বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের এখন রমরমা অবস্থা-তিন বছরের মধ্যে এই প্রথম ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলার ছাড়িয়ে গেল দাম। অথচ করোনা মহামারির শুরুতে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি মাইনাস ৩৭ ডলারে নেমে গিয়েছিল। দেড় বছরের মধ্যে তার দাম এখন ৮০ ডলার ছাড়িয়ে গেল।
অপরিশোধিত তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে কয়লা, কার্বন ও ইউরোপীয় গ্যাসের দামও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শেল তেলের উৎপাদন হ্রাস, মেক্সিকো উপসাগরে হারিকেনের কারণে সরবরাহব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটা ও চাহিদা বৃদ্ধির কারণে জ্বালানি তেলের দাম এভাবে বাড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ওপেক ও সহযোগী দেশগুলো তেল উৎপাদন হ্রাস করার কারণেও তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার শীতকালে তাপমাত্রা বেশি কমে গেলে জ্বালানির দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা।
জ্বালানির এই ক্রমবর্ধমান দরবৃদ্ধির কারণে হোয়াইট হাউস ইতিমধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যে জ্বালানির এই ক্রমবর্ধমান দরবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে বাইডেন প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক জেইক সালিভান মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি, যদিও অ্যাজেন্ডায় তেলের দাম আছে কি না, তা জানা যায়নি।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব জেন পাসকি ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন সর্বতোভাবে তেলের দাম কমানোর চেষ্টা করছে। এ ছাড়া ওপেকের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতামূলক বাজার এবং মূল্য নির্ধারণের ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের এই সময় তেলের দাম বাড়তি থাকা ঠিক হবে না।
আসন্ন শীতে তেলের চাহিদা দিনে ৫ লাখ ব্যারেল ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছে বিশ্বের বৃহত্তম তেল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ভিটল গ্রুপ।
তেলের চাহিদা বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে চীনা সরকারের নীতিগত অবস্থান। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে ধাপে ধাপে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটিতে শীতকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে।
তারা বেইজিংয়ের বায়ু যতটা সম্ভব নির্মল রাখার চেষ্টা করছে। সে জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে তারা আরও বেশি তেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তারা বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল আমদানিকারক। তাদের চাহিদা বৃদ্ধি মানে তেলের বাজার আরও রমরমা হওয়া। অন্যদিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ ভারতও গত তিন মাসে তেল আমদানি বৃদ্ধি করেছে। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ থেকে দেশটি বেরিয়ে এসেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। তাদের ধারণা, ভবিষ্যতে তেলের চাহিদা আরও বাড়বে।
ওপেকও ধারণা করছে, নিকট ভবিষ্যতে জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়বে। তবে সেটা পরিমাণে খুব বেশি হবে না, দিনে অতিরিক্ত ৩ লাখ ৭০ হাজার ব্যারেল। এদিকে বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস বলেছে, ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম চলতি বছরের শেষ নাগাদ ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলারে উঠতে পারে।
এদিকে শুধু জ্বালানি তেলই নয়, অন্যান্য জ্বালানির দামও বাড়ছে। উচ্চমানের অস্ট্রেলীয় কয়লার দাম গত মঙ্গলবার রেকর্ড ছুঁয়েছে। অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম গ্লোবালকোলে ডিসেম্বর মাসে সরবরাহের লক্ষ্যে এক টন কয়লা বিক্রি হয়েছে ২০৪ ডলারে। ২০০৮ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের কয়লা ২০১ ডলারে বিক্রি হয়েছে-এত দিন সেটাই ছিল সর্বোচ্চ।
বিশ্বের বড় বড় দেশ প্রায় সবাই কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে। মূল্য ঘোষণাকারী এজেন্সি অর্গাস মিডিয়ার ভবিষ্যদ্বাণী, চলতি বছর ইউরোপে কয়লার চাহিদা উল্টো বেড়ে যেতে পারে। জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন ও যুক্তরাজ্যের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যদি চলতি বছরের অক্টোবর থেকে আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ৮০ শতাংশ সক্ষমতায়ও পরিচালিত হয়, তাহলে চাহিদা বাড়বে।
গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, তেল, গ্যাস ও কয়লার উচ্চমূল্যের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার গতি হারাতে পারে। প্রবৃদ্ধির গতি কমে গেলে করপোরেটদের ব্যবসার খরচ বেড়ে যাবে।
সরবরাহ সংকট
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক অংশে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তো ভুগছেই, এর জের পড়ছে চীনসহ অন্যান্য দেশেও। পরিস্থিতি এতটাই সঙিন যে বিদ্যুতের খরচ মাত্রা ছাড়াচ্ছে, বন্ধ করতে হচ্ছে কারখানা। ধাক্কা খাচ্ছে উৎপাদন। স্পেন, ইতালির মতো দেশে ইতিমধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে অনেকটা। বিভিন্ন সংবাদ ও সমাজ মাধ্যম সূত্রের খবর, চীনে শিল্প-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ট্রাফিকের আলো নিভেছে, আবাসনগুলিতে লিফট কাজ করছে না, বন্ধ হয়েছে থ্রিজি মোবাইল সংযোগও। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতি দ্রুত আয়ত্তে না এলে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে বিশ্ব অর্থনীতিতে। মূল্যস্ফীতি মাথাচাড়া দেবে-বাড়বে আমদানি ও যাতায়াত খরচ। চীনে কল-কারখানা বন্ধ হলে তার জের পড়তে পারে ইস্পাত, বৈদ্যুতিন চিপসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যা অন্যান্য দেশের শিল্পোৎপাদনে সমস্যা তৈরি করবে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ২৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,