স্বাধীনতা-পরবর্তী ছয় দশকে ভারতের মোট জনসংখ্যায় মুসলমানদের অংশ বেড়েছে ৪ শতাংশ, অপরদিকে সমান হারে কমেছে হিন্দুদের অংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। তাদের তথ্যমতে, এ সময় দেশটিতে অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যার প্রবৃদ্ধিতে তেমন একটা পরিবর্তন ঘটেনি।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত। এরপর ১৯৫১ সালে দেশটিতে প্রথম আদমশুমারি হয়। ওই সময় ভারতের মোট জনসংখ্যা ছিল ৩৬ কোটি ১০ লাখ। পরবর্তী ছয় দশকে ভারতের জনসংখ্যা তিন গুণের বেশি বেড়েছে। সবশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যা ১২০ কোটির বেশি।
এ সময়ের মধ্যে ভারতে সব ধর্মের মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৫১ সালে দেশটিতে হিন্দু ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ছিল ৩০ কোটি ৪০ লাখ। ২০১১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬ কোটি ৬০ লাখে। একই সময়ে ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা সাড়ে ৩ কোটি থেকে বেড়ে ১৭ কোটি ছাড়িয়েছে। ছয় দশকে দেশটিতে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা ৮০ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৩ কোটির কাছাকাছি পৌঁছেছে।
বর্তমানে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৯৪ শতাংশ হিন্দু ও মুসলিম। দেশটিতে খ্রিষ্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈনসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষ রয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৭৯ দশমিক ৮ শতাংশ হিন্দু। বিশ্বের মোট হিন্দুদের ৯৪ শতাংশ ভারতে বসবাস করে। দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ মুসলিম। ৩০ হাজার ভারতীয় কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না। প্রধান ছয়টি ধর্মের বাইরে ভারতে আরও ৮৩টি ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের সম্মিলিত সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ।
ভারতে এক দশক পরপর পরিচালিত আদমশুমারি ও জাতীয় পরিবারভিত্তিক স্বাস্থ্য জরিপের (এনএফএইচএস) ফলাফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানিয়েছে পিউ রিসার্চ। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি ভারতের ধর্মভিত্তিক জনমিতির পরিবর্তনের ধারা ও এর পেছনের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালে ভারতে মুসলিম নারীদের সন্তান জন্মহার ছিল বেশি, নারীপ্রতি ২ দশমিক ৬। ১৯৯২ সালে এটা ছিল আরও বেশি, ৪ দশমিক ৪। ২০১৫ সালে ভারতের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের নারীপ্রতি সন্তান জন্মদান ছিল ২ দশমিক ১। ১৯৯২ সালে তা ছিল ৩ দশমিক ৩। ২০১৫ সালে ভারতীয় জৈন নারীদের সন্তান জন্মহার অন্যান্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় কম ছিল, নারীপ্রতি ১ দশমিক ২।
এসব তথ্য থেকে স্পষ্ট হয়, ভারতে ধর্মীয় জনমিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে। সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নারীদের মধ্যে সন্তানের জন্মহার কমতির দিকে থাকলেও এখনো হিন্দু নারীদের তুলনায় সংখ্যালঘু মুসলিম নারীদের সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা বেশি। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভারতে সম্মিলিতভাবে নারীপ্রতি সন্তান জন্ম হয় ৩ দশমিক ৪। ২০১৫ সালে তা ২ দশমিক ২-এ নেমেছে।
এ বিষয়ে পিউ রিসার্চের ধর্মবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক স্টিফেনি ক্রামের বিবিসিকে বলেন, এখন অবধি ভারতীয় মুসলিম নারীদের সন্তান জন্ম দেওয়ার গড়পড়তা প্রবণতা দেশটির অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নারীদের তুলনায় বেশি, যা ভারতের জনমিতিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। তবে অভিবাসন কিংবা ধর্মান্তর ভারতের ধর্মভিত্তিক জনমিতির পরিবর্তনে খুব একটা প্রভাব রাখতে পারেনি।
ভারতের ধর্মভিত্তিক জনমিতিক পরিবর্তনে বয়স অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পিউ রিসার্চের গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছর ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যমা বয়স ছিল ২৯ বছর। আর মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের যথাক্রমে ২৪ বছর ও ৩১ বছর। এর অর্থ হলো, ভারতীয় খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের চেয়ে মুসলিমদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। ফলে আগামী দিনগুলোয় তাঁদের সন্তান হলে, মুসলমান নারীরা সন্তান জন্ম দেওয়ার সর্বোচ্চ সুবিধাজনক বয়সে অবস্থান করলে ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের জনমিতিক পরিবর্তন আরও বেগবান হতে পারে।
নারীদের শিক্ষার সুযোগও ভারতে ধর্মভিত্তিক জনমিতির পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। যেসব নারী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান, তাঁরা তুলনামূলক বিলম্বে বিয়ে করেন। ফলে তুলনামূলক কম শিক্ষিত নারীদের চেয়ে তাঁদের প্রথম সন্তান জন্ম নেয় দেরিতে। এর বিপরীতে তুলনামূলক দরিদ্র ও স্বল্পশিক্ষিত নারীদের সন্তান নেওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। যেহেতু ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলিমরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেকটাই পিছিয়ে আছেন, কাজেই এ সম্প্রদায়ের নারীরা কম বয়সে বেশি সন্তান জন্ম দেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বিগত দশকগুলোয় ধর্মনির্বিশেষে ভারতীয় নারীদের মধ্যে সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা কমতে শুরু করেছে। ২০১৫ সাল নাগাদ একজন ভারতীয় নারীর জীবদ্দশায় সন্তান নেওয়ার গড় সংখ্যা নেমে এসেছে ২ দশমিক ২-এ। ১৯৯২ সালে তা ছিল ৩ দশমিক ৪। আর ১৯৫০ সালে ৫ দশমিক ৯। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা ভারতের তুলনায় কম, ১ দশমিক ৬।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ২৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,