১৯৯৩ সালে হঠাৎ একদিন কর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া এক বক্তব্যে কোম্পানির চেয়ারম্যান পুরোনো চিন্তাভাবনা আর কাজের ধারা পরিত্যাগ করে পরিবর্তনের পথে হাঁটার আহ্বান জানালেন। বললেন, ‘চলো, আমরা নিজেদের বউ–বাচ্চা ছাড়া অন্য সবকিছু বদলে ফেলি।’ যেই কথা, সেই কাজ। নিজেদের মজুতে থাকা দেড় লাখ মোবাইল ফোন সেটের সব কটি পুড়িয়ে ফেললেন। এমন অভিনব আচরণ করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার বহুজাতিক কোম্পানি স্যামসাং গ্রুপের চেয়ারম্যান লি কুন–হি।
এর আগে ১৯৮৭ সালে কোম্পানির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা গুরুত্বপূর্ণ এক ক্রান্তিকালে আছি। এই অবস্থায় আমরা যদি পুঁজিঘন ও প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পের দিকে না যাই, তাহলে আমাদের ঝুঁকির মুখে পড়তে হবে।’ তখনই কথা অনুযায়ী কাজ শুরু করেন তিনি। ফলে স্যামসাং টিভি, কম্পিউটার চিপ ও মধ্যম ও উচ্চ দামের স্মার্টফোনের ব্যবসায়ে জাপানি ও মার্কিন কোম্পানিগুলোকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যায়। বিশেষ করে স্মার্টফোন আর মেমোরি চিপে স্যামসাং বিশ্বের বৃহত্তম ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে।
স্যামসাংয়ের চেয়ারম্যান লি কুন–হি গত ২৫ অক্টোবর মারা যান। পিতার ছোট্ট ব্যবসাকে তিনি শুধু নিজ দেশের বৃহত্তম কোম্পানিই নয়, বরং বিশ্বেরই একটি শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তোলেন। স্যামসাংয়ের অন্যান্য ব্যবসায়ের মধ্যে রয়েছে ইলেকট্রনিকস, বৈদ্যুতিক প্রকৌশল, প্রযুক্তি, হার্ডওয়্যার, বিমা, শিপিং ইত্যাদি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
দেশের শীর্ষ ধনী
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের তৈরি বিলিয়নিয়ার তালিকা অনুযায়ী, তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ ধনী। তাঁর নিট সম্পদের মূল্য ২১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দক্ষিণ কোরিয়ার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পাঁচ ভাগের এক ভাগ।
লি কুন–হি ছিলেন লি–বাইউং–শুল ও পার্ক দু–এউল দম্পতির তৃতীয় পুত্র। লি–কুন ১৯৪২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দেগুতে জন্ম নেন। এর চার বছর আগে ১৯৩৮ সালে তাঁর পিতা স্যামসাং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন কোম্পানিটি ফল ও শুঁটকি রপ্তানি করত। এরপর এটি যুদ্ধবিধ্বস্ত কোরিয়ার চাহিদা অনুযায়ী এক করে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, বস্ত্রের ব্যবসা শুরু করে। পরবর্তীকালে স্যামসাং বিমা, জাহাজ নির্মাণ, নির্মাণসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ে জড়িত হয়।
বক্সার থেকে বিশ্বখ্যাত ব্যবসায়ী
লি কুন–হি হাইস্কুলে পড়ার সময়ে ছিলেন মুষ্টিযোদ্ধা। তিনি ১৯৬৫ সালে জাপানের রাজধানী টোকিওর ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। তবে লেখাপড়া শেষ করেননি। ১৯৬৬ সালে তিনি পারিবারিক মালিকানাধীন টংইয়াং ব্রডকাস্টিং কোম্পানিতে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে পরিবারের অন্যান্য ব্যবসায়েও জড়িত হন। ১৯৭৯ সালে কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান হন। আর পিতা লি–বাইউং–শুলের মৃত্যুর পর ১৯৮৭ সালে তিনি এই গ্রুপের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। এরপর তিনি প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবসা শুরু করেন এবং সফল হন।
স্যামসাংয়ের ‘নিভৃতচারী রাজা’
লি কুন গণমাধ্যমের সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না। গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চললেও নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের কারণে তাঁর সুখ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়, ‘দ্য হারমিট কিং’ বা ‘নিভৃতচারী রাজা’ হিসেবে।
কোরীয় অর্থনীতির ‘শাইবোল’
লি কুনের দক্ষতা ও নৈপুণ্যে স্যামসাং হয়ে ওঠে দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম ব্যবসায়িক গ্রুপ বা শিল্পগোষ্ঠী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তীকালে দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই গোষ্ঠীর যথেষ্ট অবদান ও প্রভাব রয়েছে। পারিবারিক মালিকানাধীন এ ধরনের বৃহৎ কোম্পানিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘শাইবোল’ নামে ডাকা হয়, যারা প্রায়ই আইনকানুনকে ছাড়িয়ে যায় এবং রাজনৈতিকভাবেও খুব প্রভাবশালী।
স্যামসাংয়ের বিরুদ্ধে অতীতে অস্বচ্ছ
রাজনৈতিক যোগসাজশ ও ব্যবসায়িক লেনদেনের অভিযোগ ছিল। এ জন্য লি কুন দুবার দণ্ডত হন। এর মধ্যে একবার সাজা পান সাবেক প্রেসিডেন্ট রোহ তায়ে উকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে। কর ফাঁকি ও অর্থ আত্মসাতের কারণে ২০০৮ সালে তাঁকে স্যামসাংয়ের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অপসারণ ও তিন বছরের কারাদণ্ড দেন দক্ষিণ কোরিয়ার আদালত। পরে ২০০৯ সালে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান। আর ২০১০ সালে তিনি আবার কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর ছেলে লি জায়ে–ইওংও ঘুষ কেলেঙ্কারির কারণে জেল খাটেন। ঘুষের এই ঘটনার জেরে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক জিউন–হাই ২০১৭ সালে অপসারিত ও দণ্ডিত হন। লা কুনের পুত্র লি জায়ে স্যামসাংয়ের পরবর্তী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে পারেন।
করোনাকালে সেরা নিয়োগদাতা
করোনাকালে কর্মীদের ছাঁটাই ও বেতন কর্তন না করে বরং আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য স্যামসাং সম্প্রতি বিশ্বের সেরা নিয়োগদাতা বা কোম্পানির তালিকায় প্রথম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্বের ৫৮টি দেশের ৭৫০টি বহুজাতিক কোম্পানির ১ লাখ ৬০ হাজার কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়ে সেরা নিয়োগদাতাদের এই তালিকা তৈরি করেছে।
সূত্র: প্রথম আলো
সূত্র: বিবিসি, ফোর্বস, দ্য গার্ডিয়ান ও নিউইয়র্ক টাইমস।
তারিখ: নভেম্বর ০২, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,