দক্ষিণ আফ্রিকা তো বটেই, বিশ্বজুড়ে অবিসংবাদী নেতা হিসেবে খ্যাত নেলসন ম্যান্ডেলা। এই নেতার সংস্পর্শে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের একজন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যে নামগুলো উচ্চারিত হয়, তাঁদের অন্যতম জুমা। তাঁকে ‘নেলসন ম্যান্ডেলার কমরেড’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। সেই জুমা এখন কারাগারে। দুর্নীতির তদন্তে সমন পাওয়ার পরও আদালতে হাজির না হওয়ায় কারাদণ্ডে দণ্ডিত তিনি।
জুমার রাজনীতি শুরু যে দলের হাত ধরে, তার নেতা ছিলেন ম্যান্ডেলা। ১৯৪২ সালে জন্ম নেওয়া জুমা ১৯৫৯ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সশস্ত্র সংগঠনে যোগ দেন। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে ম্যান্ডেলার মতো জুমাও কারাবরণ করেছিলেন।
যান্ডেলার মতো জুমাও ছিলেন রোবেন দ্বীপে।
১৯৭৩ সালে জুমার কারাবাস শেষ হয়। মুক্তি পেয়ে তিনি অন্তরালে চলে যান। তবে শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল ছিলেন তিনি। তাই গ্রেপ্তার এড়াতে ১৯৭৫ সালে দেশ ছেড়ে পালান। প্রথমে সোয়াজিল্যান্ড, পরে মোজাম্বিকে থেকে এএনসির হয়ে কাজ করেন। ১৯৭৭ সালে এএনসির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন জুমা।
জুমার বিষয়ে একপর্যায়ে মোজাম্বিকের ওপর চাপ প্রয়োগ করে দক্ষিণ আফ্রিকা। ফলে তিনি মোজাম্বিক ছাড়তে বাধ্য হন। চলে যান জাম্বিয়ায়। দায়িত্ব পান এএনসির আন্ডার গ্রাউন্ড ও গোয়েন্দা শাখার। দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এলে ১৯৯০ সালে দেশে ফেরেন জুমা। তাঁর দেশে ফেরা তখনই সম্ভব হয়েছিল, যখন দেশটির সরকার এএনসির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ঐতিহাসিক নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে সব বর্ণের মানুষেরা অংশ নিতে পারে। আর এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতির ‘পরশপাথর’ ম্যান্ডেলা ক্ষমতায় আসেন। নির্বাচন ও সরকার গঠনের ক্ষেত্রে জুমার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
এএনসির রাজনীতিতে জুমা যেমন সক্রিয় ছিলেন, তেমনি ছিলেন সরকারেও। তিনি ম্যান্ডেলা সরকারের হয়ে কাজ করেন। ম্যান্ডেলা পরবর্তী প্রেসিডেন্ট থাবো এমবেকির ডেপুটি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া ১৯৯৭ সালে এএনসির ভাইস প্রেসিডেন্ট হন তিনি। এসব ক্ষেত্রে তিনি ম্যান্ডেলার সমর্থন পান।
ক্ষমতার রাজনীতিতে জুমার যখন উত্থান হয়, তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি ব্যবসায়িক পরিবারের উত্থান ঘটে। এটি ‘গুপ্ত পরিবার’ নামে পরিচিত। পরিবারটির মুখপাত্র হারানাথ ঘোষের দেওয়া তথ্য অনুসারে, দক্ষিণ আফ্রিকায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গুপ্ত পরিবারের তিন সদস্য অজয়, অতুল ও রাজেশ সেখানে যান। কারণ, তাঁদের বাবা শিব কুমার গুপ্তের ধারণা ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে উঠবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশ। পরিবারটির সঙ্গে জুমা ও এএনসির ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
জুমা পরবর্তী সময়ে যেমন রাজনৈতিকভাবে প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছেন, তেমনি গুপ্ত পরিবারের ব্যবসাও দক্ষিণ আফ্রিকায় ফুলেফেঁপে উঠেছে। খনি, প্রযুক্তি, গণমাধ্যম, বিমান পরিবহনসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে গুপ্ত পরিবারের। জুমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে এই পরিবারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। জুমার সরকারের ওপর এই পরিবারের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ ছিল। এমন অভিযোগও চাউর হয় যে জুমার মন্ত্রিসভায় পর্যন্ত গুপ্ত পরিবারের সদস্যরা হস্তক্ষেপ করতেন। এই পরিবারের যোগসাজশে জুমা একাধিক দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
অন্য অনেক রাজনীতিবিদের মতো জুমাও ‘নীতিবাক্য’ ছাড়তেন। যেমন—১৯৯০ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘অস্ত্র ছাড়া যোদ্ধা যেমন, তেমনি পড়াশোনা ছাড়া মানুষ। জীবনে টিকে থাকার যুদ্ধে আপনি শিক্ষা ছাড়া লড়াই করতে পারবেন না। আপনি যদি শিক্ষিত হন, তবেই বাধাবিপত্তি পেরোতে পারবেন।’ কিন্তু জুমার এমন বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর কাজের বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। তাঁর সরকারের সময় দেশটির শিক্ষাব্যবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। তা ছাড়া তাঁর আমলে শিক্ষা খাত ছিল অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত। যদিও এসব অভিযোগ জুমা বরাবর অস্বীকার করেছেন।
জুমা ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তাঁর স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। তার পরিবর্তে সাত-আট বছর বয়স থেকে তাঁকে খামারে কাজ করতে হতো। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর মাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে। সেই জুমা ক্ষমতায় আসার পর সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। যার প্রমাণ তাঁর গ্রামের ব্যয়বহুল বাড়ি। এই বাড়ি নির্মাণে তিনি খরচ করেছেন ২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। এই অর্থ দুর্নীতি থেকে পাওয়া বলে অভিযোগ আছে।
জুমার আমলে অস্ত্র কেনাকাটা, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ ওঠে। নিজের দায় ঢাকতে তিনি একের পর এক মন্ত্রীকে পদচ্যুত করেছেন বলে নিন্দুকেরা বলে থাকেন। তাঁকে পদচ্যুত করতে একাধিকবার অভিশংসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি কোনো রকমে টিকে গিয়েছিলেন।
জুমা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ। তবে শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে ২০১৮ সালে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।
বর্ণবাদবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একসময়ের সংগ্রামী জুমা এখন এক পুরোপুরি ভিন্ন কারণে কারাবন্দী। দুর্নীতির তদন্তে হাজির না হয়ে আদালত অবমাননার দায়ে এখন তিনি ১৫ মাসের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। তাঁর এই কারাবরণকে আইনের শাসনের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি এই বার্তা দিচ্ছে যে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন, এমনকি কোনো সাবেক প্রেসিডেন্টও নন।
জুমার আজকের পরিণতির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন হলো, তিনি তাঁর গুরুর কাছ থেকে শিক্ষা নেননি। উল্টো তিনি তাঁর আমলে দেশকে নানাভাবে পিছিয়ে দিয়েছেন। ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক দর্শনে অটল থাকলে হয়তো আজ তাঁকে গারদে সময় কাটাতে হতো না।
তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স, ব্রিটানিকা ডটকম, এসএ হিস্ট্রি ডট ওআরজি, বিবিসি, জুমা: এ বায়োগ্রাফি এবং বায়োগ্রাফি ডটকম
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুলাই ১১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,