তাইওয়ানে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সফরকে কেন্দ্র করে চীন তাইপের ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তাইওয়ান থেকে দেশটি লেবুজাতীয় ফল ও মাছ আমদানি করবে না। আবার নিজের দেশে থেকে বালুও রপ্তানি করবে না। এর ওপর আজ বৃহস্পতিবার তাইওয়ানের পাশ ঘেঁষে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে চীনের সামরিক বাহিনী। তাইওয়ানের আশপাশে মহড়া দিচ্ছে চীনা যুদ্ধজাহাজ।
তবে বেইজিং এই বিধিনিষেধের আওতা থেকে সুকৌশলে তাইওয়ানের সবচেয়ে মূল্যবান রপ্তানি খাত মাইক্রোপ্রসেসরের চিপশিল্পকে এড়িয়ে গেছে। এটি সম্ভবত চীন তাইওয়ানের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের রপ্তানির ওপর ততটাই নির্ভর করে, যতটা দ্বীপটি নিজেই করে। বেইজিংয়ের জন্য তাইওয়ানের এই শিল্প খাতকে টার্গেট করা হবে নিজের জন্য উল্লেখজনক ক্ষতি ডেকে আনা।
তাইওয়ানের জন্য প্রসেসর তৈরির চিপশিল্প কতটা গুরুত্বপূর্ণ
প্রসেসর তৈরির চিপ ও গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ তৈরিতে তাইওয়ান বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করে। এই চিপ স্মার্টফোন থেকে শুরু করে চিকিৎসা ডিভাইস, গাড়ি ও ফাইটার জেট—সবকিছুতে ব্যবহৃত হয়।
প্রযুক্তি বৈশ্বিক বাজার পর্যালোচনাকারী প্রতিষ্ঠান ট্রেন্ডফোর্সের মতে, বিশ্বব্যাপী প্রসেসরের চিপশিল্প খাত থেকে যে আয় হয়, তার ৬৪ শতাংশই করে তাইওয়ান। আর এই ৬৪ শতাংশের অর্ধেকের বেশি আয় করে তাইওয়ান সেমিকন্ডাকটর ম্যানুফেচকারিং কো (টিএসএমসি)।
বোস্টন কনসাল্টিংয়ের তথ্যমতে, বেশির ভাগ আধুনিক প্রসেসরের চিপের ৯২ শতাংশ উৎপাদন করে তাইওয়ান।
আনুষ্ঠানিকভাবে মাত্র ১৩টি দেশ এবং ভ্যাটিকান দ্বারা স্বীকৃত তাইপের অর্থনীতি ও দ্বীপ অঞ্চলটির নিরাপত্তার জন্য এই শিল্পের গুরুত্ব যে কতটা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বছরের পর বছর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাইওয়ানের এখনকার মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশই এই শিল্প খাত। আর এই শিল্প খাতের আয় মোট দেশজ উৎপাদনের ১৫ শতাংশ।
তাইওয়ানের একাডেমিয়া সিনিকার সহকারী গবেষণা ফেলো জেমস লি আল–জাজিরাকে বলেন, তাইওয়ানের প্রসেসর তৈরির শিল্প এর অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাইওয়ান নিজেকে এই শিল্প খাতের নেতৃত্ব স্থানে নিয়ে গেছে এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নির্ভর করবে এই চিপের ওপর, যা তাইওয়ানের কোম্পানিগুলো ডিজাইন এবং উত্পাদন করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তার জন্য প্রসেসর তৈরির এই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এটি অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের কাছে তাইওয়ানের কৌশলগত গুরুত্বকে বাড়িয়ে তোলে।
যদিও তাইওয়ানের লেবুজাতীয় ফল এবং মাছের ওপর বেইজিংয়ের নিষেধাজ্ঞা দেশটির অর্থনীতিতে ন্যূনতম প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে, কিন্তু চিপ আমদানি বন্ধ করলে অনেক বেশি ক্ষতি হতে পারে।
তাইওয়ানের তৈরি চিপ কেন চীনের দরকার
তাইওয়ান নিজেদের প্রসেসর চিপ তৈরির শিল্পের ওপর যতটা নির্ভরশীল, চীনও ততটা নির্ভরশীল। ২০২০ সালের কংগ্রেশনাল রিসার্চ সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীনের চিপের চাহিদা বৈশ্বিক চাহিদার ৬০ শতাংশ। সে চাহিদার ৯০ শতাংশের বেশি আমদানির মাধ্যমে এবং সে দেশে বিদেশি সংস্থাগুলোর উৎপাদনের মাধ্যমে।
এ শিল্পের উন্নয়নে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের পরও সাংহাইভিত্তিক এসএমআইসির নেতৃত্বে চিপ তৈরির বৈশ্বিক বাজারে চীনের হিস্যা ১০ শতাংশের কম।
লি বলেন, এই শিল্পে চীন তাইওয়ানের ওপর নির্ভরশীল। কেননা চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো চিপের নকশা করতে পারে কিন্তু তা উৎপাদনে তাদের ক্ষমতা সীমিত। বিশেষ করে…সম্প্রতি জানা গেছে, এসএমআইসি ৭-এনএম চিপ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। যদিও এটি খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং টিএসএমসি ও স্যামসাং থেকে তারা বেশ পিছিয়ে।
চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, অন্যান্য দেশের ওপর বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করে বিধিনিষেধ আরোপ করলেও নিজের প্রয়োজনীয় পণ্য এতে অন্তর্ভুক্ত করে না।
যেমন করোনার উৎপত্তিসংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে ২০২০ সালে গরুর মাংস, মদ ও যব আমদানি স্থগিত করে চীন। কিন্তু সে সময় ইস্পাত তৈরির কাঁচামালের জোগান দিতে লোহার আকরিকের আমদানি ঠিকই তারা অব্যাহত রেখেছিল।
ভবিষ্যতে চীন কি তাইওয়ানের চিপশিল্পকে লক্ষ্যবস্তু বানাবে
তাইওয়ান কত দিন এই শিল্প খাতে আধিপত্য ধরে রাখতে পারবে, তা নিশ্চিত নয়। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতাকে ‘ভয়ংকর বিপদ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন, যার মুখোমুখি এখন দেশটি। একই সঙ্গে তিনি এ খাতে স্বনির্ভরতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
‘মেড ইন চায়না’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বেইজিং ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে চিপ তৈরিসহ হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিতে ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
টেকনডের গবেষণা অনুযায়ী, ২০২০ সালেই চীন এই ধরনের কোম্পানিগুলো ২২৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ইউয়ান (৩৩.৭ বিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগ পেয়েছে; যা আগের বছরের তুলনায় চার গুণ বেশি।
সরকারি তথ্য অনুসারে, গত বছর চীনের ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আইসি) উৎপাদন বেড়েছে ৩৫৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ইউনিট। যা আগের বছরের তুলনায় ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।
তাইওয়ানের একাডেমিয়া সিনিকার সহকারী গবেষণা ফেলো জেমস লি বলেন, ‘আমার মনে হয় তাইওয়ানের চিপ তৈরি শিল্পের ওপর চীন এখনই নিষেধাজ্ঞা দেবে। কেননা তারা এ খাতে তাইওয়ানের ওপর নির্ভরশীল। চীন যখন এ ক্ষেত্রে নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে, তখনই হয়তো তাদের এ অবস্থান বদলাবে। কিন্তু ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে আরও অনেক সময় লাগবে।
এই শিল্প খাতে চীনের স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করেও তেমন সফল হতে পারেনি। যেমন এসএমআইসির প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড চ্যাং রুগিন এই খাতে পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে মেধাস্বল্পতাকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অতিসম্প্রতি ১০০ বিলিয়ন ইউয়ানের ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ইন্ডাস্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের একের পর এক গ্রেপ্তারের কারণে শিল্প খাতটি ধাক্কা খায়। তদন্ত শেষে সমস্যাগ্রস্ত চিপমেকার প্রতিষ্ঠান সিংহুয়া ইউনিগ্রুপের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঝাও ওয়েইগুওকে গত মাসে গ্রেপ্তার করা হয়। গত বছরের জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হওয়ার জন্য আবেদন করেছিল।
তাইওয়ানের বিরুদ্ধে চীনের নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ টেনে সিঙ্গাপুর ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটির চীনের বাণিজ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হেনরি গাও বলেন, ‘আমার মনে হয় তারা যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবে, তখনই তারা চিপ আমদানি বন্ধ করবে।’
তিনি আরও বলেন, প্রসেসর চিপ তৈরির সক্ষমতা উন্নয়ন খুব কঠিন। তাদের পূর্ববর্তী অনেক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, যেমন দেখেন এই শিল্প খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সাম্প্রতিক সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ০৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,