কোনো মানসিক রোগের কারণে বা তাৎক্ষণিক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে কেউ কেউ নিজের জীবনকে শেষ করে ফেলে, বেছে নেয় স্বেচ্ছা–মৃত্যুর পথ। যাকে বলা হয়, আত্মহত্যা।
আত্মহত্যা দুই ধরনের—নির্ধারিত বা পরিকল্পিত, যা সাধারণত বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন মানসিক রোগের কারণে হয়ে থাকে। এ ধরনের আত্মহত্যার ক্ষেত্রে ব্যক্তি নানাভাবে জানান দিতে থাকে যে, সে মরে যেতে চায়। তারা নানা পরিকল্পনা করে আত্মহত্যার উপকরণ সংগ্রহ করে। সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যার জন্য উপযুক্ত সময় আর স্থান বেছে নেয়।
আরেকটি ধরন হচ্ছে ইমপালসিভ বা হঠকারী আত্মহত্যা। এটা সাধারণত আন্তব্যক্তিক সম্পর্কের টানাপোড়েন (ইন্টার পারসোনাল কনফ্লিক্ট) থেকে হয়। এ ধরনের আত্মহত্যাকারীরা আগে থেকে তেমন কোনো কিছু জানান দেয় না—সাময়িক আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়। তবে গবেষণা বলে যারাই আত্মহত্যা করে, তাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে কিছু ঝুঁকি থাকে—তা যে ধরনের আত্মহত্যা হোক না কেন।
কেন মানুষ আত্মহত্যা করে
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডার্কহাইম তাঁর এক বিখ্যাত গবেষণায় যারা আত্মহত্যা করে বা করতে চায় তাদের চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। এক. আত্মশ্লাঘায় পূর্ণ ব্যক্তি (ইগোস্টিক), যারা সব সময় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে—সামাজিকতা পরিহার করে নিজের সবকিছু নিয়ে অহংবোধে ভোগে। দুই. পরার্থবাদী (অল্ট্রুস্টিক)—যাদের সামাজিক সম্পৃক্ততা খুব বেশি। তিন. আত্মপরিচয়হীন (এনোমিক), যারা সামাজিক রীতিনীতির ধার ধারে না—যাদের কোনো স্বকীয় পরিচয় নেই এবং নেই কোনো সামাজিক বন্ধন। চার. অদৃষ্টবাদী (ফ্যাটালিস্টিক), যারা সব সময় অদৃষ্টের ওপর নির্ভর করে এবং খুব কঠোরভাবে সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে ক্ষুব্ধ হয়।
বিশ্বখ্যাত মনোবিশ্লেষক-মনোচিকিৎসক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মধ্যে অবচেতনে থাকে ‘মৃত্যুপ্রবৃত্তি’। পরিবেশ–পরিস্থিতির প্রভাবে এটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তখনই ‘মরিবার সাধ’ হয় তার। কবির কবিতায় আর চিত্র পরিচালকের নির্দেশনায় আত্মহত্যা কখনো হয় মহিমান্বিত—যার ফল হয় ভয়াবহ।
আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশনের মেডিকেল ডিরেক্টর, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হার্বার্ট হেনডিন বলেছেন, ‘নান্দনিকতার আবরণে আত্মহত্যাকে শৈল্পিক করে দর্শক বা পাঠকের জন্য আকর্ষণীয়ভাবে প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করা হলে তা আত্মহত্যার প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, নিউইয়র্ক টাইমস–এর একটি প্রতিবেদনের কথা তিনি বলেন, যেখানে স্কুলপড়ুয়া দুই কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যাকে রোমিও-জুলিয়েটের কাহিনির সঙ্গে তুলনা করে বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে ‘রোমান্টিক ফ্লেভার’ দেওয়ায় কিশোর-কিশোরীদের কাছে আত্মহত্যা তথাকথিত মহৎ বা অনুকরণীয় কোনো দৃষ্টান্ত বলে ভুলভাবে উপস্থাপিত হতে পারে।
পাশ্চাত্যে মধ্য বা শেষ বয়সী মানুষেরা একাকিত্বে ভোগেন, যাকে বলা হয় ‘এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম’। এই একাকিত্বের কারণে সেখানে ৪০-৫০ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আর বাংলাদেশে ১১ থেকে ২৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ইউরোপ-আমেরিকায় অবিবাহিত বা বিধবা-বিপত্নীকদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, মানব মস্তিষ্কের সেরিব্রোস্পাইনাল তরলের মধ্যে ‘৫-হাইড্রোক্সি ইনডোল অ্যাসেটিক অ্যাসিড’ নামের একটি রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ কমে গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। আত্মহত্যা করার জন্য প্রথমে বিক্ষিপ্তভাবে মনের মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা আসে। এরপর বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলো বারবার আসতে থাকে। ব্যক্তি এই চিন্তা থেকে সহজে মুক্ত হতে পারে না। আত্মহত্যার চিন্তা তার স্বাভাবিক কাজকর্মের ওপর প্রভাব ফেলে এবং তার আত্মহননের ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সে ভাবে ‘কেন আমি বেঁচে থাকব?’ একসময় তার মনে হয় এখনই তার মরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময়। সে কখনো আবেগতাড়িত হয়ে, আবার কখনো পরিকল্পিকভাবে মৃত্যুচেষ্টা করে। সফল না হলে তার মধ্যে আবার বিক্ষিপ্তভাবে আত্মহত্যার চিন্তা আসতে থাকে। এই চক্রটি বারবার হতে পারে।
বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিভিন্ন গবেষণায় কিছু বিষয় উঠে এসেছে।
● যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন: গ্রামের দরিদ্র থেকে শুরু করে শহুরে উচ্চশিক্ষিত বিবাহিত নারীরাও যৌতুকের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
● দাম্পত্য কলহ: অসুখী দাম্পত্যজীবন ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে থাকে।
● উত্ত্যক্ততা ও প্ররোচনা: অল্পবয়সী স্কুল–কলেজের ছাত্রী এবং তরুণীরা নানাভাবে উত্ত্যক্ত, প্রতারিত এবং সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার কারণে আত্মহত্যা করে ফেলে।
● প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা: প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কিংবা পরীক্ষায় ফেল করে প্রতিবছর অনেক নারী ও পুরুষ এ দেশে আত্মহত্যা করে থাকে।
● দারিদ্র্য ও বেকারত্ব: অর্থকষ্ট আর বেকারত্বের কারণে এ দেশে আত্মহত্যার নজির অনেক রয়েছে।
● আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা: আত্মহত্যার যত উপকরণ রয়েছে তার প্রায় সবই সহজপ্রাপ্য, কেবল আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া।
● মানসিক অসুস্থতা: এ দেশে ১৬.১ শতাংশ মানুষ কোনো না–কোনো মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত। এই মানসিক অসুস্থদের এক বিরাট অংশ রয়েছে, আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে। বিশেষত বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি, সিজোফ্রেনিয়া, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, তীব্র মানসিক চাপ ইত্যাদি রোগে যাঁরা ভুগছে, তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।
● জটিল শারীরিক রোগযন্ত্রণা থেকে আত্মহত্যা।
● নগরায়ণ ও যৌথ পরিবারের বিলুপ্তি।
● নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতা।
আত্মহত্যার ইঙ্গিত
● সাধারণ কথোপকথনে অনানুষ্ঠানিকভাবে মৃত্যুর কথা বলে, মরে যেতে চায়—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে।
● আত্মহত্যা বা মৃত্যুবিষয়ক কবিতা গান লেখা বা শোনা বা পড়া।
● প্রায়ই হাত–পা কাটে, বেশি বেশি ঘুমের ওষুধ খায়।
● বিষণ্নতার লক্ষণ (মনমরা হয়ে হয়ে থাকে, সব কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, নিজেকে সব বিপর্যয়ের জন্য দোষী মনে করে)।
● মাদকাসক্তির লক্ষণ (চিন্তা আর আচরণের পরিবর্তন, রাতে জেগে থাকা—দিনের বেলা পর্যন্ত ঘুম, মিথ্যা বলা, টাকার চাহিদা বেশি, আগ্রাসী আচরণ ইত্যাদি)
● বন্ধুবান্ধব, পরিবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, সমাজিকতা এড়িয়ে চলে। একা একা থাকে।
● নিজের পছন্দের জিনিসগুলো ভাইবোন বা বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে থাকা।
● পড়ালেখা, খেলাধুলা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা।
● খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেওয়া, ঘুমের সমস্যা দেখা দেওয়া, কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারা।
প্রতিরোধ কীভাবে
● সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো: আত্মহত্যার ইচ্ছা একটি ভুল মানসিক প্রক্রিয়া এবং এটি যে কোনো অপমান বা অন্যায়ের প্রতিবাদ নয়, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ নানাবিধ মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্তকরণ ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে বহু আত্মহত্যা কমানো যাবে। মানসিক রোগের অপচিকিৎসা বন্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
● আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্তি রোধ করা: লাইসেন্সের মাধ্যমে কীটনাশকের বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা আর প্রেসক্রিপশন ছাড়া সব রকমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করা।
● স্কুল মেন্টাল হেলথ: প্রতিটি স্কুলে–কলেজে নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকেরা কী ধরনের আচরণ করবেন, সে বিষয়টি শিক্ষক প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
● প্যারেন্টিং: প্রশিক্ষণ প্রয়োজন মা–বাবারও। কেবল জিপিএ–৫ আর ভালো ফলের জন্য সন্তানকে চাপ না দিয়ে তাকে সামাজিকভাবে দক্ষ হতে সহায়তা করতে হবে। সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও যে জীবনের অনুষঙ্গ তা সন্তানদের বোঝাতে হবে।
● ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণির প্রতি বিশেষ সহায়তা: মাদকাসক্তি ব্যক্তি, মানসিক রোগী, অভিবাসী, বেকার ও সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণিচ্যুত ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। এ কারণে তাদের প্রতি বিশেষ সহায়তা কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন।
● পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন: পারিবারিক বন্ধন বাড়ানো, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, অনেকে মিলে খেলা যায় এমন খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি সেই সঙ্গে ধর্মাচরণ মেনে চললে আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো যায়।
● নারীর ক্ষমতায়ন: যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন এবং উত্ত্যক্তকরণের ফলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এসব কারণ দূর করার জন্য প্রয়োজন নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন।
● গণমাধ্যমের ভূমিকা পরিবর্তন: আত্মহত্যার কৌশল ও মাধ্যম নিয়ে ফলাও করে পত্রিকায় বা টিভিতে সংবাদ প্রচার হলে, আত্মহত্যাকারীকে মহিমান্বিত করা হলে পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। আত্মহত্যার সংবাদ গণমাধ্যমে কীভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত হবে, সে বিষয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার একটি নীতিমালা রয়েছে—যা মেনে চলা সব প্রচারমাধ্যমের জন্য জরুরি।
বিশেষ পরামর্শসেবা আর সার্বক্ষণিক টেলিফোন সহায়তা-জাতীয় পর্যায়ে সার্বক্ষণিক টেলিফোনে সাহায্য পাওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। কারও মধ্যে আত্মহত্যার ইচ্ছা জন্মালে বা জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলে, সে যেন এই বিশেষ নম্বরগুলোতে ফোন করে সুপরামর্শ পায়।
আহমেদ হেলাল: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
সূত্র: প্রথম আলো। ডিসেম্বর ১২, ২০১৮
রেটিং করুনঃ ,