লেখক:ইউ জিয়ে।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে চীন কত দূর যাবে, তা এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, চীন সম্ভবত রাশিয়াকে প্রাণঘাতী অস্ত্র সহায়তা দিতে যাচ্ছে।
কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর বছর পূরণের দিন চীন এ যুদ্ধের বিষয়ে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে উভয় শিবিরকে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। ওই বিবৃতিতে আগের মতো রাশিয়াকে ‘সীমাহীন অংশীদারির সাথি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। বিবৃতিতে নিজেকে পক্ষপাতহীন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরাই চীনের লক্ষ্য ছিল।
বস্তুত রাশিয়ার সঙ্গে বেইজিংয়ের গাঁটছড়া এখনো অটুট আছে; যদিও গত এক বছরে চীনা কূটনীতিকেরা রাশিয়ার কাজকর্মে কিছুটা বিরক্ত বলে মনে হচ্ছে। কূটনীতিকদের কাজ দুই দেশের সম্পর্ককে একটি ভারসাম্যমূলক জায়গায় রাখা। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হঠকারী বাগ্মিতা ও পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের ঝুঁকিকে দ্বিগুণ করে ফেলা চীনা কূটনীতিকদের জন্য সেই কাজকে ক্রমশ কঠিন করে ফেলছে।
চীনের যখনই মনে হবে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ায় শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা ইউরোপ তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, তখনই তার রাশিয়ার দিকে এগোনো থেকে বিরত থাকা ঠিক হবে। তবে বারবার অবস্থান বদল চীনের নেতৃত্বকে হালকা করে তুলতে পারে। চীন বুঝতে পারছে বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সংকটের সমাধানে সহায়তা করার মাধ্যমে বৈশ্বিক পরিসরে নিজের সম্মান ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনার এটিই হয়তো শেষ সুযোগ। তবে তার আগে সি চিন পিংকে ক্রেমলিনে থাকা তাঁর ‘সীমাহীন’ বন্ধুর প্রতি দরদের সীমা আগে টানতে হবে।
ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিন যেভাবে নৃশংস কায়দায় জঙ্গলের আইন প্রয়োগ করছেন, তাতে চীনকে এ সংঘাতে নিজেকে জড়ানোর বিষয়ে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে স্পষ্টতই রাশিয়া এ যুদ্ধে হারছে এবং সে কারণেই ইউরোপের প্রধান প্রধান অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের বিষয়ে চীন আগ্রহী হয়ে উঠছে।
তবে নিশ্চিতভাবেই পুতিন বিশ্বকে এই বার্তা দেওয়ার বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী যে চীন তার পাশে আছে। এ কারণেই তিনি সম্প্রতি চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইকে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছেন এবং শিগগিরই চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মস্কো সফর করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
রাশিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার মূল্য চীনের জন্য লাভের তুলনায় বেশি হওয়ার পরও মস্কোর সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার আগ্রহ দেখে যে কেউ মনে করতে পারেন, ক্রেমলিনের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক বজায় রাখার পেছনে ইউক্রেন যুদ্ধের বাইরেও আরও কিছু আছে। যেমন সবাই জানে এই দুই দেশের মধ্যে ৪ হাজার ৩০০ কিলোমিটারের সীমান্ত আছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রায় ২০০০ বৈঠক করেও সুনির্দিষ্টভাবে সীমান্তরেখা স্থির করা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চীনের শান্তি প্রস্তাব যে কারণে খারিজ হলো
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চীনের শান্তি প্রস্তাব যে কারণে খারিজ হলো
১৯৫০ ও ১৯৬০–এর দশকে চীন-সোভিয়েত বিভক্তির ভূত আজও উভয় দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে সরেনি এবং খুব শিগগির তা সরবে বলেও মনে হয় না। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা পূর্ব এশিয়া ও ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করায় সেদিকেই চীনকে সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হচ্ছে। সে কারণেই রাশিয়ার সঙ্গে ভাগাভাগি করা সীমান্তে কোনো অশান্তি হলে চীনের পক্ষে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
উপরন্তু পশ্চিমাদের সঙ্গে মিল না রেখে চীন বরাবরই মূল্যবোধের চেয়ে স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে তার পররাষ্ট্র নীতির আদল ঠিক করে থাকে। সেই দিক মাথায় রেখেই যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ঠেকানোর অংশীদার হিসেবে চীন রাশিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। কিন্তু ইউক্রেন প্রশ্নে পুতিনের ভুল সিদ্ধান্ত সি চিন পিংকে তাঁর সামনে চলে আসা নতুন আর্থিক, অর্থনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সামাল দিতে বাধ্য করছে।
আরও পড়ুন
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের শান্তি পরিকল্পনা কি শুধুই বাকোয়াজ
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরে এসে চীন শান্তি পরিকল্পনা দিয়েছে
রাশিয়ার চাপিয়ে দেওয়া এ যুদ্ধ ইউরোপের দেশগুলোকে অনেক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি একতাবদ্ধ করেছে। এ অবস্থায় চীনের নেতারা বুঝতে পারছেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক তলানিতে নামার পর এখন ইউরোপও যদি তাদের ত্যাগ করে, তাহলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।
তাই চীন যেকোনো মূল্যে তার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দ্বারা একঘরে হওয়া এড়ানোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ইইউর সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক চ্যানেলগুলো খোলা রাখতে চীন তাদের বোঝাতে চাইছে, পুতিনকে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন থেকে বিরত রাখার জন্যই তারা রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রাখবে।
চীনের যখনই মনে হবে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ায় শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা ইউরোপ তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, তখনই তার রাশিয়ার দিকে এগোনো থেকে বিরত থাকা ঠিক হবে। তবে বারবার অবস্থান বদল চীনের নেতৃত্বকে হালকা করে তুলতে পারে।
চীন বুঝতে পারছে বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সংকটের সমাধানে সহায়তা করার মাধ্যমে বৈশ্বিক পরিসরে নিজের সম্মান ও মর্যাদা ফিরিয়ে আনার এটিই হয়তো শেষ সুযোগ। তবে তার আগে সি চিন পিংকে ক্রেমলিনে থাকা তাঁর ‘সীমাহীন’ বন্ধুর প্রতি দরদের সীমা আগে টানতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
****ইউ জিয়ে ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাংক চ্যাটাম হাউসের এশিয়া প্যাসিফিক প্রোগ্রামের চীনবিষয়ক একজন রিসার্চ ফেলো।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:মার্চ ১৪, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,