লেখক: জুমার্ত ওতোরবায়েভ কিরগিজস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী
তালেবানের কাবুল নিয়ন্ত্রণ ও সেখানকার সরকার পতনের দিনরাতগুলো বিস্ময়কর রকম শান্ত হয়ে এসেছে। সাধারণ আফগানরা তাদের বাড়িঘরে লুকিয়েছে। তালেবান পুলিশ বাহিনীর মতো কাজ করছে। অপেক্ষাকৃত নীরব এই সময়ে, আফগানরা চূড়ান্ত একটি উপলব্ধির মুখোমুখি হয়েছে। তারা কার্যত এখন সম্পূর্ণ নতুন একটা দেশে বাস করছে।
আফগানিস্তান থেকে সব আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্তে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেই বক্তব্যে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা যে ধারণা দিয়েছিলেন তার থেকে ‘অনেক দ্রুত’ সবকিছু ঘটে গেছে। বাইডেন মনে করেন, এটা ঘটেছে। কারণ, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনিসহ রাজনৈতিক নেতারা ‘হাল ছেড়ে দিয়ে দেশ থেকে পালিয়েছেন’ এবং ‘লড়াই ছাড়াই আফগান সেনাবাহিনী ভেঙে পড়েছে’।
গেল সপ্তাহে কাবুলের ক্ষমতার গলিতে যা-ই ঘটুক না কেন, এখন সেখানকার ক্ষমতা তালেবানের অধিকারে। কিন্তু তালেবান কারা? তাদের পরাজিত করার জন্য দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ক্ষমতাধর দেশটি দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে। আফগান জনগণ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ফের তাদের ক্ষমতায় আসার অর্থ কী?
তালেবান একীভূত কোনো শক্তি নয়। সংঘাতের স্বার্থকে কেন্দ্র করে একত্র হওয়া বহুরূপী গ্রুপ। দোহার কার্যালয়ে প্রতিনিধিত্ব করা ‘সভ্য’রাজনৈতিক প্রতিনিধি, প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা ও মাঠের অসংখ্য যুদ্ধবাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তফাত রয়েছে। তালেবানের কোন অংশ প্রভাব বিস্তার করছে, সেটার ওপর আফগানদের ভবিষ্যৎ চূড়ান্ত অর্থে নির্ভর করছে। এ কারণে আরও বেশি মধ্যপন্থী তালেবান নেতাদের চিহ্নিত করা ও সমর্থন দেওয়া জরুরি।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ভালো খবর হচ্ছে, তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও রাজনৈতিক প্রধান মোল্লা আবদুল গনি বারাদার আফগানিস্তানের নতুন নেতা হতে যাচ্ছেন। বাস্তববাদী, অভিজ্ঞ ও চিন্তাশীল নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছেন। তালেবানের প্রভাবশালী গ্রুপগুলোকে একত্র রাখার সক্ষমতা তাঁর রয়েছে। আন্তর্জাতিক কুশীলবদের সঙ্গে দর-কষাকষির যোগ্যতাও তিনি দেখিয়েছেন। ১৭ আগস্ট তিনি আফগানিস্তান পৌঁছে গেছেন।
উপরন্তু তালেবান নেতারা একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসলামি সরকার’ গঠনের অঙ্গীকার করেছে। তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহিন জানিয়েছেন, এ ধরনের সরকারে তালেবানের বাইরের অনেককে যুক্ত করা হবে। আফগানিস্তানের ‘অতি পরিচিত মুখ’ হিসেবে পরিচিতরা সেখানে যুক্ত হবেন। সবার আগে শোনা যাচ্ছে আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের নাম। এরই মধ্যে তিনি ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের জন্য একটি সমন্বয় কাউন্সিল গঠন করেছেন।
অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের পাশাপাশি তালেবানের এখন উচিত পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করা। বাকি বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা এখন তাদের সামনে বড় কাজ। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সবচেয়ে আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে তারা। রাশিয়া এরই মধ্যে জানিয়েছে, তারা তালেবানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভকে টেলিফোনে বলেছেন, আফগানিস্তানে ‘তাদের বিধিসম্মত স্বার্থ রক্ষা করা উচিত’। মধ্য এশিয়ার প্রতিবেশীদের থেকেও তালেবানের বন্ধু বেছে নিতে হবে।
আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা সেখানে কী নীতি নিচ্ছে, সেটার ওপর। আফগানিস্তানে আমেরিকার অপমানকর পরাজয় এবং বিশৃঙ্খল পশ্চাদপসরণ তাদের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এখন প্রশ্ন
দেখা দিয়েছে আফগান জনগণের মঙ্গলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কতটা কিংবা আদৌ কোনো দায়িত্ব পালন করবে কি না। আপাতত বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের যে ওয়াদা তালেবান দিয়েছে, তার কতটা বাস্তবায়ন করছে সেটা তারা দেখছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের জন্য অনেক কিছু করার আছে।
এখন প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আফগান স্বার্থসংশ্লিষ্ট সমস্ত অংশীজনকে নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ভূমিকা থাকতে হবে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ছায়াতলে দাতা দেশগুলোকে অবশ্যই একত্র হতে হবে। আফগানিস্তানের পুনর্গঠনের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনে সহযোগিতা করতে হবে।
কূটনৈতিক স্তরে কেউ পছন্দ করুক আর না–ই করুক, মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার একটা গভীর প্রভাব রয়েছে। আফগানিস্তান পুনর্গঠনের জন্য তাদের মূল ভূমিকা নিতে হবে। পশ্চিমারা যদি এ পথ মেনে নেয়, তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কও ভালো হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জুমার্ত ওতোরবায়েভ কিরগিজস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ২২,২০২১
রেটিং করুনঃ ,