একজন কৃষকের স্ত্রী। রাহেলা খাতুন। ঢাকা- বগুড়া মহা-সড়কের ঠিক পাশে দুইটা কুঁড়ে ঘর নিয়ে তাঁর বাড়ি, সংসার। প্রিয় স্বামী, পুত্র ও কণ্যা – একজন ছয় বছরের আর একজন এক বছরের। বাড়িতে দুইটা গরু। একটা ছাগোল, দুইটা মুরগি। রান্না করার কিছু সামগ্রী, কিছু কাপড়-চোপড়। আরো সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র, যেমন কূলা, ছাড়ু, হাত পাখা ইত্যাদি। আর কিছু সখের জিনিস, সুই, রঙিন সুতার রুমাল। এই সব নিয়ে রাহেলা খাতুনের সংসার। সুখি মানুষদের যে সহজ সংজ্ঞা, সেই সংজ্ঞার সাক্ষী, উদাহরণ, প্রমান রাহেলা খাতুন।
ভোরের আজানের সাথে সাথে নামাজ। প্রিয় স্বামীও উঠে যান একই সময়ে। নামাজ শেষে গরু দুটাকে আর ছাগোল টাকে একটু আদর, কিছু খাবার দিয়ে, দিনের কাজ শুরু। মুরগির ঘরটি খুলে দেওয়া। একটু ভালো সকাল হলে গরু দুটাকে আর ছাগোল টাকে মাঠে বেঁধে আসা।
প্রিয় সন্তান দুটাকে ঘুম থেকে তোলা। সংসারের সকালের খাবার তৈরী, ছেলের স্কুল। ছোট্ট মেয়ের দুধ। দুপুরের খাবারের আয়োজন। ছেলে- মেয়েদের গোছল, নিজের গোছল। দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ। বিকালের বেশ আগে বিছানায় একটু কাৎ হয়ে শুয়ে থাকা। পুরানা দিনের কথা ভাবা। কখনো সন্তানদের বেড়ে উঠার কথা। বিকালে পড়শির বউ ও বড় বড় মেয়েদের সাথে একটু কথা বলা। সন্ধ্যার আগে গরু দুটাকে আর ছাগোল টাকে ঘরে আনা।
সন্ধ্যার ঠিক পরে পরেই স্বামীর ঘরে ফেরা। ছেলের লেখা-পড়াও শেষ। মেয়েটা আগেই ঘমিয়েছে। রাতের খাওয়ার তৈরী হয়েছে। স্বামী, ছেলে সন্তান সহ এক সাথে রাতের খাবারও খাওয়া শেষ। কাল ছেলেকে সকালে স্কুলে যেতে হবে। ছেলেও ঘুমিয়েছে। ছেলের বই, স্কুলের পোশাক রেডি করা আছে।
কাল সকালে, ফজরের আজানের সময় ঘুম থেকে উঠতে হবে। স্বামীর সাথে গল্প করতে করতে রাহেলা খাতুন ঘুমিয়ে পড়েছে।
এমনি করে করে রাহেলা খাতুনের জীবন চলে। সুখি জীবন। সবই একই রকম। শুধু চোখে পড়ে গরমের পরে বর্ষা, এর পর শীত আবার শীতের পরে গরম। মাঝে যে শরৎ কাল, হেমন্ত কাল আর বসন্ত কাল থাকে রাহেলা খাতুনের তা চোখে পড়ে না।
রাহেলা খাতুনের চোছে পড়ে মেয়েটা বেশ দ্রুত বেড়ে উঠছে। ছেলেটাও বাড়ছে, তবে মেয়েটার মত নয়। কয় দিন আগেও মেয়েটি শুধু বসতো এখন একা একা হাঁটে।
রাহেলা খাতুনের জীবন সুখের হোক আর সাদামাটা জীবন হোক তাঁর জীবন একটি বৃত্তে আটকিয়ে গেছে। আর কোন না কোন ভাবে রাহেলা খাতুন একটি বৃত্ত এঁকে রেখেছেন নিজের জন্যে। নিজের অজান্তে।
তিনি ইচ্ছা করলেও সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠতে পারবেন না। ইচ্ছা করলেও গরু- ছাগোলকে ঘরে আটকিয়ে রাখতে পারবেন না। ইচ্ছা করলেও ঘরে টিভি, ডিস এনে সিরিয়াল দেখতে পারবেন না। নিয়মিত চুলে শেম্পু। চুল আয়রণ করাতে পারবেন না। হাতে নকশা করে মেহেদীও দিতে পারবেন না। ছেলে মেয়েদের নিয়ে চাইনিজও খেতে পারবেন না
নিজের অজান্তে, রাহেলা খাতুন একটি বৃত্ত এঁকে রেখেছেন নিজের জন্যে।
রাহেলা খাতুন তাঁর জীবনে অতি দ্রুত জ্যামিতির কিছু কিছু সূত্র ভাঙতে পারলে হয়তো সিরিয়াল দেখতে পারতেন। চুলে শেম্পু। চুলে আয়রণ করাতে পারতেন। হাতে নকশা করে মেহেদীও দিতে পারতেন। বেলাউজের সাথে শাড়ি, শাড়ির সাথে স্যন্ডেলের রঙও মেলাতে পারতেন।
ক্লিক ক্লিক করে ছবিও তুলতে পারতেন্। পরের যে প্রজন্ম আসবে তাঁদের জন্য রেখে যাওয়া ছবি। যে ছবি কথা বলত। ইতিহাস বলত। কেমন সুন্দরী ছিলেন ঠিক দেখতে তাঁদের প্রিয় দাদী বা নানী। বা তার পরের প্রজন্ম অথবা প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
রেটিং করুনঃ ,