মাঝখানে কয়েক বছর বিরতির পর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ঢাকায় আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে সরকারি সংস্থাগুলো মনে করছে। বিশেষ করে জঙ্গি–সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২০১৫ সালে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে দ্বিতীয় সচিব ফারিনা আরশাদ এবং ২০১৬ সালেজঙ্গি সংগঠন জেএমবির সঙ্গে লেনদেনের সময় আটক ভিসা কর্মকর্তা মাযহার খানকে প্রত্যাহারের পর আইএসআই নিজেদের লাগাম টেনে ধরেছিল। করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় সারা বিশ্ব যখন ভুল তথ্য ও ভুল খবরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আছে, ঠিক এমন একটা সময়ে আইএসআই এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মতো আইএসআই এবার ঢাকায় বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে ২০০০ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের তখনকার উপহাইকমিশনার ইরফান রাজা ঢাকায় বসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্হিত মন্তব্য করেন। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিবর্তে আওয়ামী লীগের ওপর দায় চাপান। একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিরোধিতা করে ইরফান রাজা সে সময় বলেছিলেন, ‘১৯৭১–এ পাকিস্তানের অর্ধেকটা হারানোর জন্য কি আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত?’ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিষ্টাচারবর্জিত ওই মন্তব্যের জের ধরে ইরফান রাজাকে বাংলাদেশ অবাঞ্ছিত (পারসোনা নন গ্রাটা) ঘোষণা করে। সাধারণত কোনো কূটনীতিককে তাঁর কর্মস্থলে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলে তাঁর আর সে দেশে থাকার সুযোগ থাকে না। ফলে বাংলাদেশ ইরফান রাজাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে দ্রুত ঢাকা ছাড়ার নির্দেশ দিলে ২০০০ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি পাকিস্তানে ফিরে যেতে বাধ্য হন। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইরফান রাজাই একমাত্র কূটনীতিক, যাঁকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের মতো মহামারি মোকাবিলা এবং আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের এ অপতৎপরতা উদ্বেগের বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। কারণ, কোভিড-১৯ মহামারির বিস্তারের ফলে বিশ্বজুড়ে নতুন করে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তালেবানের উত্থান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা। আর ঐতিহাসিকভাবে তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তান সরকার এবং দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) যোগসাজশের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত।
পররাষ্ট্রবিষয়ক মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (সিএফআর) গত মাসের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সাধারণত পাকিস্তানের সরকার এবং সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয়কে সমর্থন করে। তবে তালেবানের প্রতি পাকিস্তানের অব্যাহত এ সমর্থন ঝুঁকিপূর্ণ।
নিউইয়র্কভিত্তিক সিএফআরের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, তালেবানের আর্থিক এবং রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় উৎস হিসেবে পাকিস্তানের ভূমিকা অব্যাহত থাকবে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তালেবানকে অর্থ, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রের জোগান দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসআই)। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে আইএসআইয়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আবার এ হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে তালেবান। পাকিস্তানে তালেবানের মালিকানাধীন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া পাকিস্তানের বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে তালেবান বিপুল অঙ্কের চাঁদা নিয়ে থাকে।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালু করেছে। মূলত আইএসআই নেপথ্যে থেকে ওই গ্রুপের মাধ্যমে ধর্মকে পুঁজি করে প্রতিনিয়ত নানা প্রচারণা চালাচ্ছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাটি কিছু স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে ভুল তথ্যের পাশাপাশি বানোয়াট তথ্য প্রচার করছে।
আইএসআইয়ের এ ধরনের কর্মকাণ্ড নতুন নয়। সম্প্রতি কানাডায় আইএসআই বেলুচিস্তানের মানবাধিকারকর্মীদের নিয়ে এ ধরনের অপকর্ম চালিয়েছে। নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আইএসআই এ ধরনের তৎপরতা চালিয়ে থাকে, সেটা বাংলাদেশের অজানা নয়। অতীতেও আইএসআই বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে প্রতিবেশী একটি দেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর অপচেষ্টা করেছিল। তবে ২০১৫ সালে ফারিনা আরশাদ এবং ২০১৬ সালে মাযহার খানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থানের পর তাদের তৎপরতা কিছুটা কমেছিল।
গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় ইসলামপন্থী বিক্ষোভে মদদ ও সংগঠিত করার সঙ্গে পাকিস্তানের নাম জড়িয়ে পড়ার কথা শোনা যায়। সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্যবাদীদের যোগসাজশে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা চালানো হয়। ওই নাশকতায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার বিষয়ে প্রচার রয়েছে। নাশকতার ওই ঘটনার তদন্তে হেফাজতে ইসলামের একাধিক নেতার সঙ্গে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনগুলোর ঘনিষ্ঠ যোগসাজশের অভিযোগ এসেছে।
ঢাকার বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আইএসআই তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্যের ওপর বিশেষভাবে পুঁজি করছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নানা ধরনের ভুল তথ্য, খবর এবং অপপ্রচার সঠিক তথ্যের চেয়ে অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
গত বছর মধ্যপ্রাচ্যে আইএসআইয়ের এ ধরনের প্রোপাগান্ডা চালানোর বিষয়টির তথ্য জানা যায়। এরপরই টুইটারের একটি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে দেখা গেছে, ভারতের বিরুদ্ধে আইএসআইয়ের হয়ে টুইটারের অ্যাকাউন্টটি চালানো হতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মতো নতুন এক মহামারি মোকাবিলায় সারা বিশ্ব যখন হিমশিম খাচ্ছে, এমন এক পর্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইএসআইয়ের এ ধরনের তৎপরতা উদ্বেগের। সম্মিলিতভাবে মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় যেকোনো ধরনের ভুল তথ্য, মিথ্যা তথ্যের প্রচার বন্ধুদেশগুলো মধ্যে দূরত্ব ও বিভাজন তৈরি করতে পারে, যা চূড়ান্তভাবে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য মঙ্গলজনক নয়।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ১৬, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,