প্রথম আলো চিঠি নির্বাচন -২০১৩
———————————————–
প্রায় এক শত ষাটটি চিঠির মধ্য থেকে কয়েকটি চিঠি ( অন্তত আট নয়টি চিঠি ) প্রাথমিক ভাবে নির্বাচন করা আর সেখান থেকে আর একটি চিঠি আয়োজনের জন্য নির্বাচন করা বহু পথ হাঁটার সমান। তবে একটি সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যেত যদি প্রাথমিক ভাবে নির্বাচন করা সব কয়েকটি চিঠিকে সেরা চিঠি বলে প্রকাশ করা যেত, নিয়ম মেনে চলার পৃথিবীতে নিয়ম মেনে চলতে হয় আমাদের, আমার হাতে ক্ষমতা শুধু একটি চিঠিকে সেরা চিঠিকে হিসাবে মনোনিত করা।
লেখিকা নুসরাত জাহান আজমী তাঁর বাবাকে লেখা চিঠি, যে চিঠি বাবা কখনো পড়বেনা। যে চিঠির উত্তর কখনো আশা করা যায় না _____ নামে চিঠিটিতে তাঁর প্রিয় বাবা ছাড়া একটি দীর্ঘ সময়ের কথা কখনও হালকা, কখনও ভারি আবেগে উল্লেখ করেছেন। বিচারক হিসাবে নুসরাত জাহান আজমীর চিঠিটি সেরা একটি চিঠি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। বাবাকে দেওয়া দুইটি চিঠিতে দুই রকমের অনুভুতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন, মায়ের সাহায্য নিয়ে যে চিঠিটি লিখেছিল সেখানে লেখিকা লিখেছেন “ আম্মুকে জিজ্ঞেস করে করে লিখেছিলাম। শেষ করে সবাইকে পড়িয়ে শুনিয়েছিলাম। কি যে উত্তেজনায় ছিলাম, চিঠি পড়ে তুমি কি করবে, কেমন করবে, তাই শুধু ভাবছিলাম।” প্রসংগত লেখিকার তখন প্রায় শিশুকাল।
অনেক বছর পরে, অনেক পথ পাড়ি দিয়ে, অনেক চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে লেখিকা যখন প্রায় তরুণীতে পা দিয়ছেন তখন অনেকটা পরিপক্ক অভিজ্ঞতায় যখন তিনি বুঝেছেন যে যারা চির দিনের জন্য চলে যায় তাঁরা আসলেই আকাশের তারা হন না, এটি শিশুদের বুঝানোর জন্যে – চিঠিতে লেখিকা লিখেছেন ” যখন আমি ছোট ছিলাম তখন জানতাম,মানুষ মারা গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়। আমিও কথাটা মানতাম। এখন তো জানি, ব্যাপারটা ছেলে ভুলানো কাজ ছাড়া আর কিছুই না। “
অনেক বাস্তবতা জেনে, অনেক বাস্তবতা মেনেও এখনও লেখিকা রাতের আকাশে সেই তারাদের মাঝে তাঁর সেই প্রিয় বাবাকে খুঁজার চেষ্টা করেন। রাতের আকাশে তারার পানে চেয়ে চেয়ে লেখিকা হয়তো এখনো ভাবেন রবি ঠাকুরের ভাবনার সাথে তার মিলিয়ে
“ওই যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড়
আকাশের নীড়,
ওই যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী
গ্রহ তারা রবি,”
চিঠিতে লেখিকা লিখেছেন ” কিন্তু কেন জানিনা এখনও যদি রাতের বেলা ছাদে যাই একবার হলেও তারাগুলোর মাঝে তোমার চেহারা খোঁজার বৃথা চেষ্টা করি। “
প্রিয় বাবাকে স্মরণে এনে বেশ বড় হয়ে এবার লেখিকা একা একাই চিঠি লিখতে বসেছেন আর এবার লেখিকা জানে এবার এ চিঠি লেখায় কোন উত্তেজনা নেই অথবা এ চিঠি লেখার কোন অর্থও নেই বা সব কিছুর অর্থ খোঁজাও যায় না লেখিকা লিখেছে “ আজ এতো বছর পর তোমার মেয়েটা আবার তোমাকে চিঠি লিখছে। আজ কোন উত্তেজনা নেই, আজ এই চিঠি তোমার মেয়ে কাউকে পড়িয়ে শুনাবে না।”
স্মুতি যে মানুষের বড় একটি সম্পদ লেখিকা তা তাঁর চিঠিতে বেশ ষ্পষ্ট করে বর্ণনা দিযেছেন লেখিকা লিখেছেন “এটা ঠিক, আমি কখনও কাউকে বলতে পারবনা, বাবার পিঠে চড়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলেছি। কখনও বলতে পারব না,স্কুল থেকে ফেরার পথে বাবা আমাকে লাল বেলুন খানা কিনে দিতো।”
আমাদের জীবনে নানান ধরণের শূণ্যতা আসে, দুঃখ আসে, বেদনা আসে আবার সুখ, আনান্দ ফিরে ফিরে আসে কিন্তু কখনও কখনও অনেক শূণ্যতা পূরণ হয় না, সাময়িক ভাবে কিছু শূণ্যতা পূরণের চেষ্টা করা হলেও কোন কোন শূণ্যতা কখনই পূরণ হয় না, লেখিকা লিখেছেন “আম্মু,নানা ভাইয়া,খালামনিরা কখনও তোমার শূন্যতা অনুভব করতে দিত না। কিন্তু এখন বুঝি, তোমার চলে যাওয়ায় কত বড় শূন্যতা এসে জায়গা করে নিল আমাদের জীবনে।”
ইরানের জগৎ বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়াম তাঁর এক রুবাই – এ লিখেছেন – যদি এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডেরের ঘুর্ণায়মান চক্রে সৃষ্টিকর্তার মত ওমর খৈয়ামের কোন হাত থাকত তবে আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীকে তিনি ছিনিয়ে নিতেন, ওমর খৈয়াম এমন একটি পৃথিবী সৃষ্টি করতেন যেখানে মানুষের সকল বাসনা আশা পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। চিঠিটিতে লেখিকা ওমর খৈয়ামের মত কতকগুলি অবাস্তব কথা লিখেছেন চিঠিটি পড়ার সময় এক সময় মনে হলো কেন ওমর খৈয়াম নিজের মত করে একটি বিশ্ব গড়ার কথা ভেবে ছিলেন !! লেখিকা চিঠিতে লিখেছেন – “তাই মাঝে মাঝে মনে হয়,তুমি যদি হঠাৎ কখনও চলে আসতে, তাহলে আমরা কেমন করতাম? এতটা বছর তোমাকে ছাড়া অভ্যস্ত জীবনে ফিরে এলে তখন কি স্বাভাবিক আচরন করতাম? উদ্ভট এই চিন্তাগুলো তোমার মেয়ের মাথায় প্রায়ই ঘুরপাক খায়। আরও কত চিন্তা ঘুরে,”
কঠিন পথ ধরে যে পৃথিবীতে আমাদের চলাচল ভালো-মন্দ মানুষের তাল মিলিয়ে, আমাদের যে প্রতি নিয়ত নানান পরীক্ষায় অংশ নিয়ে হয় আর বাবা ছাড়া এ পৃথিবী যে প্রতি মুহূর্ত জীবনের একটি কঠিন পরীক্ষা-খানা হয়ে যায় চিঠিতে তা বেশ ষ্পষ্ট হয়েছে, নুসরাত জাহান আজমী লিখেছেন – “মাঝে মাঝে তোমাকে আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, দুরে বসে আমাদের কঠিন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা দেখছ কিনা?”
বসবাসের এ পৃথিবীতে অসহায় এক মেয়ে এক কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন মূলতঃ আমাদের, আমরা যারা সঠিক চলার পথ ধরে চলেছি এখনও এ পৃথিবীতে। নুসরাত জাহান আজমী লিখেছেন “মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে, দুরে বসে সব কিছু ঠিক করে দিতে পারবে, বাবা?”
নুসরাত জাহান আজমীর প্রতি আমাদের অভিনন্দন রইলো, দোয়া রইলো, সামনের দিনগুলিতে লেখিকার চলার পথ আরও সহজ ও আরও উজ্বল হোক। শুধু নুসরাত জাহান আজমী নয় আমাদের অনেকেরই জীবনের চলার পথে প্রতি বাঁকে বাঁকে মারাত্মক ধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের অনেক রহস্য আমাদের জানা নেই।
“সৃষ্টির রহস্য জানো না তুমি, জানি না আমি
এ এমন এক জটিল বাক্য যা পড়তে পারো না তুমি, না আমি
পর্দার আড়ালে তোমায় ও আমার মাঝে চলছে এ আলাপ
পর্দা যেদিন উঠে যাবে সেদিন থাকবে না তুমি ও আমি।”
—————————ওমর খৈয়াম।
তারিখ : জুন ২২, ২০১৩
রেটিং করুনঃ ,