লেখক: সুরজিৎ রায় মজুমদার, কানাডা।
ইংরেজিকে সাহিত্যপাঠ হিসেবে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘বিষয়’ বলে কতখানি গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা দরকার আছে। বিশেষ করে এ উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে। ১৯২১ সালে ব্রিটিশশাসিত তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ এবং ‘ইংরেজি’ চলে এসেছে প্রশ্নাতীত ঐতিহ্য হয়ে। এর প্রয়োজনীয়তা বা প্রয়োজন বলে ধরে নিলেও তার ধরন-ধারণ কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে কোনো সমীক্ষা কখনো হয়েছে বলে জানা যায় না। ইংরেজি বলে কথা। ‘ইংরেজি’ আসলে ‘কলা’ না ‘বিজ্ঞান’, আমার জানামতে সে প্রশ্নও আমাদের দেশে কখনো ওঠেনি, কোনো সমাধানও হয়নি। ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আর্টস’ বলে চলত, আমাদের এখানেও চোখ বুজে সেভাবেই চালানো হয়েছে। ‘সাহিত্য’ হলে ‘আর্টস’ ঠিকই। কিন্তু ‘ভাষাশিক্ষা’ হলে আর বিশুদ্ধ ‘আর্টস’ থাকে না, সেটাও বিবেচনায় রাখা দরকার।
ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়টি শুরু হয়েছিল ভাষাশিক্ষা হিসেবে, লাতিনের মডেলে। আস্তে আস্তে তা পুরোপুরি সাহিত্য অধ্যয়নে মোড় নিল কী করে, তা গবেষণার বিষয়। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে ক্ল্যাসিক্যাল হিউম্যানিজম একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। সেকালে ‘গ্রামার স্কুলে’ পড়ার সুযোগ পেত শুধু সম্ভ্রান্তরা এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল উচ্চচিন্তার ও সংস্কৃতিবান মানুষ হওয়া, যারা সমাজকে পরিচালিত করবে। এর জন্য উচ্চাঙ্গের সাহিত্য অধ্যয়ন খুব প্রয়োজনীয় মনে করা হতো।
এটি গেল সম্ভ্রান্তদের কথা। কিন্তু অ-সম্ভ্রান্তদের বিষয়টা কেমন? কর্মসংস্থানের খাতিরে ভাষার জন্য ভাষাশিক্ষার ধারা আরও পরে এসেছে ইউরোপে, যখন আন্তদেশীয় যোগাযোগের জন্য ভাষাশিক্ষার দরকার পড়েছে। আমাদের দেশে অবশ্য চাকরির জন্য ভাষাশিক্ষার ইতিহাস অনেক পুরোনো। ভারতবর্ষে মেটামুটি মুসলিম শাসনকালের শুরু থেকে ১৮৩৭ পর্যন্ত হিন্দুরা ফারসি ভাষা শিখত দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা হিসেবে শুধু রাজদরবারে চাকরি পাওয়ার জন্য। উপমহাদেশে চাকরির জন্য ভাষাশিক্ষার ইতিহাস সেখানে শুরু। এ প্রসঙ্গে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আধুনিক কালে আমরা যখন ‘অন্য ভাষা’ বা ‘দ্বিতীয় ভাষা’শিক্ষার ইতিহাস বিবেচনা করি, তখন অভ্যস্ততার খাতিরে ইংরেজিটাই শুধু সামনে নিয়ে আসি। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা টোল এবং মক্তব-মাদ্রাসায় চালু যথাক্রমে সংস্কৃত ও আরবি-ফারসিকে কখনো বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু হিসাব করলে আমাদের দ্বিতীয় ভাষাশিক্ষার ইতিহাস ইউরোপের লাতিন শিক্ষার ইতিহাসের চেয়ে প্রাচীন, যা প্রায়ই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। আর মুসলিম যুগে চাকরির জন্য হিন্দুদের ফারসি শেখার পেছনে অর্থনীতি আর রাজনীতি যুক্ত ছিলই। ১৮৩৫-এর ‘মেকলে মিনিট’ এবং ১৮৩৭-এ ফারসির পরিবর্তে ইংরেজিকে সরকারি চাকরির বাধ্যতামূলক ভাষা করে ফেলার পেছনেও সেই ভাষার রাজনৈতিক অর্থনীতির আঁচ পাওয়া যায়। কারণ, এর ফলে ফারসিকেন্দ্রিক ঐতিহ্যের কারণে সরকারি চাকরি-উপার্জন ও অর্থনীতিতে এগিয়ে থাকা মুসলমানরা রাতারাতি পেছনের সারিতে চলে যায় আর পেছনে থাকা হিন্দুরা ক্রমে চলে আসে সামনের কাতারে। ফারসিকে হারানোর শোকে মুসলমানরা একরকম অভিমান করে ইংরেজিকে বর্জন করে প্রায় এক শতাব্দী ধরে স্বেচ্ছায় হিন্দুদের থেকে পেছনে পড়তে থাকে। পরে অবশ্য মুসলমান নেতারা তাঁদের ভুল বুঝতে পারেন এবং সংশোধনের জন্য তৎপর হন। স্যার সৈয়দ আহমদের ভূমিকা, আলীগড় আন্দোলন, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ দাবি এবং ১৯১২-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাবির মধ্যে মুসলমান নেতৃত্বের সে তৎপরতা দৃশ্যমান। এটাও ভাষার রাজনৈতিক অর্থনীতির অঙ্গ।
ইংরেজির ক্ষেত্রে এই ‘ভাষাশিক্ষার’ দিকটি আমাদের দেশে অল্প কিছুদিন এসেছে যেটা, আমার ধারণা, অনেকটা ‘fin de siecle’-এর প্রভাব হিসেবে ২০০০ সালের আগে-পরে। অনেকটা ব্রিটিশ কাউন্সিলের অভিভাবকত্বে ‘Communicative Language Teaching’-এর নতুন curriculum এ সময়ে স্কুলপর্যায়ে চালু করা হচ্ছিল। এর আগে মোটামুটি সাহিত্য পড়তে পড়তেই যার যার সামর্থ্যমতো ইংরেজি ভাষাটা একজন শিক্ষার্থী শিখে নেবে বলে ধরে নেওয়া হতো। কি বিদ্যালয়ে, কি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৬-৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ইংরেজি বিভাগে ভাষাশিক্ষার ব্যাপারটা সেভাবে আসেনি। মাস্টার্সে ’ল্যাঙ্গুয়েজ’ বলে পরিচিত এক বছরের একটি বিকল্প কোর্স পড়ানো হতো, পুরোনো দিনের সিলেবাস সন্ধান করে যাকে ফিলোলজি বলে উল্লেখ থাকতে দেখেছি। এর বাইরে প্রথম বর্ষের সিলেবাসে ইংরেজি ভাষাশিক্ষার জন্য একটা আলাদা ‘পেপার’ আমাদের ছিল। মূলত ক্ল্যাসিক্যাল হিউম্যানিস্ট ধারার গতানুগতিক সাহিত্য অধ্যয়নই রেওয়াজ ছিল। এটা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষাধারার উত্তরাধিকার।
সাহিত্য পড়াটা উদ্দেশ্য হলে বাংলা বিভাগে সাহিত্যের অংশ হিসেবেই ভিন্ন ভাষার সাহিত্য ধরে ইংরেজি বা আরও অন্য সাহিত্যও যুক্ত করা সম্ভব ছিল। আলাদা করে ইংরেজি বিভাগ না হলেও চলত কি না, ভেবে দেখা যেত। কিন্তু বাস্তবে ইংরেজির গুরুত্ব রয়েই গেল ‘রয়্যাল সাবজেক্ট’ হিসেবে, যার মধ্যে ইংরেজ প্রভুর আভিজাত্য মিশে রয়েছে। মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত গাঁওগেরামের শিক্ষার্থীদের জন্য এই প্রভুদের বিষয়টির মধ্যে একটা ‘ক্যালিবান ইফেক্ট’ আছে। পরে সেটা ভেঙে বলছি।
এ প্রসঙ্গে আরও একটু বলতে হচ্ছে আমাদের উপমহাদেশে ইংরেজি শিক্ষার ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নিয়ে। এটা আর নতুন নয় যে মেকলে সাহেব ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষার সূচনা করেছিলেন বাদামি চামড়ার ইংরেজ তৈরি করে একদিকে প্রয়োজনীয় কেরানি সাপ্লাই অব্যাহত রাখতে এবং ঔপনিবেশিক শাসনকে স্থায়িত্ব দিতে। কিন্তু সেটা কীভাবে? সহজ কথায় বললে ইংরেজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভারতবর্ষীয়দের সঙ্গে লোকদেখানো ভাগাভাগি করে নিয়ে। ইংল্যান্ডের একজন ইংরেজ যুবক বা যুবতী ‘শেক্সপিয়ার এবং মিল্টন’ পড়ে। একইভাবে ভারতবর্ষের একজন যুবক বা যুবতীও যখন ‘শেক্সপিয়ার এবং মিল্টন’ পড়বে, তখন বলা যাবে যে তোমরা একই ইংরেজ ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেলে এবং তোমাদের আর ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনো প্রয়োজন নেই। এটিই উপনিবেশে ইংরেজি ভাষার রাজনৈতিক অর্থনীতির একটা অন্যতম দিক। তবে ইংরেজ শাসকের এই কৌশল কাজে লাগেনি। বরং শেক্সপিয়ারের ‘টেম্পেস্ট’ নাটকে ‘হীনমানব’ ক্যালিবান যেমন ঔপনিবেশিক প্রভু প্রসপেরোর ভাষা শিখেছিল প্রভুকে কষে গালি দিয়ে মনের ঝাল মেটাতে, ঠিক একইভাবে ভারতীয় যুবসমাজও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে প্রভুর বিরুদ্ধেই তা সফলভাবে কাজে লাগিয়েছে। এটাই ক্যালিবান ইফেক্ট। গল্পটা অনেকেই জানেন। তবু একটু সূত্রটা ধরিয়ে দিই। প্রসপেরো একজন রাজা এবং ঝড়ে জাহাজডুবির শিকার হয়ে ক্যালিবানের দ্বীপে এসে নিজের জাদুবিদ্যার বলে প্রভু বনে গেছে আর ক্যালিবান হয়ে গেছে চাকর। ক্যালিবানকে প্রসপেরো তার ‘উন্নত’ ভাষা শিখিয়েছে, যাতে চাকর সঠিকভাবে অর্ডারগুলো বুঝে নিয়ে ঠিকমতো প্রভুর সেবা করতে পারে। কিন্তু ক্যালিবানের উদ্দেশ্য ভিন্ন। সে অপেক্ষায় আছে প্রসপেরোর জাদুর বইটা চুরি করে সে বিদ্যা নিজে আয়ত্ত করে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার এবং নিজের দাসত্ব মোচনের। এটিই ভাষার অন্যতম রাজনৈতিক অর্থনীতি। এটাই সব উপনিবেশের একটা ‘মাইক্রোকজম’ বটে। ছোটবেলায় যখন নাটকটির অনুবাদ পড়তাম, তখন প্রসপেরোর কন্যা মিরান্ডা ও অন্য এক রাজপুত্র ফার্ডিনান্ডের ভালোবাসার দিকটা খুব আকর্ষণ করত। সময়ের সঙ্গে বোধের উত্তরণ ঘটে। এখন খুঁজতে ভালো লাগে এই অসামান্য নাটকটির পরতে পরতে উত্তর-ঔপনিবেশিক উপাদান।
ভাষার রাজনীতি নিয়ে আর একটা কথা না বলে অন্য প্রসঙ্গে যেতে পারছি না। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার ফ্রান্সিস বেকন পড়াতে পড়াতে বারবার বলতেন পাশ্চাত্যের ‘প্র্যাগম্যাটিজম’-এর কথা। ‘Knowledge is power’ কথাটা নাকি ফ্রান্সিস বেকনের। এ কথার মর্ম আত্মস্থ করার জোরেই ইংরেজ সারা দুনিয়ায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা পেয়ে যায়। ভৌগোলিক সাম্রাজ্য চলে গেছে। কিন্তু ‘Eurocenrtic knowledge’-এর সাম্রাজ্য এবং বিশেষভাবে ইংরেজি ভাষার সাম্রাজ্য আরও কত যুগ চলবে, তার ঠিক নেই। ইংরেজি এখন আর ব্রিটিশের ভাষা নয় সত্য, কিন্তু ইংরেজি ভাষার ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ তারা কারও হাতে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। ইঙ্গ-অস্ট্রেলীয় একটা গোষ্ঠী ‘IELTS’-এর মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় করপোরেট রাজ কায়েম করেছে। আমেরিকা চালাচ্ছে ‘TOEFL’ দিয়ে। আর ব্রিটিশ কাউন্সিল তো আমাদের মতো দেশগুলোতে টাকা খরচ করে সবক দিয়ে বেড়াচ্ছে, কী করে ইংরেজি শিখতে-শেখাতে হবে। তারা যেভাবে বলবে, সেভাবে করতে হবে। ফ্রি প্রশিক্ষণ দেবে, কিন্তু দেশীয় এক্সপার্টদের স্বাধীন ভূমিকা নিয়ে নীতিনির্ধারণী ক্ষমতায়নে তাদের সায় কম বলে লক্ষ করেছি। এ ব্যাপারে আমেরিকা-ব্রিটেন সব এক।
অতি সম্প্রতি আমার অংশ নেওয়া এক অনলাইন প্রশিক্ষণ কোর্সের অভিজ্ঞতা থেকে একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করব। ২৬টি দেশের স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক প্রায় ৩০ জন ইংরেজির প্রশিক্ষণার্থী ছিলাম সে ফোরামে। ইংরেজি পেডাগজিতে ‘কালচার’ টিচিং এবং ‘ভাষার দর্শন’ বিষয়ে ভার্চ্যুয়াল ডিসকাশন বোর্ডে আমি দুটি মন্তব্য করি। আমি বলেছিলাম যে BICS (Basic Interpersonal Communicative Skill) লেভেল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ‘কালচার সেনসিটিভ’ থাকতে গিয়ে পেডাগজিকে অযথা ‘ওভারবার্ডেন্ড’ করে ফেলতে হয়, যার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কালচার টিচিং শুধু CALP (Cognitive Academic Language Proficiency) লেভেলে থাকাই যথেষ্ট। আমার অন্যান্য মন্তব্যের ক্ষেত্রে উত্তর আমেরিকায় বিশেষজ্ঞ কমপক্ষে, অনেক সময় অপ্রয়োজনেও, যেখানে ৫০ থেকে ১০০ শব্দের মূল্যায়ন রাখেন, সেখানে এই বিশেষ ক্ষেত্রে তিনি টুঁ শব্দটি করলেন না।
প্রথমবার ধরে নিলাম কোনো কারণে তাঁর হয়তো দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়ে থাকবে, যদিও তাঁদের লেভেলের মেন্টরদের কাছ থেকে তা কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার কী বলবেন? আমি বলেছিলাম যে আমাদের মতো দেশে প্রশিক্ষণার্থীদের গভীরভাবে ভাষার দর্শন ও ভাষাশিক্ষার দর্শনের ওপর জোর দেওয়া দরকার যেন আমরা নিজেরাই পশ্চিমাদের সাহায্য ছাড়াই নিজেদের উপযোগী মেথডোলজি এবং পেডাগজি তৈরি করে নিয়ে ইংরেজি শিক্ষা-শিখনের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভশীল হতে পারি। এবারও তিনি আমার মন্তব্যের ওপর একটি কথাও বললেন না, যা আমাকে খুব অবাক করল। ইংরেজির ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষমতায়নের প্রশ্নগুলোতে পশ্চিমাদের এ রকম একধরনের নীরবতাকেও আমি মোটাদাগে ভাষার রাজনৈতিক অর্থনীতির মধ্যেই ফেলতে চাই।
*লেখক: ইংরেজির অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক। শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত অবস্থায় কানাডা প্রবাসী।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুলাই ৩০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,