জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, হতাহতের ঘটনা, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও নির্যাতনে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ভবিষ্যতে এ ধরনের নির্যাতন রোধ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সভা–সমাবেশের অধিকার সমুন্নত রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থার সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা চিঠিতে এমন মন্তব্য করেছেন। গত ২৩ জুলাই তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওই চিঠি লেখেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা চিঠির জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত ২৯ জুলাই ফলকার টুর্ককে চিঠি পাঠিয়েছেন। ওই চিঠিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে বলা হয়েছে, পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়া তৃতীয় পক্ষের সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পার্থক্যের বিষয়ে পরিষ্কার হতে হবে। বর্তমানে ঘটনার বিচারিক ও প্রশাসনিক তদন্ত চলছে। এ সময় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ও এর সংশ্লিষ্টদের বাংলাদেশ নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা উচিত, তা না হলে সেটি আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমসহ মানুষের ধারণা অন্যদিকে প্রভাবিত করতে পারে। তদন্তের আগে একপক্ষীয় প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কোনো বিবৃতি দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারকে।
প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেন, প্রায় পুরোপুরি ইন্টারনেট বন্ধ ও যোগাযোগব্যবস্থা ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে মানুষের নিহত ও আহত হওয়ার একাধিক খবর পেয়েছে তাঁর দপ্তর। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিক্ষোভ দমনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বুলেটের ব্যবহার, নির্বিচার গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন ও নিগৃহীত করাসহ মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। তাঁরা এটাও জানতে পেরেছেন যে বিক্ষোভকারীরা সরকারসংশ্লিষ্ট হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর সহিংস আক্রমণের শিকার হয়েছে। সেখানে তাদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আর্মড পুলিশ, বিজিবি ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মতো আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন আরও ঝুঁকি তৈরি করে। তাঁরা বিরোধী নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তারের বিষয়েও অবগত, যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার লিখেছেন, ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্ববৃহৎ জনবল মোতায়েনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার অবিচল সমর্থক। তবে বিক্ষোভের সময় মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নির্বিচার গ্রেপ্তার এবং নির্যাতনের খবর গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।’
ফলকার টুর্ক জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ও জনপরিসরে সংলাপের সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব অভিযানকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান অনুযায়ী পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য বিচার ও জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিতে সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্ত জরুরি। ভবিষ্যতে এ ধরনের নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি বন্ধ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা এবং শান্তিপূর্ণ সভা–সমাবেশের অধিকার রক্ষায় আইনশঙ্খলা রক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। চলমান সংকট নিরসনে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রস্তুত বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সব অংশীজনের মধে৵ আস্থা স্থাপন ও উত্তেজনা প্রশমনে একটি তথ্যানুসন্ধানী মিশন পাঠাতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর প্রস্তুত রয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের চিঠির জবাবে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, তিন সপ্তাহ কোটা সংস্কার নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে। এ সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে যোগাযোগের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে এবং তাদের সর্বোচ্চ আদালতের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। এ সময়ে আন্দোলনকারীরা যাতে নিরাপদ পরিবেশে আন্দোলন করতে পারে, তা নিশ্চিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরবর্তী সময়ে এ আন্দোলনে কিছু রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় চরমপন্থি ও জঙ্গিগোষ্ঠী তৃতীয় পক্ষ হিসেবে অনুপ্রবেশ করে। আর এ তৃতীয় পক্ষের নেতৃত্ব দিয়েছে বিএনপি–জামায়াতে ইসলামী জোট এবং তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো। তারা ভুল তথ্য ছড়িয়ে ও উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভুল পথে পরিচালিত করে এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাত ও সহিংসতার উসকানি দেয়। পরিস্থিতি খারাপ হলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের আড়ালে দুঃখজনকভাবে কিছু মানুষ নিহত হয় এবং কিছু গুরুতর বর্বরতার ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ সময় তৃতীয় পক্ষ এ আন্দোলনকে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় এবং সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের রাজত্ব কায়েম করে।
চিঠিতে ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়া তৃতীয় পক্ষের সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পার্থক্যের বিষয়ে পরিষ্কার হতে হবে। বর্তমানে ঘটনার বিচারিক ও প্রশাসনিক তদন্ত চলছে। এ সময় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন এবং এর সংশ্লিষ্টদের বাংলাদেশ নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে। যাতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ মানুষের ধারণা অন্যদিকে প্রভাবিত না হয়। তদন্তের আগে একপক্ষীয় প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কোনো বিবৃতি দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে অনুরোধ করেছেন।
পররাষ্ট্রসচিব তাঁর চিঠিতে কিছু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সুর মিলিয়ে স্বাধীন বিচার বিভাগ ও পেশাদার নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে ঢালাও মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। তিনি বলেন, এটি দুঃখজনক হবে যদি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন আন্তর্জাতিকভাবে অর্থায়নকৃতদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কালিমা লেপনের প্রচারণায় যোগ দেয়।
সূত্র: প্রথম আলো।
তারিখ: আগষ্ট ০১, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,