উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। এক জীবন থেকে অন্য জীবনে অথবা এক জীবনেই এক স্তর থেকে অন্য স্তরে। যে সমাজে জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নেই, সে সমাজ স্থবির, বদ্ধ ডোবার মতো। তাই বিপ্লবীর প্রথম কাজই হলো জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলা। তারপর তাঁদের শিক্ষিত করে তোলা আর শিক্ষার প্রথম সোপান হলো স্বাধিকারচেতনা। তাঁদের শেখাতে হবে শ্রম, পুঁজি, কারখানা, যন্ত্র, মেশিন, বাজার, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সব। কার্ল মার্ক্সের ভাষায়, শেখাতে হবে, পুঁজি হলো ঘনীভূত শ্রম। অতএব, উদ্বৃত্ত মূল্যে কার কী অবদান, বোঝাতে হবে সেই রহস্য। ব্যক্তিমালিকানায় শ্রমিক মালিক কর্তৃক কীভাবে শোষণের শিকার হন, শেখাতে হবে এ তত্ত্ব। এ তত্ত্ব, এ জ্ঞান হলো স্বাধিকারচেতনার ভিত্তি।
এ পৃথিবীতে দেশে দেশে একদা বিপ্লব হয়েছিল। রাশিয়া থেকে শুরু করে কিউবা, পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ, চীন, পূর্ব জার্মানি, উত্তর কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা ইত্যাদি অনেক দেশ ছিল এ বিপ্লবের তালিকায়। কিন্তু আজ আর তেমন অবশিষ্ট নেই। কোথাও পুরোপুরি বিদায়, কোথাওবা টিকে আছে বিকৃতরূপে। কেন অবশিষ্ট নেই, এর জবাব আমরা কীভাবে দেব? বিপ্লবের অর্থ যদি হয় মনোজাগতিক পরিবর্তন, তাহলে এই মনোজাগতিক পরিবর্তনই ঘটেনি কোথাও। এই হলো সারসংক্ষেপ, এই হলো উপসংহার।
একজন বিপ্লবীর প্রতিকৃতি যদি আমরা স্মরণ করার চেষ্টা করি, তাহলে প্রথম কমিউনিস্ট দেশ রাশিয়ার বিপ্লবের মহান নায়ক লেনিনের চেয়েও যে নাম আরও উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে, তিনি হলেন চে গুয়েভারা; যিনি রোমান্টিক বিপ্লবী হিসেবে খ্যাত। কারণ, দেশে দেশে চে গুয়েভারার ছবিখচিত টুপি আর টি-শার্ট পরে তরুণেরা আজও ঘুরে বেড়ান, ঘরের মধ্যে আজও তাঁরা চের ছবি টাঙান। একটা কথা প্রায়ই বলা হয়: যৌবনে অন্তত একবার চে গুয়েভারা হতে চাননি, এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ, যৌবন হলো সেই কাল, যখন মানুষ সাম্যের চেতনায় উজ্জীবিত, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন না, যুদ্ধে যান, বিপ্লব নিয়ে ঘরে ফেরেন।
চের জন্ম আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে ১৯২৮ সালের ১৪ জুন। বুয়েনস এইরেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল সায়েন্সে পাস করার পরপরই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন চে, প্রথমে নিজ দেশ আর্জেন্টিনায়, তারপর পাশের দেশ বলিভিয়া ও গুয়াতেমালায়। ১৯৫৫ সালের কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে মেক্সিকোতে দেখা হয়ে যায় ফিদেল কাস্ত্রো আর তাঁর ভাই রাউলের সঙ্গে। চে যুক্ত হয়ে যান কিউবার স্বৈরশাসক বাতিস্তার বিরুদ্ধে সংঘটিত ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে সর্বাত্মক যুদ্ধ ও সংগ্রামে। তিনি কাস্ত্রোর সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন ও গেরিলাযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৯ সালে বিপ্লব সফল হলে কাস্ত্রোর সরকারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন চে। কিউবার ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
১৯৬১ সালের ৮ আগস্ট উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত ইন্টার-আমেরিকান ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিলের মিনিস্টেরিয়াল অধিবেশনে কিউবা সরকারের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন চে। সেখানে তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দেশে দেশে কীভাবে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ করেছে, তার একটি দীর্ঘ বিবরণ পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে তিনটি পথ খোলা আছে: আমরা যৌথ উদ্যোগে একটি সমন্বিত উন্নয়নের মাধ্যমে সুখী, সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি; সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারি অথবা নিজ নিজ দেশে জেঁকে বসা কায়েমি শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের হাতিয়ার কেড়ে নিয়ে শোষণযন্ত্র গুঁড়িয়ে দিতে পারি, কিউবা যে পথ একবার বেছে নিয়েছিল।’
১৯৬৪ সালের ১১ ডিসেম্বর চে গুয়েভারা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেন। এ ভাষণেও তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে দেশের আকৃতি, রাষ্ট্রের শক্তি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থানির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অসম্ভব করে তুলছে। তিনি বলেন, শান্তি শুধু শক্তিধর রাষ্ট্রেরই প্রাপ্য নয়, একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ জীবন সব দেশের, সব নাগরিকেরই প্রাপ্য। তিনি পরিষ্কার জানান, ‘আমরা মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট আদর্শের আলোকে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করতে চাই, কিন্তু একই সঙ্গে আমরা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে শামিল। কারণ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। আমরা শান্তি চাই, জনগণের জন্য উন্নত জীবন চাই। মার্কিনরা চায় আমরা তাদের উসকানিতে পা দিই, যাতে আমাদের শান্তির জন্য অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। আমরা তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে এই মূল্য আত্মমর্যাদার সীমা অতিক্রম করতে পারে না।’ গুয়েভারা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘নিজেকে রক্ষা করার জন্য নিজ ভূখণ্ডে সমরাস্ত্র সংররক্ষণ করার অধিকার কিউবার আছে এবং নিজের ভূখণ্ড, জল-স্থল ও আকাশ রক্ষা করতে কোনো শক্তির কাছে কিউবা নতিস্বীকার করবে না, তা সে যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন।’
কিউবাতে অনেক সম্মানের সঙ্গে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে একটি নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন চে। কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য পৃথিবীব্যাপী একটি অখণ্ড কমিউনিস্ট ব্যবস্থা নির্মাণের ডাক শুনতে পেয়েছিলেন এই মহান বিপ্লবী। লেনিনবাদ তাঁকে শিখিয়েছে, কমিউনিস্ট ব্যবস্থা যদি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত না হয়, এ ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। বিপ্লব সংগঠিত করার জন্য কিউবা থেকে তাই তিনি চলে যান মধ্য আফ্রিকার দেশ কঙ্গো, তারপর বলিভিয়া। কিউবাতে রেখে যান স্ত্রী হিল্ডা ও পাঁচ সন্তানকে। বলিভিয়ার গহীন অরণ্যে তিনি আস্তানা গাড়েন সহযোদ্ধাদের নিয়ে, সিআইএর মদদপুষ্ট বলিভিয়ান সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে।
কিন্তু একসময় ধরা পড়ে যান চে বলিভিয়ান আর্মির কাছে। গুলি করতে উদ্যত সৈনিককে চিৎকার করে চে বলেন, ‘আমি চে গুয়েভারা। দাঁড়াও! গুলি কোরো না! মৃত চের চেয়ে জীবিত চে অনেক বেশি মূল্যবান তোমাদের কাছে।’ মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে এক সৈনিক যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি তোমার অমরত্বের কথা ভাবছ?’ উত্তরে চে বললেন, ‘না। আমি বিপ্লবের অমরত্বের কথা ভাবছি।’ এখানেই চের বিশেষত্ব। চে মনে করতেন, বিপ্লবীকে হত্যা করা যায়, কিন্তু বিপ্লবকে কখনো নয়। বিপ্লবীকে হত্যা করলেও বিপ্লবের সুফল ঠিকই থেকে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ৯ অক্টোবর এই মহান বিপ্লবীকে নির্মমভাবে হত্যা করে মানবতার শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসররা। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে অবসান ঘটে চে গুয়েভারার বর্ণাঢ্য জীবনের!
চে গুয়েভারা চেয়েছিলেন একটি বহুমাত্রিক পরিপূর্ণ জীবন। জীবনকে পূর্ণ করার কী বিস্ময়কর আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর! চে গুয়েভারাকে হত্যার প্রায় ৩০ বছর পর যখন বলিভিয়ার জঙ্গলে তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল, দেখা গেল, তাঁর জামার এক পকেটে পাবলো নেরুদার কবিতার বই, আরেক পকেটে ‘প্রবলেমস অব ম্যাথমেটিকস’ বইটি।
কত যে গান, কবিতা, নাটক, সিনেমা নির্মিত হয়েছে চের জীবন নিয়ে, তার ইয়ত্তা নেই। বাঙালি কবি সুনীল গঙ্গোপাধায় লিখেছেন, ‘চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।’ চে নিজেও কবিতা লিখতেন। ফিদেল কাস্ত্রোকে নিয়ে লেখা কবিতাটিই সম্ভবত চের সেরা কবিতা, যে কবিতা শুধুই স্বপ্নের কথা বলে, জীবনের জয়গান করে, এই মাটির পৃথিবীতে সবার জন্য একটি দারিদ্র্যহীন, ক্ষুধাহীন জীবন ও অপার সম্ভাবনার ডাক দেয়:
‘ফিদেল, তুমি বলেছিলে সূর্যোদয় হবে।’
আর আমরা আজ একবিংশে দাঁড়িয়ে বলি: কিন্তু কোথায় সূর্য? হতাশা আমাদের ঘিরে ধরে, অন্ধকার ধেয়ে আসে। তারপরও বেঁচে থাকার প্রেরণাটা আমরা বিপ্লবের চেতনা ও বিপ্লবীর জীবন থেকেই পাই। আবার স্বপ্ন দেখি। চে–ও এভাবে বেঁচে থাকেন আমাদের সেই স্বপ্নে, গল্পে, গানে, কবিতায়…।
লেখক: ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]
ড. শুভ বসু কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে সাউথ এশিয়ান হিস্ট্রির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুন ১৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,