষেধেও পোশাকসহ অন্যান্য শিল্পকারখানা চালু থাকে। তবে গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা নতুন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঈদ-পূর্ববর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে ১৪ জুলাই মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল পর্যন্ত সব ধরনের বিধিনিষেধ শিথিল থাকবে। এরপর আবার কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হবে, চলবে ৫ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত। এই সময়ে কঠোর বিধিনিষেধে সব ধরনের শিল্পকারখানা বন্ধ থাকবে।
চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘ঈদের পর ২৯ জুলাই এবং ২, ৩ ও ৫ আগস্ট আমাদের ১০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে হবে। ঈদের পর কারখানা যদি খুলতে না পারি, তাহলে পণ্যগুলো প্রস্তুত ও রপ্তানি করা সম্ভব নয়। সরকারের প্রজ্ঞাপনের পর ইতিমধ্যে দুই ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা কারখানা বন্ধের কোনো কথা শুনতে চাচ্ছে না, সময়মতো পণ্য চাচ্ছে।’
করোনার চ্যালেঞ্জের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে আগামী বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুমের পোশাকের প্রচুর ক্রয়াদেশ পাচ্ছেন পোশাকশিল্প মালিকেরা। ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানই আগামী মার্চ পর্যন্ত তাদের কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী ক্রয়াদেশের বুকিং পেয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ সক্ষমতার চেয়েও বেশি। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালে যখন করোনা ছিল না, তার তুলনায় বর্তমানে ৫-১০ শতাংশ বেশি ক্রয়াদেশ আসছে বলে জানালেন কয়েকজন পোশাকশিল্প মালিক।
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, ঈদের পর কারখানা বন্ধ রাখলে ভয়াবহ সমস্যা হবে। প্রথমত, স্বাস্থ্যগত সমস্যা হবে। দুই সপ্তাহের ছুটি পেলে ২৩-৩০ লাখ শ্রমিক পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে ছুটবেন। তাঁদের কোনোভাবেই আটকানো যাবে না। তাতে প্রথমে প্রত্যন্ত এলাকায় ও পরে শিল্পাঞ্চলে করোনা মারাত্মক আকারে ছড়াবে।
ফজলুল হক আরও বলেন, ‘কারখানা বন্ধ থাকলে ব্যবসায় নানামুখী সমস্যা হবে। কনটেইনার ও জাহাজসংকটের কারণে বর্তমানে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছাতে দুই মাস লাগে। অক্টোবর থেকে শীত ও নভেম্বর থেকে ক্রিসমাসের বিক্রি শুরু হবে। ফলে আমরা কারখানা বন্ধ রাখলেও ক্রেতারা কোনো ছাড় দেবে না। তাতে প্রচুর ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার শঙ্কা আছে।’
এবারের শীত মৌসুমে ক্রয়াদেশ ভালোই পেয়েছিল কারখানাগুলো। সে কারণে গত এপ্রিল থেকে পোশাক রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। গত মাসে শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের (২ লাখ ৬৭ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা) পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। করোনার কারণে আগের অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি কমে ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ডলারে নেমেছিল। ওই বছরের শেষ তিন মাস মহামারিতে বিপর্যস্ত হলেও সদ্য বিদায়ী অর্থবছর পুরোটাই ছিল করোনাময়। তারপরও এই অর্থবছরে ভালো করেছে বাংলাদেশ।
ঈদের পর কারখানা বন্ধের ঘোষণায় মালিকেরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বলে জানান বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম। তিনি বলেন, ‘দুই সপ্তাহ কারখানা বন্ধ রাখলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। বিপুলসংখ্যক ক্রয়াদেশ বাতিল ও মূল্যছাড়ের ঘটনা ঘটবে। কারণ, ইউরোপ ও আমেরিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। পোশাকের ব্র্যান্ডের দোকানে বিক্রিও বেড়েছে। ফলে তাদের বর্তমানে প্রচুর পোশাক দরকার। যেকোনো মূল্যে তারা দ্রুত পণ্য চাচ্ছে।’
বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের প্রজ্ঞাপনের পর বেশ কয়েকজন মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রত্যেকেই বলেছেন, কারখানা দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকলে তাঁরা দেউলিয়া হয়ে যাবেন। কারণ, মহামারিতে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ এসেছে। প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। দামও আগের চেয়ে ভালো। কারখানা বন্ধ থাকলে সবকিছুই হুমকিতে পড়ে যাবে। তারপরও করোনা মোকাবিলায় সরকার যদি কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্তে অটল থাকে, আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করব।’
লেখক: শুভংকর কর্মকার
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুলাই ১৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,