নাৎসিবিরোধী বিখ্যাত জার্মান কবি মার্টিন নিম্যোলারের ‘ওরা প্রথমত এসেছিল’ কবিতার কয়েকটি লাইন পড়ে শুনিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সবাইকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, আজকে ওই কবিতার মতো অবস্থা হয়েছে এই দেশের। এখন সবার দায়িত্ব সকলে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। যদি না হয়, তাহলে কেউ মাফ পাবেন না।
আজ শনিবার বিকেলে ঢাকায় রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে দলের অবস্থান কর্মসূচিতে সাংবাদিক নিপীড়নের প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম এসব কথা বলেন। সারা দেশের সব জেলা ও মহানগরে আজ বেলা ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি হয়।
বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদে ও সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি এই কর্মসূচি পালন করে।
ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পরে জার্মানির বিখ্যাত কবি মার্টিন নিম্যোলা “ওরা প্রথমত এসেছিল” কবিতাটি লিখেছিলেন। আমি লোভ সামলাতে পারছি না এই কবিতার একটি অংশ আপনাদের শোনানোর জন্য। কারণ, কবিতাটা আমাদের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক।’
মির্জা ফখরুল অবস্থান কর্মসূচিতে পড়ে শোনান সেই কবিতা—
ওরা প্রথমত এসেছিল
যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ, আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এল ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে, আমি তখনো চুপ করে ছিলাম,
কারণ, আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে, আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ, আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এল আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোনো কথা বলল না,
কারণ, কথা বলার মতো তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই এর (কবিতা) ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানেন। জার্মানের ইহুদিদের হত্যা করার জন্য হিটলারে গেস্টাপো বাহিনী যখন এক এক করে কমিউনিস্ট, সাংবাদিক, লেখক, শ্রমিক—যারা সত্য কথা বলে, তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কেউ কেউ নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিরোধিতা করেনি, কোনো কথা বলেনি। তাকে যখন ধরে নিতে এল, তখন তার পক্ষে কথা বলার মতো কেউ ছিল না।
মির্জা ফখরুল বলেন, আজকে এই অবস্থা এই দেশের হয়েছে। আজকে এক এক করে যারা এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছে, তাদের তারা ধরে নিয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, গুম করেছে, হত্যা করেছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, সাংবাদিক শফিক রেহমান, সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তাঁদের অত্যাচার করেছে, গ্রেপ্তার করেছে, দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেছে। আবুল আসাদকে দীর্ঘকাল কারাগারে আটক রেখেছিল। অনেকে তখন কথা বলেননি।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকে দেখেন মতিউর রহমান সাহেব, প্রথম আলো এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। তাঁর নামে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা দিয়েছে। সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। আমরা আছি বলে এখনো কথা বলছি, এ দেশের মানুষ কথা বলছে। তাই আমি সাবধান বাণী উচ্চারণ করতে চাই সব মানুষের কাছে। এখনো সতর্ক হোন, যারা বেআইনিভাবে জোর করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ভিন্নমত পোষণকারীদের হত্যা করছে, গুম করছে, নির্যাতন করছে, কারাগারে নিচ্ছে, তাদের হাত থেকে আপনারাও মাফ পাবেন না। একদিন না একদিন তারা আপনাদেরও ধরবে। তাই সবার দায়িত্ব সকলে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।’
এইবার জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে
গত বুধবার নির্বাচন কমিশনে একটি বৈঠকের উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, নির্বাচন কমিশনে পরশু দিন একটা মিটিং হয়েছে। সেই মিটিংয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেন, নির্বাচনের সব ব্যবস্থা গ্রহণ করো, প্রয়োজনে আগাম নির্বাচনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করো। অর্থাৎ, তারা এখন ভিন্ন কৌশল নিতে চায়। আগাম নির্বাচন করে গোটা জাতিকে বোকা বানিয়ে তারা আগের মতো নির্বাচন করতে চায়।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, এইবার জনগণ আপনাদের কোনো কৌশলই সফল হতে দেবে না। আপনাদের কোনো ফাঁদে তারা পা দেবে না। এবার জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলে আপনাদের সব ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেবে।’
ফখরুল বলেন, এই সরকার গণতন্ত্র মানে না। মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেয় না। তার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় টিকে থাকা। জোর করে বন্দুক-পিস্তল দিয়ে তারা ক্ষমতায় টিকে আছে। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে যারা জনগণের বেতন দিয়ে জীবন চলে, তারা আজকে সহযোগিতা করছে। কিন্তু এই দেশের মানুষ কখনো অন্যায় মেনে নেয়নি।
সাধারণ মানুষ অত্যন্ত কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করছে বলে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, তারা আজকে না খেয়ে থাকে। অথচ সরকার মানুষকে বোকা বানানোর জন্য, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে মিথ্যা তথ্য তৈরি করে দেখাতে চায় যে এই সরকারের উন্নয়নে বেকারের সংখ্যা গত তিন বছরে কমে গেছে ২৬ শতাংশ। তিনি বলেন, ‘কী মিথ্যা কথা। আমার কথা না, এ দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদেরা বলছেন যে এগুলো সঠিক তথ্য নয়, এগুলো সব সাজানো তথ্য। এভাবে মানুষে বোকা বানিয়ে প্রতারণা করে এই সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে। ’
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘জনগণ যেভাবে জেগে উঠছে, আমরা নিশ্চিত এই সরকারকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে। এবং জনগণের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তারা পরাজিত হবে।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আজ দেশের অবস্থা কী, দ্রব্যমূল্যর অবস্থা কী। গরিব মানুষ খেতে পায় না। আর আওয়ামী লীগের সিন্ডিকেট ধনী থেকে আরও ধনী হয়েছে। তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একজন রিকশা চালকের বক্তব্য ‘টানা তিন মাস মাছ, মাংস খাইতে পারি নাই’ তুলে ধরে বলেন, ‘এর থেকে বাস্তব সত্য কথা আর কোনো কিছু হতে পারে না। এই সত্য কথা বলতে গিয়ে সাংবাদিকেরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। সে কারণে আমরা রমজানের মধ্যেও অবস্থান কর্মসূচিতে আসতে বাধ্য হয়েছি।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বলেন, ‘ছেলেটা তার রিপোর্টে দারিদ্র্যের কথা বলেছে, ক্ষুধার কথা বলেছে। এই কারণে কী ছেলেটাকে গ্রেপ্তার করতে হবে? মামলা দিতে হবে? এটা সহ্য করা যায় না। আপনারা এত দিন সাধারণ মানুষের গায়ে হাত দিয়েছেন। যারা জনগণের কথা তুলে আপনারা তাদের গ্রেপ্তার শুরু করেছেন। সাহস অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু এই দেশের মানুষ কখনো এ ধরনের অপসাহসী শক্তিকে প্রশ্রয় দেয় নাই, কথাটা মনে রাখবেন।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালামের সভাপতিত্বে অবস্থান কর্মসূচিতে আরও বক্তব্য দেন মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, কেন্দ্রীয় নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন প্রমুখ।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:এপ্রিল ০২, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,