সংবাদ সম্মেলন ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে। তবে দেশের রাজনীতি, ড. ইউনূস প্রসঙ্গসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
—————————-
জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জনগণের ভোটে যারা জয়ী হবে, তারাই সরকারে আসবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরেছেন গত রোববার।
সংবাদ সম্মেলনে প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ব্রিকস সম্মেলনসহ কোন কোন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন, কার কার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সফরের অর্জন নিয়ে সূচনা বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। এতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে দেওয়া নোবেল বিজয়ীদের চিঠি সম্পর্কে প্রশ্নের জবাব দেন শেখ হাসিনা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সিন্ডিকেটের ভূমিকা ও বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
একজন সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, অনেকেই আগামী নির্বাচনটা অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়। অংশগ্রহণমূলক করতে আপনি কী উদ্যোগ নেবেন?
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অংশগ্রহণটা কার অংশগ্রহণ? আমার কাছে অংশগ্রহণ হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ। জনগণ ভোট দেবে। সেই ভোটে যারা জয়ী হবে, তারা সরকারে আসবে।’
বিরোধী দলের অংশগ্রহণ প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অংশগ্রহণ বলতে কাদের অংশগ্রহণ? ভোট চোর, ভোট ডাকাতদের? দুর্নীতিবাজ, মানি লন্ডারিং, খুনি, ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলাকারী, জাতির পিতার হত্যাকারী, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী—তাদের অংশগ্রহণ? এটা কি জনগণ চায়? তারা অংশগ্রহণ করলেই বৈধ হবে। আর অন্য কেউ করলে হবে না, এটা তো হতে পারে না।’
বিএনপির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি তো মাত্র ৩০টা সিট (সংসদের আসন) পেয়েছিল। এর পর থেকে তারা তো আর ইলেকশনে অংশগ্রহণ করে নাই। তারা শুধু বাণিজ্য করে নমিনেশন বেচে।’
শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘হয়তো নমিনেশন বেচবে, বাণিজ্য করবে। কিছু টাকা গুলশান অফিসে,আর মোটা অঙ্ক যাবে লন্ডনে। এই তো নির্বাচনে অংশগ্রহণ। এরপর নিজেরাই ভোটকেন্দ্রে একটা সমস্যা বাধিয়ে বলবে, এই তো আমরা ইলেকশন করতে পারলাম না। উইথড্র (প্রত্যাহার) করলাম। এখন অংশগ্রহণ অংশগ্রহণ করে যারা অস্থির হচ্ছে, তাদের কাছে আমার এটিই প্রশ্ন।’
নির্বাচনে অংশগ্রহণ বলতে জনগণের অংশগ্রহণের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যতগুলো উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলো, জনগণ কি অংশগ্রহণ করেনি? অংশগ্রহণ তো করেছে। সেটাই তো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলো।
দেশে হচ্ছে কী, হবে কী?
বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন করেন একজন সাংবাদিক। তাঁর প্রশ্ন ছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা ভেতরে-বাইরে দৃশ্যমান। ভারত, রাশিয়া ও চীনের রাষ্ট্রদূতেরাও অনেকটা দৃশ্যমান। আমাদের বাম বন্ধুরা চীনে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ভারতেও যাচ্ছেন। সব দেখে মানুষ বলছে দেশে হচ্ছে কী, হবে কী?’
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হচ্ছে কী হবে কী—এটা তো কেউ উত্তর দিতে পারবে না। এটা তো জনগণকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারা কী চায়?’ তিনি বলেন, যারা একসময় দেশ চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল, জনগণ যাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল, তাদের মনের বেদনা তো আছেই। যা ভালো করবেন, সেটাতেই তারা খারাপ দেখবে।
শতাধিক নোবেল বিজয়ীর খোলা চিঠিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন থাকার বিষয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন মিলিটারি ডিকটেটররা নির্বাচন করত, তখন এই সুর কোথায় ছিল? আমাদের দেশের আতেলরা যারা এখন স্টেটমেন্ট দেয়, তখন তারা কোথায় ছিল? জিয়াউর রহমান ভোট চুরি শুরু করল, এরশাদ করল, খালেদা জিয়া করল। তখন তাদের নীতিকথা কোথায় ছিল?’
“”দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে গণভবনে আজ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের রাজনীতি, নির্বাচন, ড. ইউনূস প্রসঙ্গসহ বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন-ইউনূসের বিচার চলবে””
নোবেলজয়ীসহ বিভিন্ন দেশের ১৬০ জন নাগরিক ড. ইউনূসের বিচার স্থগিত করার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। বিষয়টি আপনি আমলে নিচ্ছেন কি না—এমন প্রশ্ন করেন আরেক সাংবাদিক।
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভদ্রলোকের যদি এতই আত্মবিশ্বাস থাকত যে তিনি অপরাধ করেননি, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না। আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন। সবকিছু আইনমতো চলে। কেউ যদি ট্যাক্স না দেয় আর শ্রমিকের অর্থ আত্মসাৎ করে, শ্রমিকের পক্ষ থেকে লেবার আদালতে মামলা হয়। আমাদের কী এমন হাত আছে যে একটা মামলা বন্ধ করে দেব?’
একটা চলমান মামলা প্রত্যাহারের অধিকার নেই জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ল উইল টেক ইটস ওন কোর্স।’
ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতিদাতাদের বিশেষজ্ঞ পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজনের জন্য বিবৃতি না দিয়ে এত দরদ থাকলে তারা বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী পাঠাক। সব দলিল-দস্তাবেজ তারা খতিয়ে দেখুক।
ড. ইউনূসকে ট্যাক্সের টাকা ফেরত দিতে হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কর ফাঁকিতে কেউ ধরা পড়লে তাঁকে তো তা ফেরত দিতে হবে। কিছু ফেরত দিচ্ছেনও। আমেরিকা, ইউরোপে কর ফাঁকি দিলে কি ছাড় দেয় সরকার? ফিলিপাইনের নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলা চলছে। বহু নোবেল বিজয়ী আছেন, যাঁরা কারাগারে বন্দীও আছেন।
বিদেশে ড. ইউনূসের বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারি বেতনভুক্ত একজন এমডি বিদেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করেন ও ব্যবসা করেন। যাঁরা বিবৃতি দিলেন, তাঁরা কি এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন? একটি ব্যাংকে চাকরি করে এত টাকা বিদেশে বিনিয়োগ কীভাবে করলেন? কীভাবে উপার্জন করলেন? রাজনীতিবিদ কেউ করলে তো লিখতে লিখতে কলম শেষ হয়ে যেত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে বলেন। দুর্নীতিবাজ ধরা পড়লে পছন্দের হলে তার কোনো দোষ নাই।’
নোবেল বিজয়ীদের ওই চিঠির পর আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্ন করেন এক সাংবাদিক। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। কে বিবৃতি দিল না দিল, সেটা আদালতের দেখার দরকার কী? আদালত প্রভাবিত হবেন কেন? আদালত ন্যায়বিচার করবেন। আদালত ভয় পেলে চলবে না।
আওয়ামী লীগ সব সময় শ্রমিকদের স্বার্থ দেখেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বড় বড় কথা বলবে আর মাঝখান থেকে শ্রমিকের টাকা আত্মসাৎ করবে! চমৎকার বাংলাদেশের লোক! আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও একেবারে লাফ দিয়ে পড়ল। প্রতিদিন আমাদের লেবার নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জর্জরিত করে দেয়। শ্রমিকদের যেটা পাওনা, সেটা দিতে হবে। অল্প কিছু দিয়ে বাকিটা ঘুষ দিয়ে বন্ধ করা, এটা কি ন্যায়বিচারের কথা? এটা সততার কাজ?’
“”
অপরাধ করেননি—এই আত্মবিশ্বাস থাকলে বিবৃতি ভিক্ষা করতেন না: ড. ইউনূস প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী””
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী তহবিল জোগাতে সর্বজনীন পেনশন চালু করা হয়েছে—এমন অপপ্রচার সম্পর্কে প্রশ্ন করেন আরেক সাংবাদিক।
এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই টাকা নিয়ে ইলেকশন ফান্ড করতে হবে, আওয়ামী লীগ তো ওই রকম দৈন্যতায় পড়েনি। আওয়ামী লীগ হচ্ছে নিজের খেয়ে নৌকা, আর জনগণ নিজের খেয়ে নৌকায় ভোট দেয়। আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য কাজ করে।’
প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেন, পেনশনের টাকা অন্য কোনো দিকে যাওয়ার উপায় নেই। টাকা সরকারি কোষাগারে যাচ্ছে। পেনশন স্কিমে থেকে যাবে। যে কেউ তুলে নিতেও পারবে না, ব্যবহারও করতে পারবে না। কেউ এটা নিয়ে কোনোরকম নড়াচড়াও করতে পারবে না। এই নিশ্চয়তা দিয়েই স্কিমটা করা হয়েছে।
সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে না, এটা ঠিক নয়
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি উল্লেখ করে এক সাংবাদিক বলেন, দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও বলেন সিন্ডিকেটে হাত দিতে গেলে বিপদ আছে। নিত্যপণ্যের মৌসুমি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে কি না।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিপদ আছে কে বলেছে, আমি ঠিক জানি না। আমরা তো সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
তখন ওই সাংবাদিক বলেন, দুজন মন্ত্রী বলেছেন, সিন্ডিকেট আছে, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না। বাণিজ্যমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন? বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরব তো।’ তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্যপণ্য নিয়ে কয়েকটা হাউস ব্যবসা করে। যখনই তারা দাম বাড়ায় আমরা আমদানি করি, বিকল্প ব্যবস্থা করি। যাতে তারা বাধ্য হয় দাম কমাতে। কাজেই সিন্ডিকেট থাকলে তা ভাঙা যাবে না, এটা কোনো কথা না। কত শক্তিশালী সিন্ডিকেট আমি জানি না, আমি দেখব কী ব্যবস্থা করা যায়।’
“”নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেটের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বাণিজ্যমন্ত্রীকে ‘ধরবেন’ প্রধানমন্ত্রী””
“”ব্রিকসের সদস্য পেতে চেষ্টা করা হয়নি””
ব্রিকসের সদস্যপদ না পাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখনই সদস্যপদ পেতে হবে, সেই ধরনের কোনো চিন্তা আমাদের মাথায় ছিল না। সেই ধরনের চেষ্টাও আমরা করিনি। চাইলে পাব না, সেই অবস্থাটা নাই। আমরা কাউকে বলতে যাইনি আমাকে এখনই সদস্য করেন।’
নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যোগদানের বিষয়ে বাংলাদেশ আগে থেকেই আগ্রহী ছিল উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা যখন শুনলাম নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হবে, আমাদের ওটার ওপর বেশি আগ্রহটা ছিল। ব্রিকসের সদস্যপদের ক্ষেত্রে তখন প্রেসিডেন্ট আমাকে বললেন ধাপে ধাপে নেবেন। ভৌগোলিক অবস্থানটা বিবেচনা করে নেবেন। পর্যায়ক্রমে সদস্যসংখ্যা বাড়াবেন।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এক পাশে বসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। অন্য পাশে ছিলেন সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম।
“ব্রিকসের সদস্যপদ পাওয়ার চেষ্টা ছিল না: প্রধানমন্ত্রী”
রেটিং করুনঃ ,