যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলে বলেছেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে- এ বিষয়টিতে জনগণের আস্থা আসতে হবে। জনগণ বললেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য বলা যায়। এটিই আমাদের অবাধ, মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাখ্যা। নির্বাচন বিষয়ে আমাদের প্রত্যাশার কথা আমরা সরকারকে জানিয়ে যাব।
গতকাল বুধবার বিকেলে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে এ কথা বলেন তিনি। দুই দিনের সফরে গত মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা আসে ডেরেক শোলের নেতৃত্বে মার্কিন বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার প্রতিনিধি দল। গতকাল সকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু করে প্রতিনিধি দলটি। এর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তাঁরা। এ সময় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসসহ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময়ে বাংলাদেশ কেন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো- প্রশ্ন করা হলে ডেরেক শোলে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। করোনার কারণে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল। শুধু বাংলাদেশ নয়; এ অঞ্চলের সব দেশে উপস্থিতি নিশ্চিতে কাজ করছি। বাইডেন প্রশাসন ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলকে (আইপিএস) গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে- এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
সরকার থেকে বারবার অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ব্যাখ্যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যার অভিন্নতা নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকারের হয়ে আমি বলতে পারব না। তবে সরকারের কাছে আমরা আমাদের অবাধ, মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে যাব। বিশ্বের যে কোনো স্থানে নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছ হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে- এ বিষয়টি জনগণের আস্থায় আসতে হবে। আর এ নিয়ে সংলাপের বিষয়ে মত দেন মার্কিন এ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
সরকারের নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বস্ত হওয়ার বিষয়ে ডেরেক শোলে বলেন, সরকার বলেছে, তারা অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে চায়- এ বিষয়ে আমি আশ্বস্ত। তবে সুশীল সমাজকে চাপে রাখা, মানবাধিকার ও পূর্ববর্তী নির্বাচন নিয়ে আমাদের কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে। আমরা উদ্বেগের বিষয়গুলো জানিয়ে যাব। সরকার তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন করবে বলে আমরা আত্মবিশ্বাসী।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে ভবিষ্যতের কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে নির্বাচনের ফল বিরোধীপক্ষেরও বিশ্বাস হতে হবে।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর বলেন, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার জায়গা থেকে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রও নিখুঁত নই। কিন্তু আমরা আমাদের ত্রুটিগুলো শুধরে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা আমরা অন্য অংশীদারদের থেকেও আশা করি।
র্যাবের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০২১ সালে র্যাব নিয়ে আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছি। এটি ভালো বিষয়, গত বছর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে আমরা র্যাবের টেকসই সংস্কার ও জবাবদিহি দেখতে চাই। আর এ বিষয়ে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যতক্ষণ টেকসই সংস্কার ও জবাবদিহি না দেখব, ততক্ষণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সম্ভব নয়।
গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশের আমন্ত্রণ না পাওয়া নিয়ে মার্কিন এ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, প্রথম সম্মেলনের পর গত বছর গণতন্ত্র সম্মেলনে যোগ দিতে আমরা সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। যারা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল, তারা সবাই গণতন্ত্র উন্নয়নে পরিকল্পনা দিয়েছে। সম্মেলনে যারা যোগ দিতে পারেনি, তাদের কাছে একই পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ গণতন্ত্র উন্নয়নে পরিকল্পনা দিয়ে এখানে যোগ দিতে চায়নি। ভবিষ্যতে পরিকল্পনা দিয়ে এতে যোগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে যদি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন না হয়, তার পরিণতি নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছ না হওয়ার বিষয়ে আমি অগ্রিম কোনো ধারণা করব না। তবে যেটি বলতে পারি, যদি কোথাও গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমাদেরও সহযোগিতার একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের সম্ভাবনা দেখছি। কারণ কয়েকটি ক্রমাগত সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চ্যালেঞ্জের মধ্যেও আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। শক্তিশালী গণতন্ত্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বন্ধু। দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর আস্থা অর্জনে প্রয়োজন আইনের শাসন ও জবাবদিহি বলে জানান ডেরেক শোলে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ উপদেষ্টা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প, পাকিস্তানে বন্যা, ইউক্রেন সংকটসহ বর্তমানে বিশ্বের শত চ্যালেঞ্জের মধ্যেও রোহিঙ্গা সংকট যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারে থাকবে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বেছে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই দুই দেশের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে বলবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নিজেরও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশ সঠিক বিষয়ের পক্ষে থাকুক।
মতবিনিময়ে উপস্থিত ছিলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক ইনাম আহমেদ, যমুনা টিভির নির্বাহী পরিচালক ফাহিম আহমেদ এবং এএফপির ব্যুরোপ্রধান শফিকুল আলম।
বৈঠক সূত্র জানায়, সকালে পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে ডেরেক শোলে জাতিসংঘে ইউক্রেনের পক্ষে বাংলাদেশকে থাকার অনুরোধ করেছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জানিয়েছে, কোনো একক দেশের বিরুদ্ধে যদি কোনো রেজুলেশন আনা হয়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাতে ভোটদানে বিরত থাকে। তবে অখণ্ডতা প্রশ্নে সেটি যে দেশের বিরুদ্ধেই যাক না কেন, তাতে বাংলাদেশ ভোট দেবে। আর যদি কোথাও ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ বা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়ে থাকে, তাহলে তার বিপক্ষে দাঁড়াবে ঢাকা।
নির্বাচন ঘিরে বিএনপির ‘অগ্নিসন্ত্রাসের তথ্যপ্রমাণ’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলরের কাছে তুলে ধরেছে বাংলাদেশ। এ কথা জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আমরা তথ্যভিত্তিক প্রমাণাদি দিয়েছি। আমরা অগ্নিসন্ত্রাসের কাহিনিগুলো বলেছি। তিনি আরও বলেন, আমরা কোনো সন্ত্রাস চাই না। আমরা কোনো অগ্নিসন্ত্রাস চাই না।
বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকে মূলত রোহিঙ্গা ও ইউক্রেন সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মানবাধিকার সুরক্ষা, নির্বাচন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের মতো বিষয়গুলোতে আলোচনা হয়। বৈঠকে সামরিক চুক্তি জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (জিএসওএমআইএ) নিয়ে কাজ চলছে বলে বাংলাদেশ জানিয়েছে।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বৈঠকগুলোতে শোলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে সহযোগিতা, একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, র্যাবের কার্যক্রমের ইতিবাচক পরিবর্তন বিষয়ে সাধুবাদ জানিয়ে টেকসই সংস্কারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রথ্যাবের দক্ষতা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা ও সহায়তা কামনা করেন। বৈঠকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
সূত্র:সমকাল।
তারিখ:ফেব্রুয়ারী ১৬, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,