থানায় হামলা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর ফরিদপুরে অথচ মেশিনগান বসেছে সিলেট ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি থানার সামনে। বালুর বস্তার পেছনে লাইট মেশিনগান কী বার্তা দিচ্ছে আসলে? সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনায় সরকার উদ্বিগ্ন হয়েছে; সেটা ঠিকই আছে। সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের সার্বক্ষণিক অস্ত্র ও গুলি সঙ্গে রাখার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়াও স্বাভাবিক।
কিন্তু থানাগুলোকে দুর্গ বানানো কিংবা এমন সমরসজ্জা কি জনগণের কাছে ভুল বার্তা দেবে না? স্থানীয় প্রশাসনের আতঙ্ক যা আছে, তা এতে আরও বাড়ার কথা। তারা ভাবতে পারে, ‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মনোবিজ্ঞানে একে বলে দুর্গ মানসিকতা।
দুর্গ মানসিকতা হলো একদল মানুষের সার্বক্ষণিক ভীতির অবস্থা। কোনো গোষ্ঠী যদি বিশ্বাস করে যে তারা অনবরত হামলার শিকার হচ্ছে বা হবে, তখন নিজেদের তারা আলাদা করে ফেলে। তাদের মনের মধ্যে কাজ করে যে হয় তুমি আমার পক্ষে নয়তো তুমি শত্রু। চারপাশ নিয়ে তীব্র সন্দেহ ও ভয় তাদের আর বাস্তবতা বুঝতে দেয় না। তারা অতি প্রতিক্রিয়া করা শুরু করে।
সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা বন্ধ করায় ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে। কিন্তু দুর্গ মানসিকতা প্রশাসনের ভেতরকার আস্থা ও জনসংযোগের ক্ষমতাকে কমিয়ে দিতে পারে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা সহিংসতায় রূপ নেয়। গত ২৬-২৮ মার্চ এক ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই জেলা প্রশাসকের বাসভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, থানা, ফাঁড়ি, ভূমি কার্যালয়সহ ৩১টি সরকারি ও আধা সরকারি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ নিয়ে সংগত কারণেই সরকার উদ্বিগ্ন। কিন্তু কেন এমন হলো? কেন প্রশাসনকে নিজের নিরাপত্তা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে?
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিল হেফাজতে ইসলাম। তাদের সঙ্গে সরকারের লাঠি ও মুলার সম্পর্ক, অর্থাৎ ‘বন্ধু তুমি শত্রু তুমি’ সম্পর্ক তো আজকের না। পালা করে সংঘাত ও সমঝোতা দুটিই তো চলছে। এবারের সংঘাত তো ২০১৩ সালের ৫ মের চেয়ে বড় না। তাহলে এত সতর্কতা কেন?
তার আগের প্রশ্ন হলো, কীভাবে জনগণের সঙ্গে প্রশাসনের এত দূরত্ব তৈরি হলো যে লকডাউন আমল করানোয় লাঠিপেটা করতে হয়? তার জেরে বিক্ষোভ ঠেকাতে গুলি করতে হয়? ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জায়গার সাধারণ মানুষই বা কেন প্রশাসনের ওপর হামলা চালাল? আগুন ধরাল?
এর উত্তর হয়তো গত এক দশকের প্রশাসনের ভূমিকার মধ্যে আছে। অনেকে বলেন, সরকার রাজনৈতিক সমর্থনের ওপরে নয়, প্রশাসনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রশাসন ব্যবহার করে নির্বাচন করছে, প্রশাসন দিয়ে রাজনৈতিক কাজ চালাচ্ছে এবং সব বিরোধিতা দমন করছে। প্রশাসনের এই রাজনৈতিক বা দলীয় ব্যবহারই কি প্রশাসনকে জনগণের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে? অনেকে এভাবেই বিষয়টা দেখে থাকেন।
তাই প্রশাসনের নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরানো কম জরুরি না। রাষ্ট্রের প্রশাসনিকতা বজায় রাখতে প্রশাসনের হারানো ভাবমূর্তি ও নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রশাসনিক সমস্যার ফৌজদারি সমাধান আস্থা বাড়ানোর বদলে আরও দূরত্বই তৈরি করবে। প্রশাসন জনগণের ভরসা হতে পারলে জনগণই তাদের চোখের মণির মতো রক্ষা করবে।
আমরা দেখেছি, অনেক জায়গাতেই বিদায়ী জেলা প্রশাসন, ইউএনও কিংবা ওসির জন্য আমজনতা অশ্রু ফেলছে, আন্তরিক সংবর্ধনা দিচ্ছে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, দপ্তরগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গোড়ার গলদটাও তাই সারাতে হবে। সেই নিরাপত্তাই সেরা নিরাপত্তা, যেখানে দুর্গ মানসিকতা থাকে না। কোথায় কী হচ্ছে, তার খবর যদি প্রশাসনের কাছে থাকে, তাহলে ঢাকঢোল না বাজিয়েই শান্তি রক্ষা করা যায়।
কিন্তু প্রশাসনই জনগণের জন্য হুমকি হয়ে উঠলে কী করা হবে? জনগণের ওপর প্রশাসনই চড়াও হলে কে নিরাপত্তা দেবে?
সুনামগঞ্জের শাল্লায় সাম্প্রদায়িক হামলার সময়ও পুলিশ সময়মতো আসতে পারেনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও জ্বালাও-পোড়াওয়ের সময় পুলিশকে রক্ষকের ভূমিকায় পাওয়া যায়নি। এমনকি ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটনার সময়ও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশ সময়মতো আসতে পারেনি।
বিভিন্ন জায়গায় মাদ্রাসার ছাত্রদের বিক্ষোভে হেলমেট পরিহিতরা পিস্তল উঁচিয়ে হামলা করার সময়ও পুলিশকে উদাসীন থাকতে দেখা গেছে। আবার সেই পুলিশের গুলিতেই ১৭ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। এই ধরনের লাগামছাড়া বলপ্রয়োগ থেকে জনগণের নিরাপত্তা কে দেবে? এই মৃত্যুগুলো অনিবার্য ছিল কি না, তার নিরপেক্ষ তদন্ত কি কোনো দিন হবে?
কয়েক দিন আগে রাজধানীর দক্ষিণখানে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এক ব্যবসায়ীকে। সাতক্ষীরায় শিশুকন্যার ওপর যৌন নিপীড়নের বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে দুই সন্তানসহ আত্মহত্যা করেছেন এক মা। বেশির ভাগ এই মা ও শিশুদের নিরাপত্তা কেউ দিয়েছিল? বিচারের আশ্বাস কেউ দিয়েছিল? দেয়নি। যখন-তখন যাকে-তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, থানাহাজতে নির্যাতন, হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলার জাল থেকে নিরীহদেরই বা কে বাঁচাবে?
শীতলক্ষ্যায় ক্ষমতাসীন দলের নেতার অনুমোদনহীন জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চডুবিতে ৩৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। এ রকম অনুমোদনহীন রাজনীতির জাহাজের ধাক্কায় কত মানুষ যে বিপন্ন, তার হিসাব কে রাখে?
শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বলপ্রয়োগই নয়, আন্দোলন দমনে দলীয় কর্মীদের সশস্ত্র দাপটের বিপরীতেও মানুষ অরক্ষিত। নিয়মিতভাবে যাকে-তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় হেফাজতে থাকা মানুষ অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করছেন। লেখক মোশতাকের কারা-মৃত্যু এবং কার্টুনিস্ট কিশোরের ওপর চালানো নির্যাতন নিরাপত্তার বোধ নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন খুলনার তরুণ শ্রমিকনেতা রুহুল আমিন। পাটকল বন্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা কি রাষ্ট্র বিরোধিতা?
জননিরাপত্তার আরেকটি নাজুক দিক হলো মামলায় গণহারে আসামি করা। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সেলের তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০২০–এর ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৯৮৬টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ মানুষকে। জেলহাজতে আছেন ১ লাখ ৪ হাজার ৮১৪ জন। হত্যার শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫২৬ জন; এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৭৮৮ জন। বিএনপির দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে আরও দেখা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২০–এর নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপিসহ জোটের নেতা-কর্মী গুম হয়েছেন ১ হাজার ২০৪ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজত থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৭৮১ জনকে। ২০০৯ থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুরুতর জখম ও আহত হয়েছেন ১১ হাজার ১২৬ জন নেতা-কর্মী।
৩৬ লাখ আসামি করা মানে কম করে অন্তত ৩০ লাখ পরিবারকে (যেহেতু এক পরিবারে একাধিক আসামি থাকতে পারে) ভোগান্তিতে ফেলা। বিএনপির বাইরেও রাজনৈতিক মামলার আসামির সংখ্যা আরও কয়েক লাখ হবে। বাংলাদেশে এখন রয়েছে প্রায় চার কোটি পরিবার। তাহলে কত ভাগ পরিবার রাজনৈতিক নিপীড়নের হুমকিতে? প্রতি ১০-১২টি পরিবারের একটি পরিবার! ভাবা যায়!
সাম্প্রতিক সহিংসতার পরও কয়েক হাজার মানুষকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। অথচ বায়তুল মোকাররম থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারীর অশান্তির সময় পুলিশ ও মাদ্রাসাছাত্ররা ছাড়াও আরেক দল ‘দুষ্কৃতকারী’ দেখা গেছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের কাজ ছিল আগাম হামলা করে বিক্ষোভকারীদের উত্তেজিত করে তোলা, যাতে পুলিশ অ্যাকশন নিতে বাধ্য হয়। ঘটনাগুলোর প্রচারিত ভিডিও দেখলেই এই ‘সশস্ত্র সিভিলিয়ানদের’ ভূমিকা পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। এই হেলমেটধারী ‘এজেন্ট প্রভোকেটিয়ার’রাও কি প্রশাসন ও জনতার মধ্যে সংঘাতের জমিন তৈরি করেনি? এরা কেন আইনের আওতার বাইরে থাকবে? এমন ধারার কাজ চলতে থাকলে কী করে জনতার সঙ্গে ক্ষমতার আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে?
সরকার কি খেয়াল করছে, এভাবে দেশের মধ্যে পরিষ্কারভাবে বিভক্তি তৈরি হয়ে যাচ্ছে? তৈরি হচ্ছে ‘আমরা’ আর ‘ওরা’? সবকিছুকে ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ করে দিলে, কারোরই কি নিরাপত্তা আর থাকবে? ওদের বিরুদ্ধে ‘আমরা’র দুর্গ মানসিকতা সমাধান নয়, বরং নিজেই এক নিরাপত্তা সমস্যা।
লেখক: ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ১০, ২০২১।
রেটিং করুনঃ ,