লেখক:ব্রহ্ম চেলানি।
চীন চুরি করে ভারতের হিমালয়সংলগ্ন সীমান্তে ঢুকে পড়ার তিন বছর পরও দুই দেশের মধ্যকার অচলাবস্থা অবসানের কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। দুই দেশের সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও থেমে থেমে সংঘর্ষের ঘটনা এমন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে যাচ্ছে, যা এশিয়ার ভূরাজনীতি বদলে দিতে পারে। সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও শিং বাগিয়ে ভারত যেভাবে চীনকে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তা এই শতাব্দীতে বিশ্বের অন্য কোনো দেশই পারেনি; এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও নয়।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মারমুখী কৌশল ভারতকে তার আগেকার ঠান্ডা মেজাজ ধরে রাখার নীতি থেকে সরে এসে সামরিক শক্তি বাড়ানোর দিকে ধাবিত করেছে। একটি চীনকেন্দ্রিক এশিয়ার ধারণাকে বানচাল করতে ভারতের এ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অবস্থান তার একটি সম্ভাব্য অংশীদারকে স্থায়ী শত্রুতে পরিণত করছে।
একইভাবে সি চিন পিংয়ের পেশিশক্তিভিত্তিক ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিজ নিজ কৌশল নীতিকাঠামো পুনর্বিন্যাস করতে এবং ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের সম্প্রসারণবাদ ঠেকানোয় প্রস্তুত হতে বাধ্য করছে।
২০২৭ সাল নাগাদ প্রতিরক্ষা ব্যয় দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার মাধ্যমে জাপান ইতিমধ্যে তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শান্তিবাদী জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতিকে কার্যত পরিত্যাগ করেছে। অস্ট্রেলিয়া তার নিজের দিকে গুটিয়ে থাকার নীতি ফেলে অকাস (অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য) প্রতিরক্ষা চুক্তিতে যোগ দিয়েছে।
২০২০ সালের বসন্ত মৌসুমে যখন করোনাভাইরাসের কারণে ভারত কঠিনতম লকডাউন পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছিল, ঠিক সেই সময় চীন তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের অভিলাষে ভারতের সর্ব উত্তরের লাদাখ এলাকায় ঢুকে কয়েক শ কিলোমিটার এলাকা দখল করতে হানা দেয়।
সি মনে করেছিলেন, চীন অবৈধভাবে ঢুকে পড়ে তার দখল করা এলাকায় থিতু হতে পারবে এবং এই দখলদারি জারি রাখা স্থিতাবস্থা ভারতকে মেনে নিতে বাধ্য করতে পারবে। কিন্তু ভারত তখন থেকে চীনের মোতায়েন করা সেনাবাহিনীর চেয়ে সেখানে বেশি সেনা মোতায়েন করেছে। এটি হিমালয় এলাকায় সর্বকালের সবচেয়ে বেশি সামরিক শক্তি জড়ো হয়েছে, যা গোটা অঞ্চলকে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
ভারত চীনের অনুপ্রবেশের পথ থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি না হওয়ায় সি চিন পিং ২০২০ সালে হানা দেওয়া এলাকা থেকে মনোযোগ সরিয়ে সেখান থেকে দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরে অবস্থিত পূর্ব হিমালয় এলাকায় সামরিক সমাবেশ বাড়ানো শুরু করেছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তে চীনা বাহিনী অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করলে ভারতীয় বাহিনী মার্কিন সহায়তায় তা রুখে দেয়। ভারতের ভূমিকে নিজের ভূমি বলে চীন যে দাবি করে আসছে, সেই দাবিকে জোরালো করতে এবং ভারতকে উসকানি দিতে চীন অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন এলাকার চীনা নাম দিয়েছে। চীন সরকার অরুণাচল প্রদেশকে ‘দক্ষিণ তিব্বত’ নাম দিয়ে দাবি করেছে, এখানে তাইওয়ানের দ্বিগুণের বেশি এলাকা ‘চীনা ভূখণ্ড’ এবং ভারতের হাতে থাকা এই বিশাল ভূখণ্ডকে দখল করে নেওয়া নাকি তাদের ‘সার্বভৌম অধিকার’।
এ পরিস্থিতি ভারতকে তাইওয়ানের স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদার পক্ষ নিতে বাধ্য করছে। কারণ, তাইওয়ান যদি সম্পূর্ণরূপে চীনের পেটের ভেতরে ঢুকে যায়, তাহলে অস্ট্রিয়ার সমান ভূখণ্ড অরুণাচল প্রদেশ চীন সরকারের পরবর্তী ‘পুনরেকত্রীকরণ’-এর নিশানা হবে।
১৯৫১ সালে চীনের তিব্বত দখলকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক মোচড় বলা যেতে পারে। কারণ, চীনের তিব্বত দখল করে নেওয়ার ঘটনা চীনের সীমান্তকে ভারত, নেপাল, ভুটান, এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় মিয়ানমারের সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত করে।
তাইওয়ানে চীনা দখলদারি চীনকে একই ধরনের ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা চীনা নৌবাহিনীকে ‘প্রথম দ্বীপের শৃঙ্খল’ থেকে বেরিয়ে আসতে এবং সহজেই প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করতে সক্ষম করবে। তাইওয়ান ‘সব সময়ই’ চীনের অংশ বলে বেইজিং যে দাবি করে থাকে, তার সত্যতা ঐতিহাসিকভাবেই সন্দেহজনক। উনিশ শতকের শেষাংশের আগে তাইওয়ান চীনা প্রদেশ ছিল না। দ্বীপটি চীনা প্রদেশে পরিণত হওয়ার আট বছর পরই অর্থাৎ ১৮৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের পর কিং রাজবংশ জাপানের কাছে সেটিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
একইভাবে চীন নিজে যখন মঙ্গোলিয়া ও মাঞ্চুরিয়া থেকে আসা দখলদারদের অধীনে ছিল, শুধু তখনকার সময় তিব্বত চীনের অংশ ছিল। তা সত্ত্বেও তিব্বতকে চীন তার হিমালয় অঞ্চলে সম্প্রসারণবাদী কর্মকাণ্ড চালানোর হাতিয়ার হিসেবে কার্যত দখল করে নেয়।
হান-চায়নিজদের সঙ্গে তিব্বতিদের জাতিগত কোনো সম্পর্ক থাকার দাবি করতে না পারায় হিমালয় অঞ্চলে চীনের দাবি তিব্বতিদের অনুসৃত ধর্মের ওপর গিয়ে ভর করেছে। এমনকি ক্ষুদ্র ভুটানও চীনের হাত থেকে রেহাই পায়নি। কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে ভারতের রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয় সির সম্প্রসারণবাদী অ্যাজেন্ডাকে বাধা দিচ্ছে।
চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমন এক সময়ে ঘনীভূত হচ্ছে, যখন চীনের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি ধারায় সংকুচিত হচ্ছে, তার জনসংখ্যা তথা শ্রমশক্তি দ্রুত বুড়িয়ে যাচ্ছে এবং প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে আসছে। সে তুলনায় ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক যুবক রয়েছে এবং ভারত এখনো বিশ্বের দ্রুততম বিকাশমান অর্থনীতির দেশ।
হিমালয়ের বর্তমান অচলাবস্থা আরও একবার সি চিন পিংকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, তিনি ভারতের সঙ্গে এমন একটি সীমান্ত যুদ্ধে জড়াচ্ছেন, যে যুদ্ধে তিনি জিততে পারবেন না। চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা যখন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, সে সময় চীনের সর্বনাশের জন্য তার দরকার ছিল তার সবচেয়ে বড় প্রতিবেশীকে স্থায়ী শত্রু বানানো। শেষ পর্যন্ত ভারত ও আমেরিকাকে কাছাকাছি এনে সি নিজেই নিজের সর্বনাশের প্রেক্ষাপট তৈরি করছেন।
****স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক এবং বার্লিনের রবার্ট বোচ একাডেমির একজন ফেলো।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:এপ্রিল ২৫, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,