আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া শর্ত মেনে, ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। আর আগামী জুনের মধ্যে রিজার্ভের বা বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের প্রকৃত হিসাবায়ন শুরু করতে হবে। পাশাপাশি প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া লেনদেনের সব ক্ষেত্রে ডলারের দাম হবে একটি। সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ ও বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
ব্যাংক খাতে এমন শর্ত পূরণের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়ে আইএমএফ গত সোমবার ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এই ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশ পেয়েছে গত বৃহস্পতিবার। প্রথম কিস্তির পরিমাণ ছিল ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার।
সংস্থাটি বলেছে, ঋণ কর্মসূচি চলাকালে (২০২৬ পর্যন্ত) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুশাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, রাজস্ব স্বচ্ছতা আনা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের পক্ষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এই প্রতিশ্রুতি দেন। ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের পর শর্তসহ আইএমএফের প্রকাশ করা নথি থেকে এসব বিষয় জানা গেছে।
ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ
আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ব্যবহারযোগ্য প্রকৃত (নিট) রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে, যাতে ২০২৬ সালের মধ্যে নিট রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের আমদানি দায় মেটানো যায়। এ জন্য চাহিদা কমানোর পাশাপাশি মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার চালু করা হবে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে বলে প্রত্যাশা বাংলাদেশের।
আইএমএফ নিট রিজার্ভ কখন কততে দাঁড়াবে, সেই হিসাবও দিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, আগামী মার্চে বাংলাদেশের প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়াবে ২২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে, জুনে তা বেড়ে হবে ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আর সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার এবং ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে রিজার্ভ। উল্লেখ্য, ১০০ কোটিতে ১ বিলিয়ন।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলার বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা আছে, যা আইএমএফ রিজার্ভের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত না করার পরামর্শ দিয়েছে। বর্তমান রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি ডলার বাদ দিলে তাতে নিট রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে।
আমদানি দায় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। গত জুলাই থেকে জানুয়ারি—এ সাত মাসে রিজার্ভ থেকে ৯২০ কোটি ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের ইতিহাসে এর আগে পুরো এক অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে এত পরিমাণ ডলার কখনো বিক্রি করা হয়নি। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। রমজানের আগে পণ্যের বাড়তি চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে আমদানি বাড়াতে হবে, এর ফলে আরও বেশি পরিমাণ ডলার বিক্রি করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এর ফলে নিট রিজার্ভ আরও কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি চলাকালে ব্যাংকঋণের সুদহারের বেঁধে দেওয়া সীমাও তুলে নিতে হবে। ইতিমধ্যে ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়িয়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা ব্যাংক খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ১৪ শতাংশ। আর অন্য ঋণে সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে রাখা হয়েছে। ঋণের সুদহার বাড়লে আমানতের সুদহারও বাড়বে। তাতে স্বস্তি পাবেন সুদআয়নির্ভর আমানতকারীরা। তবে ব্যবসায়ীরা এ মুহূর্তে ঋণের সুদহার বাড়ানোর পক্ষপাতী নন। কারণ, যে হারে ব্যবসার খরচ বেড়ে চলেছে, তাতে ঋণের সুদ বাড়লে ব্যবসা–বাণিজ্য বড় ধরনের সংকটে পড়বে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ঋণের সুদহারের সীমা তুলে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে কিছুটা চাপের মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে, তা জুনের মধ্যে বাজারের সমান হতে হবে। এখন ১০২ টাকা দামে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ব্যাংকগুলোতে ডলারের দাম প্রায় ১০৬ টাকা। বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হলে ডলারের দর একটিই (সিঙ্গেল রেট) করা হবে। খাদ্য, জ্বালানি আমদানিতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে ডলারের দাম বাড়লে এসব পণ্যের দামেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
খেলাপি ঋণ কমানোর প্রতিশ্রুতি
আইএমএফকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে ও বেসরকারি খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ চলছে। এ জন্য ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হচ্ছে, যেখানে মূলধন পর্যাপ্ততার হার ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় আইএমএফকে বলেছে, ব্যাংক খাতের আর্থিক পরিস্থিতির দুর্বলতা কাটাতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারি খাতের ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের নীতিমালা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পুরো ব্যাংক খাতের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা জোরদারের কথাও জানানো হয়েছে।
এদিকে আইএমএফকে বাংলাদেশ আরও বলেছে, ব্যাংকের পুনঃ তফসিল করা ঋণকে খেলাপি ঋণের হিসাবের আওতায় আনা হচ্ছে, যা আগামী জুনের মধ্যে কার্যকর হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে এই তথ্য থাকবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনে ঝুঁকি ও খেলাপি ঋণের তথ্য সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে। যেখানে পুনঃ তফসিল করা ঋণের তথ্য থাকবে, যার বিপরীতে যথানিয়মে নিরাপত্তা সঞ্চিতিও রাখা হবে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক, বিডিবিএল—এই ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের গড় হার ২৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গত জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে ঋণ প্রস্তাব দেওয়ার পর ছয় মাস ধরে খেলাপি ঋণ কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোকে প্রতিবছর খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আবার বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় সমন্বয়ক ও পর্যবেক্ষকও বসানো হয়েছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমাতে নীতিছাড়ও দিয়েছে। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ না কমিয়ে নগদ আদায় করতে হবে। তাহলেই এই খাতের প্রকৃত উন্নয়ন হবে। নতুন করে যেসব ঋণ দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে দিতে হবে।
এ বিষয়ে সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফ যেসব শর্ত দিচ্ছে, তা খুবই প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের এসব শর্ত যথাযথভাবে পালন করা উচিত। এতে খাতটি ঠিক হবে।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ফেব্রুয়ারী ০৪, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,