(বোসিস এবং ফিলোমোনের গল্পটি যদিও আফ্রোদিতি চক্রের মধ্যে পড়ে না, এটি মূলত জিউস চক্রের ভালোবাসার কাহিনী, তবুও এখানে দেওয়া হলো। )
অনেক দিন আগের কথা। দেবরাজ জিউসের স্বর্নসময় তখন। স্বর্গ থেকে মর্ত্য শাসন করছিলেন দোর্দন্ড প্রতাপে। স্বর্গে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেলে জিউস নেমে আসতেন মর্ত্যে, বেশিরভাগ সময় লিপ্ত হতেন কোনো মরণশীল নারীর সাথে কোনো অনৈতিক কাজে! কিন্তু জিউস যে শুধু মর্ত্যের নারীদের সাথে মিলিত হবার জন্যই মর্ত্যে আসতেন, তা কিন্তু নয়! তিনি মাঝে মাঝে মানুষেরা অতিথিদের সাথে কেমন ব্যবহার করে, সেটা দেখতেও মর্ত্যে আসতেন।
জিউস ছিলেন অতিথিদের রক্ষক। তাঁর এইসব ভ্রমনে তাঁর সাথে থাকতেন দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে ধূর্ত কিন্তু আমুদে হার্মিস।
ঠিক সেই সময়ে ফ্রিজিয়া নামক একটি দেশ ছিলো, যা ছিলো আনাতোলিয়ার মধ্য-পশ্চিম প্রান্তে। বর্তমানে এলাকাটি তুরস্কের অন্তর্গত, সাকারইয়া নদীর তীরে অবস্থিত। এই দেশের খুব বিখ্যাত একজন শাসক ছিলেন গর্ডিয়াস, গ্রীক মিথোলজিতে যাকে নিয়ে একটি কাহিনী আছে, যা গর্ডিয়ান নট (Gordian Knot) নামে পরিচিত।
হোমারের ইলিয়াড অনুযায়ী, ট্রোজান যুদ্ধের সময় এই ফ্রিজিয়ানরা ট্রয়ের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলো। পরবর্তীকালে আলেকজান্ডার দি গ্রেট ফ্রিজিয়া দখল করে নেন, এবং তারও পরে ফ্রিজিয়া পারসিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ফ্রিজিয়ার লোকেরা খুব রুক্ষ ব্যবহারের জন্য নিন্দিত ছিলো। তারা তাদের নিজেদের নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকতো যে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসতো না। ট্রয়কে সাহায্য করার পিছনেও মনে হয় কোনো স্বার্থ ছিলো।
যা হোক, জিউস এবং হার্মিস ঠিক করলেন, তাঁরা ফ্রিজিয়াতেই বেড়াতে যাবেন এবং এর অধিবাসীদের জানিয়ে দিলেন যে তাঁরা আসছেন।
ফ্রিজিয়ার মানচিত্র
দেবরাজকে খুশি করার জন্য ফ্রিজিয়ার প্রত্যেক মানুষ সেরা খাবার তৈরী করলো। তাদের ঘরবাড়িকে খুব সুন্দরভাবে সাজালো। তারা নিজেরা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে, জমকালো পোশাক পরে দেবতা জিউসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু জিউস আর হার্মিস ফ্রিজিয়াতে এলেন না!
সেদিন সন্ধ্যার দিকে দুইজন দরিদ্র পথিককে ফ্রিজিয়ার রাস্তায় দেখা গেলো এবং তাঁরা পথে পথে হেঁটে বেড়াতে লাগলেন।
তাঁরা তাঁদের পথে প্রতিটি বাড়িতে, হোক সেটা পর্ণ কুটির বা প্রাসাদোপম বাড়ি, করাঘাত করলেন খাবার এবং আশ্রয় চেয়ে। কিন্তু ফ্রিজিয়ার কেউই তাঁদেরকে আশ্রয় এবং খাবার দিতে রাজী হলো না, যদিও জিউসের আগমন উপলক্ষ্যে তাদের ঘরে অনেক খাবারই ছিলো। বরঞ্চ তারা মুখের উপরেই অবজ্ঞাভরে দরোজা বন্ধ করে দিলো। সেই দুইজন পথিক যখন মোটামুটি স্থির সিদ্ধান্তে এলেন, ফ্রিজিয়ার কেউ অতিথি পরায়ন নয়, তখনই দারিদ্র পীড়িত এক ক্ষুদ্র পর্ণকুটিরের সামনে হাজির হলেন, যে কুটিরটি ছিলো ফ্রিজিয়ার সবচেয়ে দরিদ্রতম কুটির, যার ছাদ ছিলো কেবলমাত্র নলখাগড়ায় ছাওয়া।
কিন্তু যখন কুটিরে করাঘাত করা হলো, এর দরোজাটি খুলে গেলো প্রশ্বস্তভাবে এবং একটি উৎফুল্ল কণ্ঠস্বরের অনুরোধে তাঁরা যখন ভিতরে প্রবেশ করলেন, তখন দেখলেন, এক ছিমছাম এবং পরিচ্ছন্ন কক্ষ, যেখানে এক বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা মায়াভরা চোখে তাঁদেরকে স্বাগত জানালেন।
বৃদ্ধা মহিলা তাঁদেরকে একটি নরম চাদর দিলেন এবং বৃদ্ধটি আগুন জালিয়ে দিলেন, যাতে তাঁরা আরাম করতে পারেন।
বৃদ্ধ লোকটির নাম বোসিস এবং বৃদ্ধা মহিলাটির নাম ফিলোমোন। এই বৃদ্ধ দম্পতি পথিক অতিথিদের দেখে অনুভব করলেন, জিউসের চেয়ে এদের খাদ্য এবং আশ্রয় বেশি প্রয়োজন। জিউসের জন্য রাখা প্রায় সবকিছুই তারা অতিথিদের সামনে আনতে লাগলেন। তারা বললেন, তারা বিয়ের পর থেকেই এই কুটিরে আছেন।
তারা হয়তোবা দরিদ্র হতে পারেন, কিন্তু তাদের থেকে সুখী কেউ নেই। “আমাদের তেমন কিছু নেই আপনাদেরকে আপ্যায়ন করার মতো, কিন্তু যেখানে আত্মা থাকে ধনী এবং ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, সেখানে দারিদ্রতা কিছুই করতে পারেনা,” লজ্জিত কিন্তু হাসিমাখা কণ্ঠে বৃদ্ধটি বললেন তাঁদেরকে। অতিথি দুইজন নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলেন। তাঁরা অনুভব করলেন, সব ফ্রিজিয়ানই হয়তোবা খারাপ নয়, এই দম্পতি আছে, যাদের অন্তর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
বোসিস এবং ফিলোমোন তাদের অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
তাঁদের জন্য অলিভ, ডিম, গরম পানি, বাঁধা কপি, শুকরের মাংসের আয়োজন করলেন। বৃদ্ধ বোসিস একটি টেবিল পাতলেন, যার একটি পায়া ছিলো খাটো, সেটা তিনি ভাঙ্গা বাসনের এক টুকরা দিয়ে ভারসাম্য আনলেন। অতিথিদের বসার জন্য দিলেন দুটি গদিযুক্ত আসন এবং এতে হেলান দিয়ে খাবার গ্রহন করার জন্য অনুরোধ করলেন।
বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা জিউসের জন্য সঞ্চিত করে রাখা ভিনেগার সদৃশ মদ নিয়ে এলেন এবং তাঁদেরকে গ্লাসে ঢেলে দিতে লাগলেন। ফিলোমোন নৈশভোজের সাথে পানীয় দিতে পারায় যারপরনাই সুখী এবং গর্বিত বোধ করতে লাগলেন এবং প্রতিটি গ্লাস নিঃশেষ হওয়ার সাথে সাথে তা পুনরায় পূর্ন করার দিকে খেয়াল রাখলেন।
বয়োবৃদ্ধ দম্পতি অতিথি আপ্যায়নে এতোই মগ্ন ছিলেন, অনেক পরে তাদের খেয়াল হলো মদের বোতল থেকে যতোই মদ গ্লাসে ঢালা হোক না কেনো, মদ আগের জায়গাতেই থেকে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে না!
বোসিস আর ফিলোমোন ভয় পেয়ে অতিথিদের উদ্দেশ্যে মাথা নত করলেন। তারা বুঝতে পারলেন, অতিথিরা সাধারণ কোনো অতিথি নয়। তারা কম্পমান কণ্ঠে তাদের দরিদ্র আপ্যায়নের জন্য অতিথিদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বোসিস বললেন, “আমাদের একটি রাজ হংসী আছে। আমাদের উচিৎ ছিলো আপনাদের জন্য এটিকে উৎসর্গ করা।
কিন্তু আমাদেরকে এখনো যদি একটু সময় দেন, তাহলে আমরা সেটা রান্না করতে পারি”। কিন্তু রাজ হংসীটিকে ধরা ছিলো তাদের সাধ্যের বাইরে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন সেটাকে ধরা গেলো না, তখন অতিথি দুইজন ভাবলেন, এখন সময় হয়েছে কিছু একটা করার।
দেবরাজ জিউস এবং হার্মিসের জন্য ফিলোমোন রাজহংসীটিকে ধরার চেষ্টা করছেন (শিল্পী- জোহান হেইজ, ১৬৪০-১৭০৪ সাল)
তাঁরা বললেন, “অনেক খেয়েছি। এবার একটু রাতে থাকার জন্য জায়গা দিলে আমাদের খুব সুবিধা হয়”।
বোসিস আর ফিলোমোন তাদের নিজেদের বিছানা ছেড়ে দিলেন, নিজেরা নলখাগড়া বিছিয়ে মাটিতে শুয়ে পরলেন। সকাল বেলা যখন ঘুম থেকে উঠলেন, দেখলেন, অতিথিদের একজনকে দেখাচ্ছে সূর্যের মতো তেজোদীপ্ত। বয়োবৃদ্ধ দম্পতির বুঝতে বাকী রইলো না, অতিথিদের একজন হচ্ছেন দেবরাজ জিউস! “তোমরা হলে দেবতাদের আতিথ্য প্রদানকারী,” জিউস নিজেদের পরিচয় দিলেন, “তোমরা অতিথিদের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল, ফ্রিজিয়ার অন্য লোকদের মতো নয়। তোমরা তোমাদের কাজের পুরষ্কার পাবে, বাকি সবাই পাবে তাদের কাজের প্রতিফল। বাইরে যাও, এবং দেখ!” জিউসের কথা শুনে বোসিস আর ফিলোমোন কুটির থেকে বাইরে এসে অবাক হয়ে গেলো।
তাদের কুটির ছাড়া আর সমস্ত জায়গা এক বিশাল হ্রদে পরিণত হয়েছে। সেই হ্রদের পানিতে ডুবে মারা গেছে ফ্রিজিয়ার সকল মানুষ। দেশবাসীর এই দুর্দশা দেখে এই বৃদ্ধ দম্পতি অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন, যদিও ফ্রিজিয়ার মানুষজন তাদের সাথেও খুব একটা ভালো ব্যবহার করতো না। একটু পরেই তারা আরো চমকিত হলো। চোখের পলকেই তাদের পর্ণ কুটিরটি পরিণত হলো শ্বেত মার্বেলের রাজকীয় স্তম্ভময় এবং স্বর্ণ-ছাদ বিশিষ্ট এক মন্দিরে।
জিউস এবার বললেন, “তোমরা কিছু প্রার্থনা করো, যা চাইবে, তাই পাবে”। বৃদ্ধ দম্পতি খুব দ্রুত নিজেদের মধ্যে কানে কানে কিছু একটা বললো, তারপর ফিলোমোন বলে উঠলেন, “আমরা এই মন্দিরের পুরোহিত হতে চাই। আর যেদিন থেকে আমরা একত্রে বসবাস করছি, সেদিন থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হইনি। আমাদের মৃত্যুও যেনো একসাথে হয়”। জিউস আর হার্মিস “তথাস্তু” বলে স্বর্গে চলে গেলেন।
সেই মন্দিরে বোসিস এবং ফিলোমোন অনেক বছর একসাথে থাকলেন। তারা নিজেদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব, ততটুকু সাহায্য করলেন অন্যান্য মানুষদেরকে। তারা ছিলেন সবসময়ই সুখী, নিজেদের প্রতি বিশ্বস্ত এবং তাদের অন্তর ছিলো পরস্পরের জন্য ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। একসময় তারা অতি বৃদ্ধ হলেন। একদিন সন্ধ্যা বেলায় বোসিস ফিলোমোনকে বলতে লাগলেন, “আমাদের মৃত্যুর সময় হয়ে এসেছে।
কিন্তু যদি আমরা আজীবন একসাথে থাকতে পারতাম!” ফিলোমোনও এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমারো ইচ্ছা তাই। যদি আজীবন একসাথে থাকতে পারতাম!”
পরদিন সকাল বেলায় দেখা গেলো সেই শ্বেত মার্বেলের রাজকীয় স্তম্ভময় এবং স্বর্ণ-ছাদ বিশিষ্ট মন্দিরটি আর নেই, অদৃশ্য হয়ে গেছে। বোসিস আর ফিলোমোনও নেই! মন্দিরের জায়গায় দেখা গেলো দুইটি সুন্দর গাছ, একই গুড়ি থেকে রাতারাতি জন্ম নিয়েছে- একটি ওক গাছ, আরেকটি লিন্ডেন বা লেবু গাছ।
কেউও জানতে পারলেন না, কি হয়েছিলো এই বয়োবৃদ্ধ দম্পতির। অনেক অনেক বছর পর, একজন পথিক ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে সেই দুটি গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।
যখন মৃদু বাতাস বইছিলো, তিনি হঠাৎ শুনতে পেলেন, ওক গাছটি ফিসফিস করে লিন্ডেন গাছকে বলছে, “আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে ফিলোমোন, তবুও আমি এখনো তোমায় অনেক ভালোবাসি,” লিন্ডেন গাছটিও ফিসফিসিয়ে জবাব দিচ্ছে, “আমারো অনেক বয়স হয়ে গেছে বোসিস, কিন্তু আমিও তোমাকে সেই আগের মতোই খুব ভালোবাসি”।
(মডারেটরের দৃষ্টি আকর্ষন- এই লেখাটি প্রায় এক বছর পূর্বে আমি প্রথম আমার নিজস্ব ব্লগে এবং চতুর্মাত্রিক ব্লগে লিখি। এখন এই সচলায়তনে গ্রীক মিথলজির উপর সিরিজ লেখার জন্য, মূল লেখা থেকে ইষৎ সংক্ষেপিত করে দেওয়া হয়েছে এবং খুব সামান্যই পরিবর্তন করা হয়েছে। মডারেটর যদি মনে করেন, এতে সচলায়তনের নিয়ম ভঙ্গ হতে পারে, তাহলে পোষ্ট না করলেও হবে। সেক্ষেত্রে আমি কীভাবে বুঝতে পারবো? )
এই সিরিজের আগের লেখাগুলোঃ
সৃষ্টিতত্ত্বঃ পর্ব-১: বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডের সৃষ্টি এবং ইউরেনাসের পতন পর্ব-২: টাইটান যুগের সূচনা এবং অলিম্পিয়ানদের জন্ম পর্ব-৩: প্রথম টাইটান যুদ্ধ এবং জিউসের উত্থান পর্ব-৪: মানবজাতির সৃষ্টি, প্রমিথিউস এবং পান্ডোরা উপাখ্যান পর্ব-৫: প্রমিথিউসের শাস্তি এবং আইও পর্ব-৬: আবার যুদ্ধ- জায়ান্ট এবং টাইফোয়িয়াস পর্ব-৭: ডিওক্যালিয়নের প্লাবন
দেবতাদের গল্পঃ এথেনা এবং আফ্রোদিতি পর্ব-৮: জিউস, মেটিস এবং এথেনার জন্ম পর্ব-৯: এথেনার গল্পকথা-প্রথম পর্ব পর্ব-১০: এথেনার গল্পকথা- দ্বিতীয় (শেষ) পর্ব পর্ব-১১: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ হেফাস্টাস এবং অ্যারিসের সাথে ত্রিমুখী প্রেমকাহিনি পর্ব-১২: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ অ্যাডোনিসের সাথে অমর প্রেমকাহিনী পর্ব-১৩: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ এনকেসিসের সাথে দূরন্ত প্রেম
ভালোবাসার গল্পঃ পর্ব-১৪: পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়া পর্ব-১৫: পিরামাস এবং থিসবি পর্ব-১৬: হিরো এবং লিয়েন্ডার
লেখকঃ এস এম নিয়াজ মাওলা
ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট
রেটিং করুনঃ ,