Welcome to rabbani basra

আমার লেখালাখির খাতা

শুরু হোক পথচলা !

Member Login

Lost your password?

Registration is closed

Sorry, you are not allowed to register by yourself on this site!

You must either be invited by one of our team member or request an invitation by email at info {at} yoursite {dot} com.

Note: If you are the admin and want to display the register form here, log in to your dashboard, and go to Settings > General and click "Anyone can register".

গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন যেসব কৌশলে অপহরণ করা হতো (২০২৪)

Share on Facebook

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত শনিবার গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিরোধী মতের মানুষকে গুমের সঙ্গে কারা জড়িত, কীভাবে গুম করা হতো, কীভাবে নির্যাতন বা হত্যা করা হতো, তার নানা বর্ণনা উঠে এসেছে। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে নানা চিত্র। প্রতিবেদনে অপহরণের কৌশল নিয়ে উঠে আসা চিত্র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে রাস্তা থেকে বা বাড়ি থেকে অপহরণ করত। এমনকি ফেরি বা জনসমাগমস্থল থেকেও ধরে নেওয়া হতো। বাসা থেকে ধরলে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সামনে এমন নির্দয়ভাবে পেটায় যে পরিবারের লোকজন মানসিকভাবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যান।

অন্তবর্তী সরকারের গঠিত গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। গত শনিবার গুম কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাধারণত রাস্তা বা বাসা থেকে মানুষজনকে অপহরণ করা হতো। সচরাচর রাতেই অপহরণ করা হতো। অবশ্য সব অপহরণ যে রাতে হতো, তা কিন্তু নয়। অপহরণকারীরা সাধারণত সাদাপোশাকে এসে নিজেদের “প্রশাসনের লোক”, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা ডিবি অথবা র‌্যাবের সদস্য বলে পরিচয় দিতেন।’

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যেসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে তাঁদের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হতো, সেসব ক্ষেত্রে পরিবারগুলো বড় ধরনের মানসিক অভিঘাতে থাকত। কারণ, চোখের সামনে প্রিয়জনকে মারধরের দৃশ্য তাঁরা দেখতেন, তাঁদের চোখের সামনে থেকেই তাঁদের গুম করা হতো। অনেক ক্ষেত্রে যাঁদের সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তভোগীদের ফেরি, রাস্তার পাশ অথবা অন্যান্য জনসমাগমস্থল থেকেও অপহরণ করা হতো। বড় গাড়িতে জোর করে টেনে তোলার আগে তাঁদের প্রায়ই নাম ধরে ডাকা হতো। সাধারণত হাইয়েস মডেলের গাড়িতে (তাঁদের) তোলা হতো। গাড়িতে তোলার পরপরই তাঁদের চোখ বেঁধে ফেলা হতো, হাতকড়া পরানো হতো এবং অস্ত্র ধরে হুমকি দেওয়া হতো। প্রায় সময় মারধর বা বৈদ্যুতিক শকের মতো নির্যাতন করা হতো, গাড়িতে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই এসব শুরু হতো।

এতে আরও উল্লেখ করা হয়, কখনো কখনো অন্যদের উপস্থিতিতে এসব অপহরণের ঘটনা ঘটত। তবে এমন কোনো প্রত্যন্ত জায়গা থেকেও অপহরণ করা হতো, যেখানে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী থাকত না। ফলে কী ঘটেছিল, তা প্রমাণ করাটা অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন হয়ে যেত। উদাহরণস্বরূপ, ভুক্তভোগী জীবিত ফিরে এসেছিলেন এমন একটি ঘটনার কথা বলা যায়। ওই ঘটনা সম্পর্কে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, ‘আমি তাঁর সঙ্গে (অপহরণের শিকার ব্যক্তি) চা খেলাম। এরপর ওই ব্যক্তি বাসার দিকে রওনা হলেন। ১৫ মিনিট পর রাস্তার ধারে আমি তাঁর সাইকেল ও বইপত্র পড়ে থাকতে দেখি।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ঘটনায় যেহেতু ভুক্তভোগী বেঁচে ছিলেন, তাই প্রত্যক্ষদর্শী ও তাঁর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে টুকরা টুকরা গল্পগুলো জোড়া দিয়ে তাঁর অপহরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ফিরে আসেননি, বিশেষ করে তাঁদের যদি জনবামানবহীন বা প্রত্যন্ত কোনো এলাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেসব ঘটনায় অপহৃত ব্যক্তিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা বোঝারও কোনো প্রমাণ থাকে না।

জনাকীর্ণ এলাকা থেকে অপহরণের কৌশল সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্রতিবেদনে একটি ফেরির ঘটনার উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘এমনকি জনাকীর্ণ শহরগুলোতেও অপহরণ ঘটনা ঘটত। এসব অপহরণ এতটাই ধূর্ততার সঙ্গে করা হতো যে কী ঘটেছে, তা প্রত্যক্ষদর্শী হয়তো তাৎক্ষণিক বুঝতে পারতেন না। উদাহরণ হিসেবে একটি ফেরির ঘটনার কথা বলা যায়। ওই ঘটনায় সাদাপোশাকে র‍্যাব কর্মকর্তারা ভুক্তভোগীর কাছে যান। শনাক্ত করতে যাতে সুবিধা হয়, সে জন্য তাঁকে তাঁর ফেসবুকের ছদ্মনাম ধরে ডাকেন তাঁরা।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে ভুক্তভোগীর সঙ্গে র‍্যাব কর্মকর্তাদের আলাপ-আলোচনা বন্ধুত্বপূর্ণ ও বিশেষত্বহীন বা সাধারণ বলে মনে হয়েছিল। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে আরও কর্মকর্তারা চলে আসেন এবং ভুক্তভোগীকে দ্রুত ফেরি থেকে নামিয়ে গাড়িতে তোলেন। পুরো বিষয়টি এতটাই সাবলীল ও দ্রুত হলো যে এটা যে অপহরণ ছিল, তা বিদেশিসহ অন্য যাত্রীরাও বুঝে উঠতে পারেননি।

গুমের পর লাশও গুম: কারও লাশ রেললাইনে, কারও নদীতে

জোরপূর্বক বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে ৪৮ ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস, এমনকি ৮ বছর পর্যন্ত গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখা হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিকে মাথায় গুলি করে হত্যার পর লাশের সঙ্গে সিমেন্টভর্তি ব্যাগ বেঁধে ফেলে দেওয়া হতো নদীতে। আবার কারও লাশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে ফেলে রাখা হতো রেললাইনে।

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর নৃশংস নির্যাতনের এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক এই প্রতিবেদন গত শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনের ‘প্রকাশযোগ্য অংশ’ গতকাল রোববার বিভিন্ন গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

কমিশনের তদন্ত, ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বক্তব্যে উঠে এসেছে গুম ও নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক সময় কাউকে আটকের পর নির্যাতন করে অন্যদের নাম বের করা হতো। এরপর তাঁদেরও ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। পরে সবাইকে গুম করা হতো। এ ছাড়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি অথবা তাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সরাসরি নির্দেশে গুম ও নির্যাতন করা হতো। কারও যৌনাঙ্গসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো, কাউকে পেটানো হতো। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের নির্যাতন করতে বিশেষ যন্ত্রও ব্যবহার করা হতো।

আরও পড়ুন
গুমের জন্য কীভাবে টার্গেট করা হতো, নজরদারি হতো যেভাবে
১২ ঘণ্টা আগে
গুমের জন্য কীভাবে টার্গেট করা হতো, নজরদারি হতো যেভাবে
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৭ আগস্ট কমিশন গঠন করে। এই কমিশন ১ হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ পর্যালোচনা করেছে তারা। কমিশন এখন পর্যন্ত যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করেছে, তার মধ্যে ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন। বাকি ২৭ শতাংশ (অন্তত ২০৪ জন) এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

কমিশন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের অনেককে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরকদ্রব্য আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন অথবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন আইনে করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চারটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে এমন সব ঘটনাকে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে কমিশন। সেগুলো হলো ভুক্তভোগীর স্বাধীনতা হরণ; ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের সম্পৃক্ততা অথবা তাদের প্ররোচনা থাকা; বন্দীর অবস্থান সম্পর্কে তার পরিবারকে না জানানো এবং ভুক্তভোগীকে কোনো আইনি সুরক্ষা না দেওয়া।

প্রতিবেদনে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও মুক্তি—এই পাঁচ ভাগে গুমের ঘটনাগুলোর কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই—এই গুমের

ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাধারণত সাদাপোশাকে ভুক্তভোগীদের তুলে নেওয়া হতো এবং নিজেদের পরিচয় গোপন করার জন্য এক সংস্থা আরেক সংস্থার নাম ব্যবহার করত। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিনিময় করার তথ্যও র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যের মাধ্যমে পেয়েছে তদন্ত কমিশন। সুখরঞ্জন বালি এবং বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদকে গুমের পর ভারতে স্থানান্তরের ঘটনা কমিশনের প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। এ ছাড়া হাসিনা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার গুমের ঘটনায় সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

যেভাবে গুম করা হতো
প্রতিবেদনে বলা হয়, যাঁকে গুম করা হতো, প্রযুক্তির সহায়তায় তাঁর অবস্থান আগেই জেনে নেওয়া হতো। ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) এবং পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) মোবাইলে নজরদারি পরিচালনা করত বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে আসে।

কমিশন বলেছে, গুমের ঘটনাগুলোতে জড়িত বিভিন্ন সংস্থা ও বাহিনীর সদস্যরা কখনো নিজেদের ‘প্রশাসনের লোক’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) অভিযান চালিয়ে নিজেদের র‍্যাব বলে দাবি করত। আবার র‍্যাব (র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) নিজেদের ডিজিএফআই হিসেবে পরিচয় দিত—এমন ঘটনাও ঘটেছে। সাধারণত গুম বা অপহরণের ঘটনাগুলো ঘটত রাতে। ভুক্তভোগীকে বাড়ি বা সড়ক থেকে জোরপূর্বক গাড়িতে (মাইক্রোবাস) তুলে নেওয়া হতো। এরপর চোখ বাঁধা হতো এবং হাতকড়া পরানো হতো। ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটত যে আশপাশে থাকা মানুষ বুঝতেও পারত না যে কাউকে অপহরণ করা হয়েছে।

নির্যাতনের বর্ণনা
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে নির্যাতন ও হত্যার কয়েকটি ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, আটকের পর ভুক্তভোগীদের সাধারণত গোপন অন্ধকার কক্ষে রাখা হতো এবং সেখানেই তাঁদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হতো। কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কমিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এমন আটটি গোপন বন্দিশালার সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে। যেগুলো ডিজিএফআই, র‍্যাব, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট পরিচালনা করত।

নির্যাতনের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালে ঢাকার ধানমন্ডি থেকে র‍্যাব এক যুবককে অপহরণ করে কোনো চেতনানাশক ছাড়াই তাঁর ঠোঁট সেলাই করে দেয়। গুম করে অনেককে হত্যা করার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হতো। লাশ সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। যেসব নদীতে লাশ গুম করা হতো, তার মধ্যে রয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা। নদীতে লাশ ফেলার জন্য ঢাকার পোস্তগোলা ও কাঞ্চন ব্রিজ ব্যবহার করা হতো।

র‌্যাবে কর্মরত একজনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এক ভুক্তভোগী নদীতে ঝাঁপিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। পরে তাঁকে উদ্ধারের পর সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়। আরেকটি ঘটনার বর্ণনায় বলা হয়, একটি লাশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে রেললাইনের ওপর ফেলে রাখা হয়েছিল। আরেকটি ঘটনায় তুলে নেওয়া এক ব্যক্তিকে সড়কে চলন্ত গাড়ির সামনে ধাক্বা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। তবে গাড়িটি পাশ কেটে চলে যাওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

একটি ব্রিজের ওপর দুজন ভুক্তভোগীকে গুলি করে হত্যার ঘটনা র‍্যাবের একটি ‘ওরিয়েন্টেশন’ অনুষ্ঠানে দেখানো হয়েছে—এমন তথ্য কমিশনকে জানিয়েছেন এক সাক্ষী।

গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলছে, গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় জানতেনও না তাঁরা কাকে এবং কেন হত্যা বা নির্যাতন করছেন। এক দল কোনো ব্যক্তিতে তুলে আনত, অন্য দল তাঁকে বন্দিশালায় আটকে রাখার কাজ করত এবং তৃতীয় দল ওই ব্যক্তিকে হত্যা করত বা মুক্তি দিত।

গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
গুমের জন্য কীভাবে টার্গেট করা হতো, নজরদারি হতো যেভাবে

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে অনেক মানুষ গুম হয়েছে। গুমের ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার যে কমিশন গঠন করেছে, তাদের কাছে গুমের অভিযোগ এসেছে ১ হাজার ৬৭৬টি। প্রাথমিকভাবে এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ পর্যালোচনা করেছে কমিশন।

এই ১৬ বছরে সবচেয়ে বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে ২০১৬ সালে, ১৩০টি। এ ছাড়া ২০০৯ সালে ৫, ২০১০ সালে ১৯, ২০১১ সালে ২৩, ২০১২ সালে ৩৬, ২০১৩ সালে ৭৩, ২০১৪ সালে ৪৫, ২০১৫ সালে ৭৮, ২০১৭ সালে ৮৪, ২০১৮ সালে ৮৯, ২০১৯ সালে ৩৬, ২০২০ সালে ১৮, ২০২১ সালে ২৫, ২০২২ সালে ৪২, ২০২৩ সালে ৩৪ ও ২০২৪ সালে ২১টি গুমের অভিযোগ এসেছে।

গুমের শিকার ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গুমের বেশির ভাগ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল র‌্যাব, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই।

গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গুম সংস্কৃতি’ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে ঘুণাক্ষরেও কেউ কিছু বুঝতে না পারে। উদাহরণ হিসেবে সাদাপোশাকে নিরাপত্তা বাহিনীর তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। নিজেদের বদলে অন্য সংস্থার পরিচয় দেওয়া হতো। যেমন ডিজিএফআই হলে র‍্যাবের পরিচয় দেওয়া হতো, আর র‍্যাব হলে পরিচয় দিত গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি)। একটি বাহিনী তুলে নিয়ে আসার পর অন্য বাহিনীর কাছেও বন্দী থাকত। এরপর হত্যা বা মুক্তি দিত তৃতীয় কোনো বাহিনী।

গুমের শিকার এক ব্যক্তির কল রেকর্ড থেকে দেখা যায়, তাঁকে তুলে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই তাঁর মুঠোফোনের প্রথম অবস্থান শনাক্ত হয় ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরে। এরপর তাঁকে নেওয়া হয় ঢাকায় র‍্যাবের একাধিক আটক কেন্দ্রে। কয়েক মাস পর তাঁকে চট্টগ্রামে র‍্যাব-৭–এর গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয়। এতে বোঝা যায়, গুমের শিকার কোনো ব্যক্তিকে জীবিত পাওয়া গেলেও তাঁকে কোন বাহিনী তুলে নিয়েছিল, তা বোঝা খুব কঠিন।

এসব কারণে গুমের শিকার ব্যক্তিকে হত্যায় যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁরাও জানতেন না কাকে তাঁরা হত্যা করছেন অথবা এই হত্যার কারণ কী, কেনই–বা এই হত্যাকাণ্ড ঘটছে। বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত করেছেন যে এসব তথ্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা গোপন রাখতেন। এর মাধ্যমে কখনো যাতে নেতৃস্থানীয় কাউকে তদন্তের মুখোমুখি হতে না হয় এবং দায়ীদের বিচার করা না যায়, সে বন্দোবস্ত করা হতো।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুলে নেওয়ার পর গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে হাতবদল, এক বাহিনীর এলাকায় অন্য বাহিনীর তৎপরতা ও এসব তৎপরতার নির্দিষ্ট কোনো একটি সীমানা না থাকায় গুমের ঘটনাগুলোর তদন্ত জটিল করে তুলেছে।

‘টার্গেট’ নির্ধারণ হতো যেভাবে
গুমসংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাকে গুম করা হবে, এটা কীভাবে নির্ধারণ করা হতো, সে বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছানোর মতো পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এখনো কমিশন পায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে টার্গেট নির্ধারণের দুটি পদ্ধতির বিষয় উঠে এসেছে।

প্রথমটি একটি নেটওয়ার্কভিত্তিক পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে বন্দীদের নির্যাতন করে অন্যদের নাম বলতে বাধ্য করা হতো। এরপর যাঁদের নাম আসত, তাঁদের তুলে আনা হতো। তুলে এনে নির্যাতন করে তাঁদেরও নাম বলতে বাধ্য করা হতো। এর মাধ্যমে দীর্ঘ হতো গুম করা ব্যক্তিদের তালিকা।

এ ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তিদেরও গুমের শিকার হতে হয়েছে। এমন অনেক ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেখানে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নাম বলতে বাধ্য করে নিরপরাধ ব্যক্তিদের তুলে আনা হয়েছে। নাম বলতে বাধ্য হয়েছিলেন এমন একজন ব্যক্তি জানান, তিনি বাধ্য হয়ে এমন ব্যক্তিদের নাম বলেছিলেন, যাঁরা ছিলেন নিরপরাধ। তিনি ভেবেছিলেন, অপরাধী না হওয়ায় এসব ব্যক্তির হয়তো কিছু হবে না। কিন্তু পরে তিনি শুনেছেন, তিনি যাঁদের নাম বলেছিলেন, তাঁদের একজনকে গুম করা হয়। এটা নিয়ে অনুতাপের কথা জানান তিনি।

দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সরাসরি নির্দেশ। এরও প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। উদাহরণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত র‍্যাব ১১-এর তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার তারেক সাইদ মোহাম্মদ ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছিলেন, সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য তাঁকে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন র‍্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) জিয়াউল আহসান।

গুমের শিকার হওয়ার পর যখন ছেড়ে দেওয়া হয়, সেই সময় কী বলা হয়েছিল, তাঁর স্মৃতিচারণা করেছেন হুম্মাম কাদের চৌধুরী। ছেড়ে দেওয়ার সময় তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আছে। আপনি রাজনীতি করতে পারবেন না। দেশ ছেড়ে যেতে হবে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে দেশে ফিরতে পারবেন। মনে রাখবেন প্রধানমন্ত্রী আপনাকে জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ঘটনা থেকে গুমের পদ্ধতির বিষয়ে কিছু কিছু ধারণা পাওয়া গেলেও এ বিষয়ে একটি জোরালো উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য আরও তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। এ নিয়ে আরও তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কমিশন।

যেভাবে করা হতো নজরদারি
গুমের শিকার ব্যক্তি ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে কমিশন জানতে পেরেছে, গুমের ক্ষেত্রে নজরদারির প্রধান হাতিয়ার ছিল মুঠোফোন প্রযুক্তি। কমিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে র‍্যাব ও সামরিক কর্মকর্তারা এই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে টার্গেট করা ব্যক্তির অবস্থান নিখুঁতভাবে শনাক্ত করার কাজ মুঠোফোনে নজরদারি করা ছাড়া অসম্ভব।

ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) নামে একটি স্বাধীন নজরদারি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার আগে এর পূর্বসূরি ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টারের (এনএমসি) মাধ্যমে নজরদারি করা হতো। এর অবস্থান ছিল ডিজিএফআই সদর দপ্তরে।

শুধু নজরদারির কাজে ব্যবহৃত প্রযুক্তি-পদ্ধতি র‍্যাব ও ডিবির মতো অন্য বাহিনীর কাছে সরবরাহ করত ডিজিএফআই। ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টারে নজরদারি প্রযুক্তি পরিচালনা করতে বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের রাখা হতো। তাঁরা পালা করে এ দায়িত্ব পালন করতেন। ডিজিএফআইয়ের সাবেক একজন মহাপরিচালক (ডিজি) কমিশনকে বলেন, নজরদারির জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে কারিগরি সহযোগিতা দিত ডিজিএফআই।

এসব ঘটনা নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সমন্বিতভাবে গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি তুলে ধরছে। এনটিএমসি প্রতিষ্ঠার পর নজরদারির তৎপরতাগুলো স্বাধীন এই সংস্থার একক কর্তৃত্বে চলে আসে। তবে প্রাথমিক কিছু প্রতিবেদন থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে নজরদারি করার কিছু ক্ষমতা এখনো নির্দিষ্ট বাহিনীর কাছে রয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এর অন্যতম কারণ, এই সংস্থাগুলোর নজরদারি করার আইনি ক্ষমতা নেই।

আইনি ক্ষমতা না থাকার পরও গুমের শিকার বেশ কিছু ব্যক্তির কথায় জানা গেছে, ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে থেকেই তাঁদের ওপর নজরদারি চলত। উদাহরণ হিসেবে গুমের শিকার ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। একজন জানান, স্ত্রীর দাঁতের চিকিৎসা নিয়ে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে কথোপকথনের বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন, ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে থেকে তাঁর ওপর নজরদারি চলছিল। গুমের শিকার আরও একাধিক ব্যক্তি জানান, ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে তাঁদের মুঠোফোনে সন্দেহজনক কল আসে। কল আসত কিন্তু অপর প্রান্তে কেউ কথা বলত না।

টার্গেট করা ব্যক্তিদের অবস্থান নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করার জন্যই এ ধরনের কল করা হতো। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কীভাবে একটি কক্ষে ঢুকেছিলেন। কক্ষে ঢুকে তাঁরা সেখানে থাকা সবার মুঠোফোন সারিবদ্ধভাবে রাখার নির্দেশ দেন। এরপর একটি মুঠোফোনে কল আসে। তখন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জানতে চান, ফোনটি কার? ফোনের মালিক কে শোনার পর তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪

রেটিং করুনঃ ,

Comments are closed

বিভাগসমূহ

Featured Posts

বিভাগ সমুহ