আজ ৩০শে চৈত্র, চৈত্র মাসের সাথে বসন্ত ঋতুর শেষ দিন; সেই সাথে বাঙলা বছরেরও দেশ দিন; আবহমান বাংলার চিরায়িত নানা ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এই চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন।
কথিত আছে চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এত আয়োজন। তাই চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে বাঙালির আরেক বড় উৎসব।
চৈত্র মাসের শেষ দিনটি যেমন মাসের শেষ দিন তেমনি বছরেরও শেষ দিন। সাধারণভাবে বাংলা মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় সংক্রান্তি। বর্ষ শেষের এই দিনটি চৈত্র সংক্রান্তি নামে পরিচিত। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে নানা অনুষ্ঠান-পূজা-পার্বণ-মেলা। এটি একটি লোক উৎসব।
প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব এটি। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যজনক মনে করা হয়।
চৈত্রসংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। এর সঙ্গে চলে গাজনের মেলা। চৈত্রমাস জুড়ে চলে উপবাস, ভিক্ষান্ন ভোজন প্রভৃতি পালন করার পর সংক্রান্তির দিনে চড়ক গাছে উঠে পুজো দেয় এই চড়ক পূজার ঢোলের বাদ্যে একসময় গোটা অঞ্চল আন্দোলিত হতো। মেলায় আগমন ঘটত নারীপুরুষ সকল সম্প্রদায়ের লোকের। বাংলাদেশের হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এতে বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও খেলনা, বিভিন্ন ধরনের ফল-ফলাদি ক্রয়-বিক্রয় হয়। বিনোদনের জন্য থাকে সার্কাস, পুতুল নাচ ইত্যাদির আয়োজন।
চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে গাজন উৎসবের আয়োজন থাকে এবং বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নামে ‘পালা’ গান অনুষ্ঠিত হয়। যেমন শিবের গাজন, ধর্মের গাজন ইত্যাদি।
গাজন উৎসবের পিছনে কৃষক সম্প্রদায়ের একটি সনাতন বিশ্বাস কাজ করে থাকে। চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচ- উত্তপ্ত থাকে এখন সূর্য্যরে তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় অতীতে কোন এক সময় কৃষিজীবী সমাজ এ অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিল। গ্রাম্য শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে এর আয়োজন চলে। দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
চড়ক, গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। বর্ষের শেষ দিন হিসেবে পুরাতনকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান ও উৎসবের আয়োজন। এই দিনে ‘পুইণ্যা’ বা হালখাতা উৎসব পালিত হয়।
এ দেশে জমিদারীর খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে সম্ভবত বৈশাখী মেলার পত্তন ঘটে। অনেকের ধারণা মূলত খাজনা আদায়কে একটি আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য চৈত্র সংক্রান্তি মেলার উৎপত্তি হয়েছিল। তাই প-িতদের গবেষণা স্তবক :
‘চিত্রা নক্ষত্র হইতে চৈত্র হইল নাম ॥
বসন্ত বিদায় নিল, বর্ষশেষ যাম-
চড়কের উৎসব, গাজনের গান।
সেই সঙ্গে বর্ষ হইল অবসান ॥
এই বর্ষ শেষ দিনেই চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। পরদিনই নববর্ষÑ নববর্ষের মেলা। অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই চালু হয় বৈশাখী মেলা।
চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসীর মাঝে প্রচলিত রয়েছে নানা উৎসব ও অনুষ্ঠান।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সব জেলাতেই বিভিন্ন উপজাতির বসবাস। বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্রমাসের শেষ দিন তারা বিজু উৎসব পালন করে। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় অলঙ্কৃত এই বিজু উৎসব। তখন প্রতিটি বাড়িতেই নানা স্বাদের খাবার তৈরি হয়। তাদের ধারণা, সবরকম খাবার খেয়ে বিলিয়ে বর্ষ বিদায় করা পূণ্যের কাজ। এদিন তরুণ-তরুণীরা নদী থেকে জল এনে বাড়ির বয়স্কদের স্নান করিয়ে দেয়।
আশীর্বাদ গ্রহণ করে। সদ্য বিবাহিত বর-কনেরা বেড়াতে যায় বাপের বাড়ি। কিংবা শ্বশুরবাড়ি। শুধু বাড়ি বাড়ি নয়, সর্বত্রই চলে আমোদফুর্তি।
নতুন বছরকে সুন্দর করে বরণ করার জন্য সব বাড়ি মেরামত করে। বোশেখের বৃষ্টির পর ‘জুম’ চাষ শুরু হবে। জুম চাষের প্রস্তুতি হিসেবেই বিজু উৎসব। উৎসবের মূল দিনে অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দিনে ধর্ম অনুষ্ঠানে মিলিত হয় সবাই। নাচে, গানে ও নানা অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে।
সূত্র: সংগৃহিত
ছবি: নেট থেকে
তারিখ : এপ্রিল ১৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,