লেখা:এপি, ইউএনবি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর এক বছর হতে চলেছে। এ হামলা শুরুর পর থেকেই রাশিয়া ইউক্রেনে ‘আগ্রাসন’ চালিয়েছে অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো মস্কোকে একঘরে করার সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও চীনকে ‘পাশে’ পেয়েছে রাশিয়া। তাই বেইজিংয়ের অবস্থান নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
চীনের রাশিয়াকে সাহায্য করার সর্বশেষ অভিযোগ তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। রোববার সম্প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, চীন রাশিয়াকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। এটা হলে ‘মারাত্মক একটা সংকট’ তৈরি হবে বলে আশঙ্কা তাঁর।
বিঙ্কেনের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে চীন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রকে উসকানি ও গুজব ছড়ানো বন্ধ করে ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে কীভাবে কাজ করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে বলেছে। একই সঙ্গে চীন আরও বলেছে, চীন নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রই যুদ্ধের ময়দানে অবিরতভাবে অস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বেইজিংকে কখনো মস্কোর সমালোচনা করতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলো একে ‘আগ্রাসন’ বললেও চীন তা বলতে নারাজ। একই সঙ্গে চীন অবশ্য বলছে, যেকোনো দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা অবশ্যই সমুন্নত রাখতে হবে। বেইজিং সবর্দা শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে থাকবে।
::রাশিয়া ধ্বংস হোক, তা চায় না ফ্রান্স-ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ::
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো ও সংঘাতে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে বেইজিং। সোমবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে এ উসকানি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। চীন–রাশিয়া সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘আঙুল তোলার’ বিষয়টি বেইজিং কখনোই মেনে নেবে না।
চীন কি রাশিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে
রাশিয়ার ইউক্রেন ‘আগ্রাসন’ নিয়ে ঝামেলাহীন ও কখনো পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিতে দেখা গেছে চীনকে। বেইজিংয়ের দাবি, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো আরও পূর্ব দিকে নিজেদের সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে এ যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করেছে। চীনের দাবি, পশ্চিমারা রাশিয়াকে উসকানি দিয়েছে।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হামলা শুরুর কয়েক দিন আগে চীন সফর করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বেইজিংয়ে ভ্লাদিমির পুতিন এবং সি চিন পিং মুখোমুখি বৈঠক করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। একসঙ্গে বসে শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করেন তাঁরা। বৈঠকে তাঁরা বলেন, চীন–রাশিয়ার বন্ধুত্বের সম্পর্কের কোনো সীমা নেই। এরপর থেকে এ প্রতিশ্রুতি অটুট রেখে পশ্চিমা সমালোচনা অগ্রাহ্য করে আসছে চীন। পুতিনের ওই সফরে সি চিন পিং চলতি বসন্তে রাশিয়া সফর করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পুতিনকে সি চিন পিংয়ের প্রতিশ্রুত সেই রাশিয়া সফর এখনো বাস্তব হয়নি।
রোববার প্রচারিত সাক্ষাৎকারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘চীন মূলত দ্বিমুখী আচরণ করছে। দুই দিকে দুই ধরনের কথা বলছে। একদিকে বেইজিং প্রকাশ্যে বলছে তারা ইউক্রেনে শান্তি চায়। গোপনে রাশিয়ার পাশেও থাকছে তারা। আজ পর্যন্ত আমরা চীনা কোম্পানিগুলোকে ইউক্রেনে ব্যবহারের জন্য রাশিয়াকে প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্র সরবরাহ করতে দেখেছি। গভীর উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আমাদের প্রাপ্ত তথ্যমতে, তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে।’
চীন কীভাবে রাশিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এখন পর্যন্ত যা দেখা গেছে তাতে মনে হয়েছে, রাশিয়াকে রাজনৈতিকভাবে ও বুলিসর্বস্ব সমর্থন দিচ্ছে চীন। যেমন ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো সংঘাত উসকে দিচ্ছে বলে অভিযোগ চীনের। আবার অন্যদিকে জাতিসংঘে রুশবিরোধী ‘অ্যাজেন্ডা’ বাস্তবায়নে বাধা দিয়ে আসছে চীন।
চীন ও রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর একাধিকবার যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা যখন রুশ অর্থনীতির ‘বারোটা’ বাজাতে শুরু করে, তখন চীন পশ্চিমা চাপ অগ্রাহ্য করে রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি করেছে। যদিও তারা জ্বালানি কিনছে ছাড়মূল্যে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবার পুতিন ও সি চিন পিংয়ের সরাসরি বৈঠক হয় উজবেকিস্তানের সমরখন্দে। বৈঠকে পশ্চিমাদের রুখতে কৌশলগত মিত্রতার ওপর জোর দেন তাঁরা। এসসিও শীর্ষ সম্মেলন শুরু আগে এ বৈঠকে পুতিনকে সি বলেন, পরাশক্তির ভূমিকা গ্রহণের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক চীন।
যুদ্ধের কিছুদিন আগে পুতিন–সির বৈঠকের পর বেইজিং-মস্কোর পক্ষে থেকে যৌথ বিবৃতিতে ‘বন্ধুত্বের কোনো সীমা নেই’ বলে একটি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ পরিভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারে একটা সমস্যা ছিল। রাশিয়ার পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে যেখানে ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছিল, সেখানে চীনের ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল ‘বন্ধুভাবাপন্ন’ সম্পর্কের বিষয়টি। এতে প্রশ্ন তৈরি হয়, এটা নিছক অনুবাদের ভুল, নাকি চীন ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘বন্ধুত্ব’ শব্দটা এড়িয়ে গেছে?
::রাশিয়াকে অস্ত্র দিলে তা চীন–ইইউ সম্পর্কের ‘চূড়ান্ত সীমা’ অতিক্রম করবে: বোরেল
ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল
চীন রাশিয়াকে অস্ত্র দিলে কী হবে?::
সোমবার তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, চীন যদি রাশিয়ায় প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ করে এবং নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে যেতে কৌশলে মস্কোকে সাহায্য করে, তাহলে এর সত্যিকারের পরিণতি হবে ভয়াবহ। তিনি এর আগে বলেছিলেন, ‘চীন যদি রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করে, তাহলে তা “আমাদের জন্য এবং আমাদের সম্পর্কে গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে।” তবে চীন রাশিয়ায় অস্ত্র পাঠালে ওয়াশিংটন কী পদক্ষেপ নেবে, সে বিষয়ে অবশ্য কিছু জানাননি তিনি।
রাশিয়াকে অস্ত্র দেওয়ার বিষয়ে চীনকে সতর্ক করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। জার্মানির একটি সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, চীন যদি এটা করে, তাহলে এতে করে একটি বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া রাশিয়াকে সমর্থন না দিতে চীনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
একটি জার্মান সংবাদমাধ্যমকে জেলেনস্কি বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে চীন যেন এ যুদ্ধে রুশ ফেডারেশনকে সমর্থন না দেয়। কারণ, চীন যদি এ যুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা করে (মূলত সামরিক সহযোগিতার কথা বলেছেন তিনি) তাহলে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আমি মনে করি, চীন বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন।’
চীন রাশিয়াকে অস্ত্র দিলে তা বেইজিংয়ের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘চূড়ান্ত সীমা’ অতিক্রম করবে বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপের ২৮টি দেশের এ জোটের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইকে রাশিয়াকে অস্ত্র দেওয়ার বিষয়ে সতর্কও করেছেন তিনি।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ফেব্রুয়ারী ২১, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,