লেখক:পাওলা সুবাচ্চি।
বিশ্বব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী বিভক্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, এর একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এবং অন্যদিকে চীন ও তার সহযোগীরা দল ভারী করার তালে আছে। মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন গত মাসে আটলান্টিক কাউন্সিলের একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, এই বিভক্তি কাম্য নয় এবং এটি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই চীনের সঙ্গে কাজ করতে হবে। কিন্তু মুখে এই কথা বললেও বাস্তবে গত মাসে তিনি যেসব উদ্যোগে সমর্থন দিয়েছেন, তা এই ধরনের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে পারে।
ইয়েলেনের দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের এমন দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা উচিত, যে দেশগুলোর ‘বিশ্ব অর্থনীতিতে কীভাবে কাজ করা যায় তা জানা আছে এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাধারণ নিয়ম ও মূল্যবোধের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য রয়েছে।’ তাঁর দৃষ্টিতে, ‘মূল মূল্যবোধ এবং নীতিগুলোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ অংশীদার বেছে নেওয়া হলো কার্যকর সহযোগিতার চাবিকাঠি।
কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন মূল্যবোধে বিশ্বাসী দেশগুলোকে কোথায় নিয়ে যায়? যদি পশ্চিমা দেশগুলো শুধু সেই দেশগুলোর জন্যই সহযোগিতাকে সীমাবদ্ধ রাখে যারা বিশ্বকে তাদের চোখে দেখে, তাহলে কীভাবে বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো টিকে থাকবে? পশ্চিমারা যদি চীনের মতো একটি শক্তিকে তাদের বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা থেকে বাদ দেয়, তাহলে চীনের হাতে বর্শার মতো বিকল্প ছাড়া আর কী থাকতে পারে?
তিনটি মূল বিবেচনাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়ে আরও কার্যকরভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা যেতে পারে।
প্রথম বিবেচনাটি হলো, চীন ছাড়া বহুপক্ষীয়তা অসম্ভব। চীন শুধু বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিই নয়; দেশটির সম্পদ তার জিডিপির প্রায় ৪৭০ শতাংশ এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম আর্থিক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটি। চীনের মোট জাতীয় সঞ্চয় তার জিডিপির প্রায় ৪৫ শতাংশ যা একইভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে বিশাল। এর বাইরে চীন বিশ্বের বৃহত্তম দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা এবং তারা শুধু পশ্চিমাদের প্রতিষ্ঠিত ও তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত নয়, এমন বহুপক্ষীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যথেষ্ট অবদান রাখছে।
দ্বিতীয় বিবেচনাটি হলো, আন্তর্জাতিক আর্থিক কাঠামোয় চীন প্রতিষ্ঠানের সদস্য এবং প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন দুটি নতুন আঞ্চলিক বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংক তৈরিতে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। একটি হলো এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) এবং আরেকটি হলো নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)। এই দুটি প্রতিষ্ঠানকেই আন্তর্জাতিক আর্থিক স্থাপত্যের পরিপূরক হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, চীন এ ধরনের বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্ব দিতে পারে; দেশটি উন্নয়ন অর্থের প্রধান দাতা হিসেবে কাজ করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের তৈরি করা বৈশ্বিক উন্নয়ন ব্যবস্থার একটি ‘দায়িত্বশীল অংশীজন’ হতে পারে।
কিন্তু এক অর্থে সেই ব্যবস্থা চীনকে ব্যর্থ করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) চীনের ভোটিং শেয়ার ৬.১ শতাংশ, যা জাপানের চেয়ে সামান্য কম এবং যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক কম। আইএমএফে জাপানের ভোটিং শেয়ার ৬.২ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ১৬.৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকে এই তিন দেশের শেয়ার যথাক্রমে ৫.৪ শতাংশ, ৭. ২৮ শতাংশ এবং ১৫.৫ শতাংশ। চীনের অর্থনৈতিক ওজন ও সক্ষমতার সঙ্গে এটি স্পষ্টতই সংগতিপূর্ণ নয়। এই অবস্থার সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত এবং আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকে চীনের শেয়ারের পরিমাণ আরও বাড়ানো উচিত। কিন্তু আমেরিকান বাধার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করার সময় মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
এটি চীনের নেতাদের বিদ্যমান বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা থেকে তাঁদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার এবং নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির উপযুক্ত কারণ দেখানোর সুযোগ করে দেয়। এর ফলাফল হিসেবে বৈশ্বিক আর্থিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বিভক্তির সৃষ্টি হচ্ছে। তার জেরে করণ, বৈশ্বিক আর্থিক নিরাপত্তাবেষ্টনী অপেক্ষাকৃত কম কার্যকর, কম অনুমানযোগ্য এবং কম অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে উঠবে। আর সেটি অনিবার্যভাবে কিছু দেশকে কৌশলগত ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে।
তৃতীয় ও সর্বশেষ যে বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং যেটি বিবেচনায় নেওয়া পশ্চিমাদের জন্য সবচেয়ে কণ্টকময় হবে, সেটি হলো চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং চীনের উদ্দেশ্য ও অর্থনৈতিক প্রণোদনার সঙ্গে জি-৭ দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ফারাক আসমান–জমিন। এটিই পশ্চিম ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনার একটি প্রধান উৎস এবং মূলত এই কারণেই ইয়েলেনের মতো পশ্চিমা কর্মকর্তারা ‘সমমনা’ দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হওয়াকে সহজ বিকল্প বলে মনে করে থাকেন।
এটি ঠিক, পরস্পরের বিরোধপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, মতাদর্শ ও স্বার্থকে আপসের জায়গায় আনা বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয়। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের সময় রাশিয়ার নিন্দা করার ক্ষেত্রে চীন জি-৭ দেশগুলোর সঙ্গে যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় এই মতাদর্শগত ও স্বার্থসংক্রান্ত ফারাক আরও স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে চীনের ব্যর্থতা যেমন হতাশাজনক, তেমনি এই ব্যর্থতার জন্য চীনের নেতাদের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখানো কিংবা বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা থেকে চীনকে বাদ দেওয়া ঠিক হবে না। তার বদলে বরং জি-৭ দেশগুলোর উচিত চীন ও তাদের অভিন্ন স্বার্থের জায়গাগুলো চিহ্নিত করার ওপর জোর দেওয়া; যেখানে পারস্পরিক ভুল–বোঝাবুঝি ও মতানৈক্যের ঝুঁকি কম সে জায়গাগুলো শনাক্ত করা এবং সহযোগিতার কোনো সুযোগ থাকলে তা ব্যবহার করা।
জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষ করে জলবায়ু অর্থায়ন দুই পক্ষকে কাছাকাছি আনার অনুঘটকের একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। কিন্তু এটিই একমাত্র উদাহরণ নয়। যদিও পশ্চিমা মিডিয়াগুলো প্রায়ই চীনের নেতাদের অস্থির স্বভাবের, এমনকি প্রতারক হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে, তা সত্ত্বেও চীন বিভিন্ন অর্থনৈতিক এবং আর্থিক বিষয়ে পশ্চিমের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে জড়িত রয়েছে।
এর একটি বড় উদাহরণ হলো ঋণ ব্যবস্থাপনা। গত মাসের শেষের দিকে চীন জাম্বিয়ার ঋণদাতা কমিটিতে যোগ দিয়েছে এবং জি-২০ দেশগুলোর কমন ফ্রেমওয়ার্ক ঋণ-পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় সহযোগিতা দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। এটি শুধু জাম্বিয়ার জন্যই নয় (যার ঘাড়ে ঋণের বোঝা বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার) বরং ঋণের বোঝায় ভারাক্রান্ত অন্য আফ্রিকান দেশগুলোর জন্যও তা একটি ভালো লক্ষণ৷
এমনকি ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ ইস্যুতেও পশ্চিমা এবং চীনা অবস্থানের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে (যদিও সেই মিল আছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে)। মার্চের শুরুতে এআইআইবি আর্থিক ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে রাশিয়া এবং বেলারুশের সঙ্গে সব ব্যবসা স্থগিত করে এবং এনডিবি ‘রাশিয়ায় নতুন লেনদেন আটকে রেখেছে’ বলে ঘোষণা দেয়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অভিন্ন আদর্শ ও মূল্যবোধ একমাত্র উপায় নয়; এ ক্ষেত্রে ব্যবহারিক বিবেচনাও খুব শক্তিশালী।
****সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
পাওলা সুবাচ্চি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের কুইন মেরি গ্লোবাল পলিসি ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অধ্যাপক
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: মে ২৯, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,