( শারদীয় পূজা উৎসব উপলক্ষে )
আর কয়েকটা দিন বাদেই শারদীয় পূজা উৎসব, সাথে আগামী পহেলা অক্টোবর পেখমের জন্মদিন তাই শারদীয় পূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে তাকে আজ একটি শুভেচ্ছা কার্ড পাঠালাম ভারতের কোলকাতা শহরে, সেখানে লিখলাম শুভ হোক তোমার পথ চলা, সামনের দিনগুলিতে এগিয়ে যাও তোমার পরিকল্পনা মত – এ আমার সকল সময়ের প্রত্যাশা। কি আচার্য মিল ! পহেলা অক্টোবর আমারও জন্মদিন, এ সব কথা নিজের মনে না থাকলেও সামাজিক প্রাণ ফেসবুক তা জানিয়ে দেয় যদি বা আমাদের মনেও না থাকে।
পেখমের সাথে ফোনে এখন আর কথা হয় না, অথচ এমন কোন দিন যেত না কিম্বা দিনে কয়েক বার কথা হতো না ! সেই আমাকে ফোন দিত আর বলতো – ‘ না, না তোমার ফোন করার দরকার নেই আমাদের দেশ থেকে তোমার দেশে কম টাকায় ফোনে কথা বলা যায়। ‘
পেখমের সাথে ফোনে কথা বিনিময়ের সময় একবার যে জানিয়েছিল, অনন্ত আকাশে তার প্রকাশ ঘটেছে, পুরা আকাশটাই এখন তার। একবার প্রশ্নও করেছিল কেন তার এই প্রকাশ !! আর এতো দিন সে কোথায় লুকিয়ে ছিল! নিজেই বলেছিল শামুকের মধ্যে, কিন্তু এখন সে রবি ঠাকুরের
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস।
আমি বললাম এটাতো আমাদের দেশের জাতীয় সংগীত
পেখম বলল ও তাই !!, আমি জানতাম না তো, কত সুন্দর তোমাদের দেশের জাতীয় সংগীত, জানো এটি আমার প্রিয় রবীন্দ্র সংগীতের মধ্যে একটি।
– জাতীয় সংগীত শুনার সময় ও গাওয়ার সময় দাঁড়াতে হয় সন্মান জানাতে হয়।
– সে আমি জানি আর আমি তোমার সাথে এখন সন্মান করে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। চল আমরা গুন গুন করে গানটার কয়েকটা লাইন গাই
” আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ,
তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা,
ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রাণে পাগল করে
মরি হায়, হায় রে
ও মা,
অঘ্রানে তোর ভরা খেতে,
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি”
গান থামিয়ে দিয়ে বলল আমি কী দেখেছি মধুর হাসি কথাটা শেষ করতে না করতে অনেক ক্ষণ ধরে সে হাসলো, হাসির রূপ যেন প্রথম দেখলাম যা কিন প্রাণ খোলা, ঝক ঝকে মুক্তা ছড়ানো, যে হাসিতে তাঁর সমস্ত মনটা স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছিল, শুভ্র, শুভ্রতার চাদের মোড়ানো তার মন। বার বার বলল
– আমি কী দেখেছি ! আমি কী দেখেছি !
– আমি কী দেখেছি !
– পেখম বলল মধুর হাসি দেখেছি, মধুর হাসি, আমি তোমার মধুর হাসি দেখেছি।
আমাদের ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরী, ঢাকায় বই মেলা বা ঢাকায় নব-বর্ষে উৎযাপন এ সবের প্রতি ছিল পেখমের অসাধারণ আগ্রহ, এই সব বিষয়ের উপর জানতে চাইত, লেখাপড়া করতে চাইত, আমাদের ঢাকায় এসে কোন বিশ্ব-বিদ্যলয় বা কলেজে লেখাপড়া করা যাবে কিনা বা কোন ডিগ্রী ! আমাকে বলেছিল ঢাকার অনেকেই শান্তি-নিকেতনে লেখাপড়া করে, দুই এক জনকে সে চেনেও।
পেখমের সাথে প্রায় বা সব সময় ফোনে নানান কথা হতো যেন একটি রুটিন ওয়ার্ক।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম তেমন করে আর ফোন আসছে না, কেমন যেন একটা খাপছাড়া খাপছাড়া ভাব, ভাবলাম ফোনে কথা বলে সম্পর্ক রাখাটা পেখমের জন্য বেশ ব্যয় বহুল বলে আস্তে আস্তে সে হয়তো ফোনে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। আমি ফোনের নাম্বর দেখলেই বুঝতাম পেখমের ফোন একদিন লক্ষ্য করলাম পেখম আমাকে ফোন করেছে – আমি হ্যালো হ্যালো বলছি কিন্তু সে চুপ করে আছে, প্রায় এমন ঘটনা ঘটতে লাগলো বিশেষ করে রাতে। আমি শুধু হ্যলো হ্যলো বলে যেতাম, বুঝতাম ফোনের লাইনটা কাটা পড়ে নি, আমিও ফোন রাখতে চাইতাম না, অনেক ক্ষণ ধরে কানে ধরে রাখতাম, শুধু শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনা যেত।
একদিন আমাকে বলল ‘বাসায় বাবা -মা, ভাই ও বোনকে ফাঁকি দিয়ে শুধু তোমার কণ্ঠ স্বরটি শুনার জন্য তোমাকে ফোন দিতাম।’ এ কথাটি শুনার পর আমার আর বুঝতে বাকি থাকলো না যে, পৃথিবীর এ – প্রান্ত আর ও – প্রান্ত বলে কিছু নেই আজ পেখমের কাছে, এদেশ, সে দেশ সীমান্ত রেখা, পাসপোর্ট, ভিসা এ সবই অর্থহীন, মূল্যহীন, শুধু মাত্র আমার কণ্ঠ স্বরটি শুনার কাছে।
একদিন পেখম আমাকে জানিয়ে দিল তার পরিবার চির দিনের জন্য ফোনের ব্যাবহার তাঁর জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, যেমন করে অনেক সরকার সেই দেশের অনেক বই, দৈনিক পত্রিকা বা টিভি নিষিদ্ধ করে দেয়।
আমি বুঝতে পারতাম পেখম আইন ভঙ্গ করে আমাকে ফোন করত কোন কথা না বলে শুধু মাত্র আমার হ্যালো কন্ঠ স্বরটা শুনার জন্য। বুঝতে পারতার পেখম শুধু চুপ করে আমার কণ্ঠ স্বর শুনছে। জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, অনেক প্রাপ্তি পেয়েছি, কিছু দর্শনের বই পড়ে জীবনের অর্থ কিছুটা বুঝার চেষ্টা করেছি কিন্তু শুধু বুঝতে আর অনুমান করতে ব্যার্থ হয়েছি পেখম আমার মধ্যে কী দেখেছিল শুধু মাত্র ঐ ক্ষণিকের দেখায় !! মনের মধ্যে সে কী কল্পনার কারখানা তৈরী করেছিল যে কল্পনা থেকে সবই সে বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছিল, কল্পনা দিয়ে যাত্রা শুরু করে মানুষ ছুটে বেড়ায় কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে যা সৃষ্টির শুরু থেকে আজও চলছে একই নিয়মে। কিন্তু আমি পেখমের মধ্যে দেখেছি ভিন্ন এক রূপ যা আমার সমস্ত হিসাব-নিকাশকে ভেংগে চুরমার করে দিয়েছিল।
ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরীতে, ঢাকায় বই মেলায় বা ঢাকায় বৈশাখের প্রথম দিনে বা নব-বর্ষের দিনে যোগ দিতে বার বার যে ভিসার আবেদন করেছিল, কিন্তু সে ভিসা পায় নি। তাঁর কথায় আচরণে বুঝেছি যে হয়তো সীমান্ত মানতে চায় না, নিয়ম মানতে চায় না, ঢাকায় বই মেলায় বা বাংলা নব-বর্ষের দিনে যোগ দেওয়ার ইচ্ছাটা ছিল একটি অছিলা মাত্র, আমি সেটা জানতাম আমি এক খুব সাধারণ বা সাধারণ একজন যুবক হয়ে আমি কী ভাবে তাঁর একটি নতুন ভুবন তৈরী হলাম আর সে ভুবনের একক বাসিন্দা হওয়ার কেন এত তার তীব্র বাসনা !! একটি উৎভ্রান্ত নেশা যেখানে সে তাঁর জীবনের, পরিবারের সমস্ত বন্ধনের হিসাব নিকাশ শূণ্য করে দিতে চেয়েছে তার প্রিয় দেশ, মাটি, প্রিয় জনের ত্যাগের বিনিময়েও !!
আমাকে দেখার, আমার কাছে আসার তীব্র আকাংখা পেখমের কত তীব্র তা বুঝার বাকি রইল না, আমার সমস্ত চেতনাকে হার মানিয়ে দিল, মনে হলো পেখম তার হাজার হাজার পেখম বা পাখা মেলে দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবতার পৃথিবীতে পেখম পাখা মেলে উড়তে পারে নি; আমার কাছে, আমাকে দেখতে আসতেও পারে নি। এরপরেও ফেসবুকে নানান কথা হত, নানান পরিকল্পনার কথা, সামনের দিনের নানান স্বপ্নের কথা।, তারপরও সেটাও ধীরে ধীরে কমে আসলো।
আজও খুব ষ্পষ্ট, কোলকাতায় সেদিনটা ছিল আমার শেষ বিকাল, শরৎকাল, নীল আকাশ, ঝক ঝকে আলো, আকাশে এক খন্ড, দুই খন্ড মেঘ কিছু বাংলা বই কেনার জন্য আমি তখন কোলকাতা নিউ মার্কেটের কাছে একটি বইয়ের দোকানে, পেখম প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা বই কেনার জন্য খুব মনযোগী হয়ে বইয়ের পাতা উল্টিয়ে প্রিয় লেখায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। সেই সময় পেখমের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আমিও প্রভাত কুমারের বই কেনার চষ্টা করছিলাম, হঠাৎ দেখাতে তাঁর সাথে কথা বলার বেশ একটা আগ্রহ বেড়ে গেল, অন্য দেশের এক যুবক পরিচয় দিলে একজন পর্যটকের মর্যদা পাওয়া যাবে বা আলাপাচারিতা শুরু হবে এই ভেবে নিজেই বললাম “ঢাকা থেকে এসেছি বই কিনতে”।
হেসে বলল তাই !! শুনেছি ঢাকায় বই মেলা নাকি দারুন জমে উঠে, নিজেই বলল ‘আমার নাম পেখম’ ।
আমি বললাম ‘পায়রাগুলি পেখম মেলেছে।’ আমার দিকে বেশ অন্য রকমের দৃষ্টিতে তাকালো, মনে হল চির দিনের চেনা।
আমি বললাম ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি, ঝোটন বেঁধেছে। আমার নাম নোটন।’
বহু দিনের না দেখা, বহু দিনের কথা না বলা, বহু দিন ধরে প্রিয় কন্ঠ স্বর না শুনা পেখম ঠিক কেমন আছে আমার জানা নেই, তবুও জন্ম দিনের শুভেচ্ছা সহ কার্ড পাঠালাম। হয়তো পেখম আরো বড় হয়েছে, আরো শান্ত ও স্থির হয়েছে, হয় তো নিজের পরিকল্পনা মত একজন বুদ্ধিমতীর মত এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিনগুলিতে। কিন্তু সে থেকে গেল আমার কাছে একটি বড় বিশ্ময়।
আমার কাছে থাকা প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের সেই ছোট গল্পের সংকোলন বইটি আজও ছুঁয়ে দেখি, বইয়ের পাতা উল্টাই কিন্তু গল্প গুলিতে প্রিয় লেখক প্রভাত কুমার কী লিখেছেন তা আর পড়া হয় নি, শুধু প্রতি পাতায় পাতায় দেখি পেখমের সেই প্রিয় মুখ, সেই চোখ, সেই চাঞ্চলতা, সেই হাসি যেন জীবন্ত পেখম, জীবন্ত পেখম ছোঁয়া। কুসুম কুসুম ষ্পর্শ।
আমার জানা নেই যে মানুষের জীবনে দূর্দান্ত প্রেম আসে কতবার !! হয়তো জীবনে শুধু আসে একবারেই, আর পেখম থেকে গেল আমার জীবনে একজন চির দিনের চেনা হয়েই।
নোট: ছবি নেট থেকে সংগ্রহিত।
রেটিং করুনঃ ,
অসাধারণ।
কি ভাব ভাষা আর উপস্থাপনা!
গল্পটি অনেক ভাল লেগেছে।
কি ভাব ভাষা আর উপস্থাপনা!
মন্তব্যে মুগ্ধ মালেক ভাই, আরো লিখার আশা আছে। শুভেচ্ছা জানবেন।
:bye:
ইমো দিয়ে মন্তব্য করাতে আর বিদায় জানানোর ইমোর জন্য ধরে নিলাম গল্পটি কোন গল্পই হয় নি – এমন ভাবে হতাস করে দিলে দেখবেন এ দেশ থেকে একদিন গল্পকাররা সবাই বিদায় নিয়েছে !!
রব্বানী ভাই এত ভালো গল্প লিখতে পারেন এটা আগে জানা ছিল না। খুব ভালো লাগল।
প্রেরণা যোগানো মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, এমন অনুপ্রেরণা পেলে ঠিকই গল্প লিখে যেতে পারব আশা রাখি প্রামানিক ভাই।
গল্পে অনেক অনেক ভালো লাগা রব্বানী ভাই।
একদিন আমাকে বলল ‘বাসায় বাবা -মা, ভাই ও বোনকে ফাঁকি দিয়ে শুধু তোমার কণ্ঠ স্বরটি শুনার জন্য তোমাকে ফোন দিতাম।’ এ কথাটি শুনার পর আমার আর বুঝতে বাকি থাকলো না যে, পৃথিবীর এ – প্রান্ত আর ও – প্রান্ত বলে কিছু নেই আজ পেখমের কাছে, এদেশ, সে দেশ সীমান্ত রেখা, পাসপোর্ট, ভিসা এ সবই অর্থহীন, মূল্যহীন শুধু মাত্র আমার কণ্ঠ স্বরটি শুনার কাছে।
সম্ভবত মানুষেরই পাখির মতো মন থাকে!
শুভকামনা জানবেন। সবসময়।
এমন অনুপ্রেরণা মূলক মন্তব্যে কে না লিখে থাকতে পারে !! সব সময় পাশে থাকার জন্য ও চমৎকার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ,
বার বার পড়ার মত গল্প, তাই কয়েকবার গল্পটি পড়ে গেলাম।
আপনাদের অনুপ্রেরণায় আমার গল্প লেখার চেষ্টা সেই সাথে শুভেচ্ছা জানবেন অনেক।
আগামী পহেলা অক্টোবর পেখমের জন্মদিন ও শারদীয় পূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে আমিও কিছু :rose: :rose: :rose: পাঠালাম