লেখক:হাসান ফেরদৌস নিউইয়র্ক।
আজ ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৬তম স্বাধীনতা দিবস। পৃথিবীর প্রাচীনতম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, মার্কিনদের দাবি অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক বিশ্বের বাতিঘর। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান একসময় তাঁর নিজের দেশকে বাইবেলে বর্ণিত ‘পাহাড় শীর্ষে আলোকোজ্জ্বল নগর’ হিসেবে দাবি করেছিলেন। সেই যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান, বর্ণ ও ধর্ম, স্থানীয় ও বহিরাগত ইত্যাদি প্রশ্নে দেশটি যেভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, তাতে এমন প্রশ্ন ওঠা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এমন কথাও উঠছে, এই দেশ অবিভক্ত অবস্থায় টিকে থাকবে তো? ক্লিনটন মন্ত্রিসভার সাবেক সদস্য রবার্ট রাইখের কথায়, ভবিষ্যতে নয়, এখনই যুক্তরাষ্ট্র এক নতুন গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এটা ঠিক প্রথাগত গৃহযুদ্ধ নয়। উনিশ শতকের মধ্যভাগে দাসব্যবস্থা নিয়ে যে যুদ্ধ বেধেছিল, এই যুদ্ধ তেমন নয়। এটা হলো অসুখী বিয়ের মতো। এই বৈবাহিক সম্পর্কের দুই শরিকের মধ্যে সম্পর্ক এখন এতটাই তিক্ত যে তারা আর একে অপরের সঙ্গে থাকতে নারাজ। গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক নিবন্ধে রাইখ প্রশ্ন তুলেছেন, আর কত দিন জোড়াতালি দিয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ ঠেকানো যাবে?
গত বছর ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে মার্কিন কংগ্রেসের ওপর সহিংস হামলার যে উন্মুক্ত শুনানি চলছে, তাতে এখন এ কথা স্পষ্ট, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রধান হুমকি দেশের সর্বোচ্চ মহল থেকে এসেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অশাসনতান্ত্রিক ক্যু বা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র এঁটেছিলেন। এই ষড়যন্ত্রে তিনি একা নন, রক্ষণশীল রিপাবলিকান এস্টাবলিশমেন্টের প্রায় সবাই তাঁকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। এই দলের দুই-তৃতীয়াংশ এখনো বিশ্বাস করে জালিয়াতি করে তাঁর নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। হাতে গোনা যে কয়েকজন রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য ক্যাপিটল হিলের হামলার বিরোধিতা করেন, তাঁদের অধিকাংশই ট্রাম্পের ক্রোধের শিকার হয়ে হয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন অথবা দলীয় বাছাই পর্বের নির্বাচনে (প্রাইমারি) পরাস্ত হয়েছেন। আগামী নভেম্বরে যে মধ্যবর্তী নির্বাচন, তাতে রিপাবলিকান দল নির্বাচন পরিচালনার জন্য এমন সব ব্যক্তির মনোনয়ন দিয়েছে, যাঁরা ট্রাম্পের মতোই মিথ্যা জয়ের দাবিদার। ২০২৪ সালে তাঁদের হাতে কি নির্বাচনের নিরপেক্ষতা রক্ষিত হবে?
পিছু হটছে গণতন্ত্র
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলেই গণতন্ত্র পিছু হটছে। ৩০ বছর আগেও ভাবা হচ্ছিল সব ধরনের স্বেচ্ছাচার অতিক্রম করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে গণতন্ত্র। কমিউনিজমের পতন হয়েছে, সামরিকতন্ত্র ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজছে, তথ্যব্যবস্থার ব্যাপক গণতন্ত্রায়ণ হয়েছে। এ কেবল গণতন্ত্রের বিজয় নয়, ধনতন্ত্রেরও বিজয়। এই বিজয় সম্বন্ধে কোনো কোনো পণ্ডিত এতটাই সন্দেহশূন্য ছিলেন যে তাঁদের কেউ কেউ ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ পর্যন্ত ঘোষণা করে বসেছিলেন।
তিন দশকও যায়নি, সেই সব পণ্ডিতই এখন হা-হুতাশ করে বলছেন, নামে গণতান্ত্রিক হলেও আসলে যাদের বিজয় হয়েছে, তাদের বড়জোর অনুদার বা ইললিবারেল গণতন্ত্র বলা যায়। এমন বিজয়ীদের একজন হাঙ্গেরির ভিক্তর অরবান, তিনি নিজের রাজনৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে এতটাই সন্দেহশূন্য যে নিজেই নিজেকে ‘ইললিবারেল’ বলে ঘোষণা করছেন।
খোলা চোখে দেখলে বোঝা যায়, সামনে এগোনোর বদলে বিশ্বজুড়ে সর্বত্র গণতন্ত্র পিছু হটছে। গণতন্ত্রের বৈশ্বিক অবস্থান বোঝার একটি মাপকাঠি হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের ফ্রিডম ইনডেক্স বা গণতন্ত্র সূচক। এই সংস্থা তাদের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ সম্পূর্ণ মুক্ত বা গণতান্ত্রিক দেশের বাসিন্দা। অন্যদিকে ৩৮ শতাংশ মানুষের বাস ‘মুক্ত নয়’, অর্থাৎ অগণতান্ত্রিক এমন দেশের বাসিন্দা। বস্তুত স্ক্যানডেনেভিয়ার গুটি কয় দেশ বাদ দিলে আর কেউই নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত বলে দাবি করতে পারে না। বাকি সব দেশ অংশত মুক্ত বা পার্টলি ফ্রি।
গণতন্ত্রের ওপর এই আক্রমণ আসছে মূলত পপুলিস্ট বা জনতুষ্টবাদী নেতাদের হাত থেকে, যাঁরা একদিকে গণতান্ত্রিক বহুপাক্ষিকতাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন, অন্যদিকে সীমাহীন ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত করছেন। এই ধরনের নেতাদের বলা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী, যেমন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো অথবা ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে।
যুক্তরাষ্ট্র ৮৩, বাংলাদেশ ৩৯
কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তা নির্ণয়ের জন্য ফ্রিডম হাউস ১০০ নম্বরের ভিত্তিতে একটি পরিসংখ্যানগত কাঠামো ব্যবহার করে থাকে। এই কাঠামোর দুটি সূচক: রাজনৈতিক অধিকার (অর্থাৎ নির্বাচন ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ) এবং নাগরিক অধিকার (অর্থাৎ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা)। এই দুই সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান তেমন সুস্থ নয়। যেমন রাজনৈতিক অধিকারে তারা পেয়েছে ১৫ নম্বর, আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পেয়েছে ২৪ নম্বর। সব মিলিয়ে ৩৯ নম্বর। সেই কারণে বাংলাদেশ ‘অংশত মুক্ত’।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যদিও মোটের ওপর মুক্ত বা গণতান্ত্রিক, ২০২০ সালের নির্বাচন-উত্তর ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার পর তার অবস্থান দুর্বল হয়েছে। ২০২০ সালে তার প্রাপ্ত মোট নম্বর ছিল ৮৬। ২০২১ সালে কমে তা ৮৩-তে দাঁড়িয়েছে। নম্বরের হিসাবে হেরফের সামান্য হতে পারে, কিন্তু এই অবনমনের তাৎপর্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
যুক্তরাষ্ট্র বরাবর নিজেকে গণতন্ত্রের উজ্জ্বলতম উদাহরণ হিসেবে দেখাতে ভালোবাসে। সে সবার চেয়ে সেরা, সবার জন্য অনুকরণীয়। সেই দেশরই আজকের যে হাল, তাতে তাকে আর যা–ই হোক আলোকোজ্জ্বল নগরী বলা যায় না। এর চারদিকে বড় বেশি আঁধার জমেছে। ফ্রিডম হাউসের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিতে প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছে। নির্বাচনব্যবস্থা দলীয় ছলচাতুরীতে আক্রান্ত হয়েছে, বিচারব্যবস্থা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ায় রাজনৈতিক বিভাজন বেড়েছে।
তিন প-এর ইয়ারি
বামপন্থী মহলে মইসেস নাইম একটি সুপরিচিত নাম। ভেনেজুয়েলার হুগো শাভেজ সরকারের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী, দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক ও বিশ্বব্যাংকের পরিচালক, গত ৩০ বছর এ রকম নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। গত দেড় দশক অবশ্য তাঁর প্রধান পরিচয়, প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত ফরেন রিলেশন্স পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। দীর্ঘদিন থেকে তিনি উত্তর-দক্ষিণ সব দেশেই অল্প কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় কীভাবে তা গণতন্ত্রের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। শাভেজ থেকে ট্রাম্প, অধিকাংশ আধুনিক কর্তৃত্ববাদী শাসকই তাঁর তীব্র রোষের শিকার হয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ দ্য রিভেঞ্জ অব পাওয়ার–এ গণতন্ত্রকে হটিয়ে সেই গণতন্ত্রের লেবাস পড়েই কর্তৃত্ববাদ কীভাবে আসন গেড়ে নিচ্ছে, তার নতুন বিশ্লেষণ হাজির করেছেন।
নাইমের চোখে কর্তৃত্ববাদ ও একনায়কতন্ত্র এই দুইয়ের মধ্যে মস্ত কোনো তফাত নেই। উভয়ের লক্ষ্য একটাই, যেভাবে সম্ভব ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা। আগে সামরিক একনায়কেরা বন্দুক উঁচিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতেন। কিন্তু এখন ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাঁদের রয়েছে নতুন রণকৌশল, নতুন সরঞ্জাম। নাইম এই নতুন রণকৌশলের নাম দিয়েছেন ‘থ্রি পি’—পপুলিজম বা জনতুষ্টিবাদ, পোলারাইজেশন বা সামাজিক/রাজনৈতিক মেরুকরণ, এবং পোস্ট ট্রুথ বা বিকল্প সত্য। পুতিন, মোদি, এরদোয়ান বা ট্রাম্প–এঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের যাঁর যাঁর দেশের নাগরিক গোষ্ঠীর একাংশের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে উপস্থিত করে থাকেন। বিষয়টি এমন, ‘দেশের ভেতরে-বাইরে শত্রু সদা জাগ্রত, একমাত্র আমিই পারি তোমাদের রক্ষা করতে, আগলে রাখতে।’ নাইম একে জনতুষ্টিবাদ বলছেন বটে, কিন্তু সতর্ক করে দিয়েছেন, এটা নতুন কোনো রাজনৈতিক মতবাদ নয়। এটা একটা রণকৌশল মাত্র, যার একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা। কর্তৃত্ববাদী নেতা একা নন, তাঁর ক্ষমতা গ্রহণ থেকে লাভবান হয়, এমন একটি ক্ষুদ্র চক্র সর্বদা তাঁকে ঘিরে থাকে। বড় প্রমাণ পুতিন ও তাঁর সহচর অলিগার্কবৃন্দ এবং ট্রাম্পের বশংবদ রিপাবলিকান নেতৃত্ব।
কিন্তু শুধু ‘জনতুষ্টিবাদ’ দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা যায় না, এর জন্য প্রয়োজন নিজের সমর্থক ছাড়া অন্য সবাইকে শত্রু হিসেবে প্রমাণ করা। এই রাজনৈতিক বিভাজনের ফলে দেশের ভেতরে যে মেরুকরণ ঘটে, তাতে সবকিছুই ‘পক্ষে অথবা বিপক্ষে’ এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটা সময় ছিল যখন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান দেশের সব মানুষের নেতা হিসেবে শাসন করতেন। কিন্তু ট্রাম্প থেকে মোদি, পুতিন থেকে অরবান, এখন এঁদের সবাই নিজের প্রতিপক্ষকে রাষ্ট্রের ভয়াবহ শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে কেবল নিজেদের দলীয় সমর্থকদের কাঁধে ভর করেই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান।
কর্তৃত্ববাদের তৃতীয় অস্ত্র, সত্যকে ডিঙিয়ে বিকল্প সত্য হাজির করা। ক্ষমতাসীন মহল তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে লাভবান, এই বিবেচনায় সর্বপরিচিত এমন সত্য বা বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়ে এক বিকল্প সত্য বা বাস্তবতা প্রস্তাব করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। এ কাজে সাহায্যের জন্য অনুগত সংবাদমাধ্যম তো রয়েছেই, তার ওপরে রয়েছে নয়া সামাজিক তথ্যমাধ্যম। এই দুই শক্তি মিলে অনুগত সমর্থকদের জন্য নির্বাচনে পরাস্ত ট্রাম্পকে বিজয়ী প্রমাণ করতে পারে, অথবা সব পরিচিত ইতিহাস উপেক্ষা করে তাজমহলকে একটি হিন্দু মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সত্যের তো কোনো বিকল্প হয় না, নাইম একে তাই নাম দিয়েছেন পোস্ট-ট্রুথ বা উত্তর-সত্য। পপুলিজম, পোলারাইজেশন ও পোস্ট-ট্রুথের এই কাঠামোর সাহায্যে নব্য একনায়কেরা নিজেদের শুধু গণতান্ত্রিক নয়, জনগণের ইচ্ছার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে প্রমাণেও বদ্ধপরিকর।
ক্ষমতাসীন মহল ক্ষমতা আকড়ে থাকবে, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। রাজা-বাদশাহ থেকে আজকের পাতি নেতা, সবাই একবার ক্ষমতার স্বাদ পেলে তা আর ছাড়তে চান না। তবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানের তফাত হলো, শুধু বন্দুকের জোরে নয়, নির্বাচন নামক গণতান্ত্রিক বড়ি গিলিয়ে রাজনৈতিক ও আইনগত বৈধতা আদায় করে নেওয়া হচ্ছে। গণতন্ত্রের এই পোশাকি চেহারা ধরে রাখার জন্যই প্রয়োজন তিন প-এর ইয়ারি।
নেতা যখন শক্তির প্রতীক
আধুনিক অনুদার গণতন্ত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, কর্তৃত্ববাদী নতুন যে শাসনব্যবস্থা, তার কেন্দ্রে সর্বদাই এমন ব্যক্তি, যাঁদের ইংরেজিতে বলা হয় ‘স্ট্রংম্যান’। এঁরা নিজেদের শক্তির প্রতীক, আপসহীন এবং দৃঢ়সংকল্প হিসেবে প্রকাশ করতে অভ্যস্ত। সামরিক শক্তির যত্রতত্র ব্যবহার এই আপসহীনতার একটি লক্ষণ। ট্রাম্পের কথা ভাবুন। ২০২০ সালে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন রুখতে তিনি যুদ্ধ মন্ত্রী ও যৌথ সামরিক বাহিনীর প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। শোনা যায়, তিনি সে সময় ১০ হাজার সৈন্যকে রাস্তায় নামার আবদার করেছিলেন, কিন্তু সেনাপ্রধানের আপত্তির কারণে তা কাজে লাগেনি।
অথবা মোদির কথা ভাবুন। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে সন্ত্রাসী হিসেবে সন্দেহভাজন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে নিজের পুনর্নির্বাচন নিশ্চিত করেছিলেন। সে সময় তাঁর নির্বাচনী স্লোগান ছিল, আমাকে ভোট দেওয়া মানে শুধু ভোট মেশিনে একটা বোতাম টেপা নয়, বরং সব সন্ত্রাসীর মাথা লক্ষ্য করে ট্রিগার টেপা।
ব্রিটিশ সাংবাদিক গিডিয়ন রাখমান তাঁর নতুন গ্রন্থ দ্য রাইজ অব স্ট্রংম্যান–এ এই রাজনৈতিক লেঠেলদের পরিচয় করিয়েছেন এভাবে যে এসব নেতা বোলচালে জাতীয়তাবাদী, সাংস্কৃতিক প্রশ্নে রক্ষণশীল, সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে অসহিষ্ণু, সব রকম ভিন্নমতের বিরোধী। দেশের ভেতরে এঁরা সবাই নিজেদের ‘ক্ষুদ্র মানুষের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে দাবিদার এবং ব্যক্তিপূজার প্রবর্তক। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষত আদালত ব্যবস্থার এরা ঘোর বিরোধী। আইন ও বিচারব্যবস্থা নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর জন্য এঁরা প্রথম সুযোগেই নিজেদের পছন্দমতো বিচারপতিদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। পোল্যান্ড থেকে তুরস্ক, হাঙ্গেরি থেকে যুক্তরাষ্ট্র, সর্বত্রই এই চেষ্টার কথা আমাদের জানা।
ময়শে নাইমও নব্য কর্তৃত্ববাদীদের ব্যক্তিপূজায় উৎসাহদাতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ট্রাম্পের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, তাঁর কট্টর সমর্থকেরা শুধু রাজনৈতিক অনুসারী নয়, রীতিমতো ‘ফ্যান’ বা মুগ্ধ ভক্ত। ট্রাম্প নিজেও সে কথা বিশ্বাস করতেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে তিনি দাবি করেছিলেন, ‘আমি ফিফথ অ্যাভিনিউতে দাঁড়িয়ে কাউকে যদি গুলি করি, তারপরও আমার সমর্থকেরা আমার পক্ষেই ভোট দেবে।’ কথাটা বোধ হয় একদম মিথ্যা নয়। ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারির হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া সত্ত্বেও রিপাবলিকান ভোটাররা যে তাঁকে এখনো মাথায় করে রাখেন, তা থেকেই বোঝা যায় জনতুষ্টিতাবাদ কেন গণতন্ত্রের জন্য এত বড় হুমকি।
গণতন্ত্রের ক্যানসার
একজন বাক্সর্বস্ব ‘ডেমাগগের’ হাতে কী বিপদ হতে পারে, আজ থেকে প্রায় আড়াই শ বছর আগে, ১৭৭৯ সালে তাঁর ‘বিদায়ী ভাষণে’ সে কথার ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন। সেই লিখিত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক বিভক্তি ও দলাদলির সুযোগ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো সময়ে এমন ক্ষমতালোভী নেতার আবির্ভাব হতে পারে, যার লক্ষ্য নাগরিক কল্যাণ নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি।
জর্জ ওয়াশিংটনের সেই বিপদবার্তা যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দেয়নি, ফল হয়েছে ট্রাম্পের মতো বিপজ্জনক ও চতুর ডেমাগগের আবির্ভাব। ২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রথম যখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন, সে সময়েই সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়া তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য ক্যানসার নামে অভিহিত করেছিলেন। অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে সে কথা।
যে প্রথাগত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছিল, আমাদের চোখের সামনে, কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই আজ তা কীটগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। লাল ও নীলের (অর্থাৎ রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক) রাজনৈতিক বিভক্তি সামাজিক বিভক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই বিভক্তি এতই তীব্র যে এ দেশের ৪২ শতাংশ মানুষ ভিন্নদলভুক্ত মানুষদের ‘শয়তান ও ক্ষতিকর’ মনে করে। একে অপরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারেও তাদের ঘোর আপত্তি। ভার্জিনিয়ার সেন্টার ফর পলিটিকসের এক জনমত জরিপ অনুসারে, ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফলে অসন্তুষ্ট অধিকাংশ ট্রাম্প সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে। অন্যদিকে ৪১ শতাংশ বাইডেন সমর্থক মনে করে, দেশটাকে দুই ভাগে ভাগ করাই যথাযথ হবে। আরও ভয়ের কথা, দেশের প্রতি চারজনের একজন মনে করেন, তাঁদের দাবি প্রতিষ্ঠায় সহিংস পথ অনুসরণে অন্যায় কিছু নেই।
১৭৮৭ সালে ফিলাডেলফিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতিরা এক শাসনতান্ত্রিক সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের সামনে প্রধান প্রশ্ন ছিল, এই নতুন দেশটি কোন পথে এগোবে, রাজতন্ত্র না প্রজাতন্ত্র? যুক্তরাষ্ট্রের আদি পিতাদের একজন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনকে সে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রজাতন্ত্র, তবে তা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি।’
সত্যি যুক্তরাষ্ট্র তার প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্র ধরে রাখতে পারবে তো? স্বাধীনতার ২৪৬তম বার্ষিকীতে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে আশা নয়, ভয় জাগছে।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: জুলাই ০৪, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,