কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের চতর্মুখী হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসময় কয়েকস্থানে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষও হয়। সোমবার বিকেল তিনটা থেকে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। তারপর হামলার অভিযোগ ওঠে।
এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে নারী শিক্ষার্থীরা বাসে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে তাদের নামিয়ে হামলা করতে দেখা যায় মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। হামলা পরবর্তী ছত্রভঙ্গ হয়ে যান শিক্ষার্থীরা। এরপর দীর্ঘসময় ক্যাম্পাসে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় ছাত্রলীগ।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেছেন, তাদের অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
এ দিকে আহত শিক্ষার্থীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হলে সেখানেও দেশীয় অস্ত্র, চাপাতি নিয়ে হামলা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেখানে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত।
জানা গেছে, বিজ্ঞান অনুষদের হলগুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কোটা আন্দোলনের পক্ষে। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সেখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী, বহিরাগতদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে। সেখানে টানটান উত্তেজনা চলছে। এমনকি সেখানে ককটেল বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসএম ছাত্রলীগ, জগন্নাথ হল ছাত্রলীগ, মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হকিস্টিক, লাঠি নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায়। রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে ছাত্রলীগের মহানগরের নেতা-কর্মী এবং বহিরাগতরা ঢামেকে যান। তারা মেডিকেলের গেট ঘিরে থাকায় আহত কেউ হাসপাতালে প্রবেশ করতে পারছেন না।
বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে রাজু ভাস্কর্যে শেখ ওয়ালী ইনান ঘোষণা দেন, সবাই দোয়েল চত্বরে যান। তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগ, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দোয়েল চত্বর ও মেডিকেল মোড় এলাকায় অবস্থান নিতে দেখা যায়।
এ দিন দুপুর ১২টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইডেন কলেজ, নার্সিং কলেজের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।
দুপুর আড়াইটার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি দল মিছিল নিয়ে প্রতিদিনকার মতো ঢাবির হলগুলোতে যান। এ সময় দুপুর তিনটার দিকে খবর আসে, বিজয় একাত্তর হলে মিছিলে শিক্ষার্থীদের ওপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে।
খবর পেয়ে রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে বিজয় একাত্তর হলের দিকে যান আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে নারী শিক্ষার্থীরাও ছিলেন। এ সময় বিজয় একাত্তর হলে হেলমেট, লাঠিসোটা, হকিস্টিক নিয়ে হলগেটে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হলগেটে ভাঙচুর চালান।
এ সময় পার্শ্ববর্তী কবি জসীমউদ্দীন হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। দুই-তিনজন শিক্ষার্থীকে মারতে থাকে ছাত্রলীগ। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া-পালটা ধাওয়া হয়।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি রবিউল হাসান রানা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু ইউনুস, সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন রশীদ এবং বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান শান্তকে এ হামলায় নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত এসে মহড়া দেন এবং অস্ত্রশস্ত্রসহ সবাইকে নিয়ে মলচত্বরে যান।
এ দিকে পরিস্থিতির অবনতি হলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে মলচত্বরের দিকে চলে যান। এদিকে আগে থেকেই মধুর ক্যান্টিনে লাঠিসোটা, স্টিলের পাইপ, হকিস্টিক, মোটা কাঠ নিয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পি নেতা-কর্মীদের নিয়ে অবস্থান নেন। তার সঙ্গে বিপুল সংখ্যক বহিরাগতও ছিলেন। তারা প্রায় সবাই হেলমেট পরিহিত ছিলেন। শিক্ষার্থীরা মলচত্বরে গেলে ঢাবির শ্যাডোর দিক থেকে তাদের ওপর হামলা চালান তারা। এ ছাড়াও সূর্যসেন হল, প্রশাসনিক ভবন, ভিসি চত্বর থেকে বিপুল সংখ্যক বহিরাগতরা লাঠিসোটা, স্টিলের পাইপ নিয়ে হামলে পড়লে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর। তখন তারা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করেন।
এ সময় ভিসি চত্বর হয়ে ফুলার রোডের দিকে পালাতে শুরু করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। বেশি বিপাকে পড়েন নারী শিক্ষার্থীরা। মেয়েদেরকে দৌড়ে দৌড়ে হকিস্টিক-লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে বহিরাগতরা।
এ সময় ভিসি চত্বরে বিআরটিসি বাসে আত্মরক্ষার্থে উঠেন বহু নারী শিক্ষার্থী। তাদেরকেও বাস থেকে নামিয়ে পেটাতে থাকেন তারা। ফলে অনেকে ব্যাগ, ছাতা ফেলে কোনোমতে দৌড়ে পালান। কেউ ফুলার রোড হয়ে শহীদ মিনারের দিকে, কেউ পলাশীর দিকে, কেউ নীলক্ষেতের দিকে চলে যান।
শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ও রাজিবুল ইসলাম বাপ্পিকে দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী আর বহিরাগতদের নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায় ক্যাম্পাসজুড়ে। অন্যদিকে সৈকতও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী নিয়ে মহড়া দেন। এ সময় সবার হাতে মোটা কাঠ, স্টিলের পাইপ, হকিস্টিক ছিল। পরে তারা রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন। বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত তারা রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান করছিলেন।
এ দিকে হামলায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন জানিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম ‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘প্রায় দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। অনেকেই আটকে আছেন। সাংবাদিকরা দয়া করে তাদেরকে নিরাপদে আসতে কাভারেজ দিন। হলপাড়ায়, রেজিস্ট্রার ভবনে, এস এম হলে, টিএসসিতে আটকে আছে নারী শিক্ষার্থীরা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১৬তম ব্যাচের ছাত্রী তানজিলা তাসনীম বলেন, ‘ভিসি চত্বরে মৈত্রী হলের এক মেয়ের হাতে ইটপাটকেল লাগার কারণে নড়তে পারছিল না। ফলে আমি ওকে ছেড়ে আসতে পারিনি। এ সময় হেলমেট পরা কয়েকজন এসে আমাদের সরে যেতে বলেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। আমি বলেছিলাম, আমি জাস্ট যৌক্তিক আন্দোলনে ছিলাম। তারপর উনি আমার ডান হাত মুচড়ে দিয়েছে। আমরা এখন ওই মেয়েকে নিয়ে মেডিকেলে এসেছি। আমার খারাপ লাগছে, নিজ ক্যাম্পাসে এভাবে হামলার স্বীকার হয়েছি।’
এ দিকে সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার দিকে ক্যাম্পাসের এক শিক্ষার্থীকে পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে পেয়ে পিটুনি দেয় মহানগর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়াও শিক্ষার্থী পেলেই মারধর করা হচ্ছে।
সংঘর্ষের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, আমাদের নেতা-কর্মীদের তারা উস্কে দিয়েছে। আমরা দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছি। আজকে তাদেরকে আমরা ৫ মিনিটে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছি।
ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শয়ন বলেন, ওরা সাধারণ শিক্ষার্থী নন, তারা বিএনপির ইশরাকের কর্মী। এই আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থী ১০-২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশ শিবির-ছাত্রদলের এক্টিভিস্ট। জামায়াত-শিবির, ছাত্রদলকে আমরা যুগে যুগে পরাজিত করেছি। তারা কোনো কিছুই করতে পারেনি। এবারও কিছু করতে পারবে না।
এসময় তিনি জানান, সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের তিন থেকে চারজন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।
সূত্র:সমকাল।
তারিখ: জুলাই ১৫, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,