গ্র্যাজুয়েশন শেষে শুরু হয় আসল ছাত্রজীবন
যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক ব্যাধিবিষয়ক প্রধান বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউচি। ২০১৮ সালের ১৩ মে যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসের সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী। পড়ুন তাঁর সেই সমাবর্তন বক্তৃতার নির্বাচিত অংশ।
এইউ থেকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত। তোমাদের অনেকের চেয়ে এই ক্যাম্পাসে আমি বেশি সময় কাটিয়েছি। কয়েক ব্লক পরেই আমি থাকি। ৪০ বছর ধরে সকালে বা সন্ধ্যায় এই ক্যাম্পাসে জগিং করি। এখন যেহেতু ‘অনারারি গ্র্যাজুয়েট’ স্বীকৃতি পেয়েই গেছি, তোমাদের ওয়াশরুম ব্যবহার করতে অপরাধবোধ কিছুটা কম হবে।
সমাবর্তন এবং ‘সারা জীবন ছাত্র থাকার ধারণা’ দুটো পরস্পরবিরোধী বিষয়। যেহেতু আজ তোমরা সমাবর্তন পাচ্ছ, স্বাভাবিকভাবেই ভাবতে পারো, আজকের পর থেকে তোমরা আর সত্যিকার অর্থে ছাত্র নও। জেনে রাখো, এটা ভুল। আমার ক্ষেত্রে যেমন সমাবর্তনের পরই আমি বুঝতে পেরেছি, ছাত্রজীবন তো কেবল শুরু। যে বিষয়েই পড়ো, যে পেশাই বেছে নাও, যদি নিজের কাছে সৎ থাকতে চাও আর তোমার সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চাও, তোমাকে আজীবন ছাত্র থাকতে হবে। শিগগিরই বুঝতে পারবে, তুমি যতটা জানতে চাও, ততটা কখনোই তোমার জানা হবে না। জ্ঞানের খাঁড়া দেয়াল বেয়ে ওপরে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে সব সময় আরও জানার এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আমি এখনো নতুন কিছু শেখার তাড়না অনুভব করি, শেখার প্রক্রিয়াটা উপভোগ করি।
যেকোনো সময় তুমি এমন পরিস্থিতিতে পা রাখতে পারো, যা এখনো অনাবিষ্কৃত, এমনকি সুপ্রতিষ্ঠিত ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। অতএব অপ্রত্যাশিত কিছুর প্রত্যাশা করো এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, অভাবনীয় সুযোগগুলো কাজে লাগাও। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটা ঘটনা বলি, যেটা নাটকীয়ভাবে আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে নিউইয়র্ক হাসপাতাল করনেল মেডিকেল সেন্টার থেকে ইন্টার্নাল মেডিসিনে আমার প্রশিক্ষণ শেষ করি। সে বছরই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সামনে গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছিলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ও টিকার শক্তিতে আমরা ‘সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়ে গেছি’ এবং এখন আমাদের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক অন্য কোনো ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়া উচিত, অন্য বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করা উচিত। ভাগ্যের কী পরিহাস, তখন আমি মাত্রই একটা ফেলোশিপ নিয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে (এনআইএইচ) সংক্রামক রোগ নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেছি। মনে আছে নিউইয়র্ক থেকে বেথেসডা, এমডির এনআইএইচে যাওয়ার পথে ভাবছিলাম, আমি কি পেশাজীবনে ভুল পথে পা বাড়ালাম? আমি কি এমন একটা কাজের ক্ষেত্রে প্রবেশ করলাম, যা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে? এ যেন স্কি ইনস্ট্রাক্টর হওয়ার জন্য মায়ামি যাত্রা। আমার পেশার জন্য ভাগ্যক্রমে এবং পৃথিবীর জন্য দুর্ভাগ্যক্রমে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ভুল ছিলেন। ১৯৮১ সালে এইডসের মহামারি শুরু হলো, যা শুধু আমার পেশাজীবন নয়, আমার সমগ্র জীবনই বদলে দিয়েছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, এইচআইভি বা এইডস দিয়েই সংক্রামক রোগের হুমকি শেষ হয়ে যাবে না।
আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের পেশাজীবনের পথ যা-ই হোক না কেন, সমাজের নানা সমস্যা থেকে আমরা চোখ সরিয়ে নিতে পারি না। সমাজের অনেক অংশ এখনো দারিদ্র্য, মাদকাসক্তি, সহিংসতা, স্বাস্থ্যবৈষম্য, অপর্যাপ্ত শিক্ষা, ভেদাভেদ এবং হতাশায় ভুগছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের শহরেও এমন অনেকে আছে। তোমাদের মধ্যে অনেকে এসব সমস্যা সমাধানে সরাসরি নিজের জীবন উৎসর্গ করবে। আবার অনেকের পক্ষেই সেটা সম্ভব হবে না। কিন্তু জনসাধারণের সেবা করতে হলে যে সরকারি চাকরিই করতে হবে, এমন তো নয়। যে পেশায়ই থাকো না কেন, জনসেবা করার সুযোগ তোমার থাকবে। দয়া করে এটা মাথায় রেখো এবং জীবনের অংশ করে নিয়ো।
তোমরা একটা অনন্যসাধারণ প্রতিষ্ঠান থেকে সমাবর্তন নিচ্ছ। আমেরিকান ইউনিভার্সিটির তরুণেরাই আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎ নেতা। কিন্তু নেতৃত্বগুণ তৈরি হয় ধাপে ধাপে, যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই তোমরা শুরু করে দিয়েছ। বলছি না আনুষ্ঠানিক কোনো পদ নিয়ে তোমাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। নেতৃত্বের অনেক ধরন থাকে। নীরবে নিভৃতেও নেতৃত্ব দেওয়া যায়। এক মুহূর্তের জন্যও কখনো ভেবো না, নেতৃত্ব দেওয়ার বয়স তোমার হয়নি। (সংক্ষেপিত)
সূত্র: অনুষ্ঠানের ভিডিও
লেখক: মো. সাইফুল্লাহ
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ১৮, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,