শুধু মায়ের মুখের একটু হাসির জন্য…
মার্কিন প্রযুক্তিবিদ ও উদ্যোক্তা অ্যালেক্সিস ওহেনিয়ান বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ওয়েবসাইট রেডিটের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান। তাঁর আরেকটি পরিচয় হলো তিনি বিশ্বখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় সেরেনা উইলিয়ামসের স্বামী। অ্যালেক্সিস স্নাতক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া থেকে। গত ২৩ মে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েই সমাবর্তন বক্তা হয়ে এসেছিলেন তিনি।
আজ তোমরা যেখানে আছ, ১৬ বছর আগে আমি ঠিক এই জায়গায় ছিলাম। সে সময় মাথায় শুধু ছিল, নিজের একটা কোম্পানি চালু করব। কিন্তু সেটা কী হবে, তার কোনো ধারণাই ছিল না। আরেকটা জিনিস ছিল তখন। একটা মাসকট। ক্লাসের একঘেয়েমি দূর করার জন্য এঁকেছিলাম। সেটাই এখন রেডিটের লোগো।
জীবনে যা ঘটছে, তা কখন আমাদের কোন দিকে নিয়ে যায়, আমরা বর্তমানে দাঁড়িয়ে তা বুঝতে পারি না। একটা সময় পর যখন একটার সঙ্গে আরেকটা ঘটনা মেলাই, তখন বোঝা যায়, সবই আসলে এক সুতোয় গাঁথা।
এই আয়োজন তোমাদের জন্য না
ভালো কথা, একটা স্পয়লার দিই তোমাদের। আজকের দিনের এত আয়োজন কিন্তু তোমাদের জন্য না। এটা সেই মানুষের জন্য, যাদের চেষ্টায়, অনুপ্রেরণায়, তাগিদে তোমরা আজ এ পর্যন্ত এসেছ। শুরুতে আমি এটা বুঝতে পারিনি। গ্র্যাজুয়েশনের কয়েক বছর পর যখন আমার মা মারা যান, তখন থেকে উপলব্ধি করতে শুরু করি। এখন মা নেই, আমার কাছে শুধু আছে সমাবর্তনের দিনে তোলা আমাদের ছবিগুলো।
ছবিতে তাঁকে কী যে খুশি আর গর্বিত দেখায়! দেখে মনে হয়, ১৬ বছর আগে আমার গ্র্যাজুয়েশন হয়নি, হয়েছিল তাঁর। আমার কথা ভেবে মা তাঁর ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে থাকার জন্য আমেরিকার বাইরে বড় চাকরি ছেড়ে আসতে হয়েছিল। এত সব ত্যাগের পরও তিনি কোনো দিন হতাশা প্রকাশ করেননি। আমাকে সব সময় বলতেন, আমি নাকি চাইলেই সব করতে পারি। এখন বুঝি, দিনটা আসলে তাঁর ছিল, আমার না।
শুধু মায়ের মুখের একটু হাসির জন্য…
তাই বলছি, সময় বের করে সব কাছের মানুষের কাছে যাও। তাঁদের জড়িয়ে ধরো। যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম, চেষ্টায় আর ভালোবাসায় তুমি আজ এ পর্যন্ত এলে, তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাও। তাঁদের মন খুলে বলো, তুমিও যে তাঁদের কতটা ভালোবাসো। এই সময়টা চলে গেলে, কাছের এই মানুষগুলো হারিয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই বিনা মূল্যে একটা ভালো উপদেশ দিচ্ছি, মনে রেখো। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, পস্তাবে না। পরিবারের সঙ্গে কাটানো সময় আর তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা হলো জীবনের সবচেয়ে সেরা বিনিয়োগ। এটা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
রেডিট আর মা
রেডিট শুরু করার কয়েক মাসের মধ্যে আমার মায়ের ব্রেন ক্যানসার ধরা পড়ে। তখন আমার বয়স ২১। মাকে বলে দেওয়া হয়, তাঁর হাতে আর কয় বছর সময় আছে। এই যে বেঁধে দেওয়া সময়, এমন পরিস্থিতিতে বোঝা যায় কাছের মানুষটাকে কত কিছু দেওয়ার ছিল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। তাই অনুরোধ করছি, কাছের মানুষের পেছনে সময় বিনিয়োগ করো। এই বিনিয়োগে কোনো লোকসান নেই।
শুরুর দিক থেকে রেডিটের ওপরের কোনায় ছোট ছোট ডুডল আঁকা থাকত। গুগল যেটা বিভিন্ন বিশেষ উপলক্ষে করে, ওটা আমরা রেডিটে নিয়মিত করতাম। আমার মা সাহস জোগাতেন। এমনকি তিনি যখন কেমোথেরাপির যন্ত্রণায় কাতর, আর আমি রেডিটকে দাঁড় করানোয় ব্যস্ত, তখনো তিনি তাঁর কষ্ট আমাকে বুঝতে দিতেন না। পাছে আমি হতাশ হয়ে যাই।
তিনি অনেক সময় আমার কাজের ধরন বুঝতেন না। এরপরও সময় করে আমার সঙ্গে কাজ নিয়ে কথা বলতেন। তাই আমিও মায়ের সঙ্গে আলাপ জমানোর জন্য, মা আলাপ করে আনন্দ পান, এমন কিছু রেডিটে যুক্ত করলাম। রেডিটের লোগোকে ঘিরে আঁকতে শুরু করলাম মজার মজার ডুডল। একটা ছোট ক্যানভাস নিয়ে প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে আঁকাআঁকি করতাম।
আমার কাছে এই ডুডলগুলো ছিল শুধু মায়ের সঙ্গে আলাপ লম্বা করার ছুঁতো মাত্র! আমি শুধু তাঁর মুখে একটু হাসি দেখতে চাইতাম। কিন্তু একটা সময় দেখলাম, এটা থেরাপির মতো কাজ করছে। এমনকি এই ডুডলগুলো অনেকের জীবনে প্রভাবও ফেলছে, অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। অনেকে আমাকে বলত, তারা নাকি প্রতিদিন এই আঁকাগুলো দেখতে রেডিটে ঢুঁ মারত। অনেকে আবার ওই ডুডল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ট্যাটুও করাত। তরুণ বয়সের ওই অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে এখনো নাড়া দেয়, আমাকে আরও বিনয়ী হতে শেখায়।
মনে রেখো, পরিবার হলো আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে মৌলিক উপাদান। তোমাদের বয়সে আমিও অবশ্য এটা বুঝতাম না। এখন নিজে বাবা হওয়ার পর বুঝতে পারছি। আর এটাও বুঝতে পারছি যে এই উপলব্ধি আমরা যত আগে করতে পারব, জীবন তত অর্থবহ হবে।
ইতিহাসের গুরুত্ব
আমি তোমাদের সঙ্গে আজ মোটেও একজন সিইও হিসেবে কথা বলব না। ইতিহাস মেজর নিয়ে পড়া একজন সাবেক ছাত্র হিসেবে বলছি। ভবিষ্যৎ জানতে হলে, আগে ইতিহাস জানো। আমি প্রযুক্তির ব্যবসা করি, প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করি। একটা গোপন কথা বলি তোমাদের, আমি কিন্তু আমার কাজে মোটেও পাকা নই। এরপরও আমি যে একটু-আধটু সাফল্য পেয়েছি, এর কারণ হলো, আমি ভবিষ্যৎ আঁচ করতে পারি। কেমন করে? আমি ইতিহাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমি খুব দ্রুত অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎকে দেখি। পশ্চিমা বিশ্বের সভ্যতার সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের ইতিহাস যদি তোমরা জেনে থাকো, তাহলে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারবে সামনের দিনগুলোয় কী অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য।
মধ্যযুগের বুবনিক প্লেগ মহামারির পর বদলে গিয়েছিল পাশ্চাত্য সভ্যতা। মহামারির ছোবল থেকে বেরিয়ে আমরা পা রেখেছিলাম আধুনিক যুগে। এরপর গত শতকে আমরা দেখি স্প্যানিশ ফ্লুর আক্রমণ। আর সেই মহামারি সামলে ওঠার পরই কঠিন হতাশার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা। দেখেছিলাম যুদ্ধ, হানাহানি, বিভেদ। আমরা আজ আরও একটি মহামারি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আর ইতিহাস দেখে আঁচ করা যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে বড় কোনো পরিবর্তনের ডাক নিয়ে। সেই পরিবর্তন থেকে ভালো কিছু বের করে আনার জন্য নিজেদের তৈরি করো।
সূত্র: অ্যালেক্সিস ওহেনিয়ানের ইউটিউব চ্যানেল
ইংরেজি থেকে অনুদিত
লেখক: আদর রহমান
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুলাই ০৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,