মহামারির শেষ দিকে বিশ্ব অর্থনীতি যখন গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই শুরু হলো ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা। সে জন্য আবারও ব্যাহত হচ্ছে বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থা। বিশ্ববাজারে প্রায় সবকিছুর দামই বেড়েছে। ফলে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অয়েল প্রাইস ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে মূল্যস্ফীতির হার গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্যের মূল্য আরও কিছুদিন বাড়তি থাকবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
উদ্বেগের খবর হলো, এখন বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ চাহিদার চেয়ে কম। জেপি মর্গ্যান অ্যান্ড চেজের পণ্য–বিষয়ক কৌশলবিদ ট্রেইসি অ্যালেন অয়েল প্রাইস ডটকমকে বলেছেন, জ্বালানি, কৃষিপণ্য, ধাতু—সবকিছুর মজুত সবখানেই বিপজ্জনকভাবে কম। তবে জেপি মর্গ্যান মনে করছে, আগামী বছরের শেষ নাগাদ ভান্ডার আবার ভরে উঠবে।
বিশ্বের গম ও ভুট্টার ৩০ ও ২০ শতাংশ আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ফলে খাদ্যমূল্যে যুদ্ধের প্রভাব কতটা, এ পরিসংখ্যান থেকেই তা আন্দাজ করা যায়। এখানেই শেষ নয়, এ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আমেরিকার আবহাওয়া বিরূপ থাকবে। তার সঙ্গে জ্বালানি ও সারের উচ্চমূল্য তো আছেই। সব মিলিয়ে এ বছর খাদ্যমূল্য বাড়তি থাকবে বলেই বোঝা যাচ্ছে। আর খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হলে দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেবে।
এ মুহূর্তে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রণীত খাদ্যমূল্য সূচক ৩২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। বস্তুত, ১৯৯০ সালে এ সূচক প্রণয়ন শুরু হওয়ার পর মার্চে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে—১৫৯ দশমিক ৩ পয়েন্ট। গত বছরের মার্চের তুলনায় এ বছরের মার্চে বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৬ পয়েন্ট। মার্চ মাসে শুধু গমের দামই বেড়েছে ২০ শতাংশ। ভুট্টা ও বার্লির দাম বেড়েছে যথাক্রমে ১৯ ও ২৭ শতাংশ। উদ্ভিজ্জ তেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
আরও শঙ্কার খবর হলো, এফএও মনে করছে, খাদ্যের দাম আরও বেশ কিছুদিন বাড়তি থাকবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ গম উৎপাদন কম হবে। তারপর যুদ্ধ কত দিন চলে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে। এ ছাড়া রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় ইউরোপের অনেক দেশে সার উৎপাদন কমে যাবে। এতে খাদ্য উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। আর সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার প্রভাব তো ইতিমধ্যে পড়েছেই।
যুদ্ধ-বিগ্রহ, জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য বাধা—এসব কিছু বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জার্মানভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ বলেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০০৭ সালে বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশের জনসাধারণ, বিশেষ করে চরাঞ্চল, নদী, পাহাড়, বরেন্দ্র, হাওর ও সমুদ্র উপকূলবর্তী জনগোষ্ঠী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, পাহাড়ধস ইত্যাদি কারণে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের শিকার হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক সংকট। ফলে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি দেশের দরিদ্র ও অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে যেসব দেশ খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তাদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। শ্রীলঙ্কার সরকার এখন রীতিমতো খাদের কিনার দিয়ে হাঁটছে। একদিকে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে গেছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে খাদ্য আমদানি করাও তার জন্য সমস্যাজনক। মিসরের অবস্থাও খারাপ। শ্রীলঙ্কার মতো তারাও শেষমেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয়েছে। আবার রপ্তানিকারকেরা খাদ্য রপ্তানি কমিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এখন পর্যন্ত ৫৩টি খাদ্যসংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এর আগে ২০০৭ ও ২০১১ সালের খাদ্যসংকটের সময় দেখা গেছে, এ ধরনের বিধিনিষেধের ফল ভালো হয় না। এবার যে তাতে ভালো ফল মিলবে, তার সম্ভাবনা কম।
সাম্প্রতিক অতীতে সবচেয়ে বড় খাদ্যসংকট দেখা দেয় ২০০৭ সালে। তখন বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবখানেই খাদ্যমূল্য অনেকটা বেড়ে যায়। তবে তার আগে দীর্ঘদিন খাদ্যবাজার স্থিতিশীল ছিল তা–ই নয়, বরং দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৭৪-২০০৫ সালের মধ্যে বিশ্ববাজারের খাদ্যমূল্য বাস্তব অর্থে তিন-চতুর্থাংশ হ্রাস পেয়েছিল। পশ্চিমা বিশ্বে যে মানুষ খাবার নষ্ট করত, তার প্রধান কারণ ছিল খাদ্যের নিম্ন মূল্য। কিন্তু ২০০৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শস্য দিয়ে বায়ো ফুয়েল বানাতে গিয়ে বিপর্যয় ডেকে আনে। সেবার বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। ফলে খাদ্যমূল্য আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। এর পর থেকে খাদ্যমূল্য আর সেভাবে কমেনি।
গরিব মানুষের দুরবস্থা
দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক হিসাবে দেখা গেছে, শহরের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো গড়ে মোট খরচের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে, আর গ্রামীণ প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো করে ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এ ক্ষেত্রে যে হিসাব দেয়, তার তুলনায় এ হার অনেক বেশি। বিবিএসের হিসাবে শহর ও গ্রামের পরিবারগুলো তাদের মোট খরচের যথাক্রমে ৪৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ৫৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ খাদ্যের পেছনে খরচ করে।
ফলে বোঝা যাচ্ছে, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গরিব মানুষেরা। দেশে দেশে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি বাড়লে বা মানুষের আয় কমলে গরিব মানুষেরা প্রথমেই খাদ্য ব্যয় কমায়। মহামারির শুরুতেও দেখা গেছে, মানুষের যখন আয় কমল, তখন তাদের খাদ্য ব্যয়ও কমল।
বিশ্লেষকেরা বলেন, পরিবারের খাদ্য ব্যয় কমে গেলে শিশুদের ওপর বড় প্রভাব পড়ে। প্রয়োজনীয় খাদ্য না পেলে তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে তাদের ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতা কমে যায়, সুযোগ সংকুচিত হয়।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: এপ্রিল ১৭, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,