লেখক: রাশেদ মেহেদী।
শক্তিশালী ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে ওঠার পরও ডিজিটাল জীবনযাত্রার মানে পিছিয়েই থাকছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক একাধিক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ডিজিটাল অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। ই-গভর্ন্যান্স, মোবাইল ইন্টারনেটের গতি, ই-নিরাপত্তা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশ পিছিয়ে আছে। ডিজিটাল জীবনযাত্রায় বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সরকারি পর্যায়ে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা ও সেবার ক্ষেত্রে সময়োপযোগী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে অনেক প্রকল্প প্রয়োজন ও বাস্তবতা বিবেচনা ছাড়াই নেওয়া হচ্ছে। অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের পর নিয়মিত পর্যবেক্ষণের অভাবে পরিত্যক্ত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ৫০০-এর বেশি অ্যাপ অকার্যকর হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ডোমেইন ডট বিডি ডিজিটালি সাইনড হয়নি। আইপিভি-৬ ব্যবহারে বাংলাদেশের অগ্রগতি মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। সরকারি কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই ব্যবহার করছেন জিমেইল কিংবা ইয়াহুর মেইল। সরকারি সেবায় অনলাইন ব্যবস্থাপনা চালু হলেও সেগুলো সাধারণ মানুষের সেবা নিশ্চিন্ত করতে পারেনি। এসব কারণে ডিজিটাল অগ্রযাত্রার আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশ এগোতে পারছে না।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সমকালকে বলেছেন, গত ১১ বছরে দেশে শক্তিশালী ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। তবে ডিজিটাল লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হতে এবং দক্ষতা অর্জনে সময় দিতে হবে।
ডিজিটাল জীবনযাত্রার সূচকে অবস্থান: বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান সার্ফশার্ক ডিজিটাল জীবনমানের বিশ্বসূচক প্রকাশ করেছে চলতি মাসেই। সূচক অনুযায়ী ১১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৩তম। এশিয়ার ৩২ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩০তম এবং সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। ডিজিটাল জীবনমানে সার্বিকভাবে গত বছরের চেয়ে স্কোরও কমেছে বাংলাদেশের। গত বছর শূন্য দশমিক ৩৫ স্কোর ছিল, এ বছর তা হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৪। সূচকের বিস্তারিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, মোবাইলের গতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১১০তম, নেটওয়ার্ক রেডিনেসে ১১০তম, ই-অবকাঠামোয় ৮৯তম এবং ই-গভর্ন্যান্সে ৮৬তম, ই-নিরাপত্তায় ১০৩তম, মানসম্পন্ন ইন্টারন্টে সেবায় ৮৯তম, ইন্টারনেট ব্যবহারে আর্থিক সক্ষমতায় ৮৪তম। তবে তিনটি ক্ষেত্রে সূচকে বাংলাদেশ ওপরের দিকে আছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বিস্তৃতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে ৪৪তম এবং স্থিতিশীল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে ১৬তম। এ ছাড়া গতিতে পেছনের সারিতে থাকলেও মোবাইল ইন্টারনেটের স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশ ৫৩তম। এর আগে আরেক বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ওকলার প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে অবস্থান ছিল ১৭৬ দেশের মধ্যে ১৩৭তম। ওপেন সিগন্যালের রিপোর্ট অনুযায়ী ফোরজির গতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সর্বনিম্ন।
যেখানে পিছিয়ে: তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ট্রান্সমিশন অবকাঠামোর অবস্থা ভালো। ডিজিটাল কানেকটিভিটিতেও অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু মানসম্পন্ন ডিজিটাল লাইফ বলতে যে নির্দেশকগুলোকে বোঝায় সেখানে অগ্রগতি নেই। এর বড় কারণ দেশে প্রয়োজন ও বাস্তবতা বিবেচনায় দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করে কয়েক বছর আগে ৫০০টির বেশি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে। কিন্তু সেই অ্যাপগুলো পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। এমনকি এগুলো প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে গেলে নিরাপত্তা সতর্কবার্তা আসে। এই অ্যাপগুলোর যদি প্রয়োজন থাকত তাহলে পরিত্যক্ত হতো না। ই-গভর্ন্যান্সের ক্ষেত্রে একেবারে মৌলিক জায়গাগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক দুর্বল। যেমন আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়ন থেকে আরও কয়েক বছর আগেই ই-নিরাপত্তার জন্য সব দেশেই ইন্টারনেট প্রোটোকল আইপিভি-৬ ব্যবহার করতে পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী ভারত ৭১ শতাংশ ব্যবহার নিশ্চিত করেছে, ভুটান ৬ শতাংশ অর্জন করেছে। তবে বাংলাদেশ মাত্র দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের ডোমেইন ডট বিডি এখন পর্যন্ত ‘ডিজিটালি সাইনড’ নয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ অফিসেই সরকারি কর্মকর্তারা জিমেইল কিংবা ইয়াহু ব্যবহার করেন। অথচ আদর্শ ই-গর্ভন্যান্সের দেশে সরকারি তথ্যের নিরাপত্তার জন্যই সবাই নিজ নিজ দেশের ডোমেইনের ওয়েব মেইল ব্যবহার করে। দেশে অনলাইনে অনেক সেবা চালু করা হলেও শেষ পর্যন্ত সেবা পেতে মানুষকে সেই দপ্তরের সামনে গিয়ে লম্বা লাইন দিতে হয়। ই-টেন্ডার ব্যবস্থাও এখন পর্যন্ত সফল হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ইন্টারনেটের সূচকে সবচেয়ে বেশি মানুষ যে ধরনের ইন্টারনেট ব্যবহার করে তার গতিকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের বেশি সংখ্যক মানুষ ব্যবহার করে মোবাইল ইন্টারনেট, কিন্তু সেই গতিতে আদর্শ মানদণ্ড নিশ্চিত হচ্ছে না। এমনকি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বিস্তৃতির এবং সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রেও সঠিক পরিকল্পনা হচ্ছে না। যেমন সরকারি পর্যায়ে ইনফো গভ, ইনফো সরকার-২ প্রকল্প নেওয়া হলেও এর সুফল পাওয়া নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরপর ইনফো সরকার-৩ বাস্তবায়নে এক বছরের লক্ষ্যমাত্রার জায়গায় তিন বছর লেগে গেছে। কেন এত বেশি সময় লাগল, সমস্যাটা কী ছিল তা পর্যালোচনা করা উচিত ভবিষ্যতের জন্য। একই সঙ্গে এই প্রকল্পের সর্বোচ্চ সুফল যাতে পাওয়া যায় তার জন্যও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ দরকার।
মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের সাবেক মহাসচিব ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ টিআইএম নুরুল কবীর বলেন, সরকারি পরিকল্পনায় ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ পদক্ষেপ গুরুত্ব পায় না। আবার একটা প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর সেটি সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তার সঠিক তদারকি কিংবা পর্যবেক্ষণও হয় না। ফলে প্রকল্পটি কতটা কাজে এসেছে তা যাচাই এবং নতুন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে আগের সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে ওঠারও পদক্ষেপ থাকে না।
অন্য একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি-সংক্রান্ত বেশকিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে কোনো একটি গোষ্ঠীর স্বার্থের বিবেচনায়। এই প্রকল্পগুলো পরবর্তী সময়ে ব্যয়বহুল পরিত্যক্ত প্রকল্পে পরিণত হয়েছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতিতে কাজে আসেনি। বিপুল ব্যয়ে ফোর টায়ার ডাটা সেন্টার হয়েছে, কিন্তু তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা হয়নি। আবার উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণের জন্য কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হলেও সেগুলোর বাস্তব সুফল কতটুকু, তা নিয়েও কখনোই কোনো পর্যালোচনা হয়নি।
ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিম সমকালকে বলেন, ভারতে ইন্টারনেট সেবায় আইপিভি-৬ প্রোটোকল ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে কারণ রিলায়েন্স জিও তাদের ৬০ শতাংশের বেশি নেটওয়ার্ক আইপিভি-৬-এ উন্নীত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে যে ব্যবসায়িক বাস্তবতা তার বিবেচনায় অনেকেই আইপিভি-৬ প্রোটোকল উন্নীত করতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী নয়।
আশাবাদী ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী: ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সমকালকে বলেন, বাংলাদেশে ডিজিটাল অবকাঠামো গত ১১ বছরে গড়ে উঠেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশে পুরোনো পদ্ধতির কৃষিভিত্তিক অর্থনীত, রক্ষণশীল প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার শিল্পকারখানা এমনকি অফিস ব্যবস্থাপনাও চলছে। এ কারণে সূচকে ডিজিটাল জীবনযাত্রার বিষয়টি প্রতিফলিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকারিভাবে ই-নথি চালু করা হলেও সেই ই-নথি ব্যবহারে বেশিরভাগই অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন না। রাতারাতি ডিজিটাল জীবনযাত্রা কিংবা সমাজ গড়ে ওঠে না। ডিজিটাল অবকাঠামো হয়েছে, এরপর ডিজিটাল লাইফস্টাইলও আসবে। ২০০৮ সালে মাত্র ৮ জিবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হতো, এখন প্রায় ২ হাজার ৪০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হচ্ছে। ২০০৮ সালে মাত্র আট লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করত, এখন এক কোটি ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী, প্রায় ১১ কোটি মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছে। এগুলো অবশ্যই বড় অগ্রগতি। এখন প্রয়োজন ডিজিটাল লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হওয়া এবং দক্ষতা অর্জন করা।
সূত্রঃ সমকাল।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ২৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,